লন্ডনে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু: মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম আমি…। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২। নয় মাসের বন্দিজীবন কাটিয়ে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তান থেকে লন্ডন চলে আসেন তিনি।
পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্বাধীনতাকামী জনগণ যারা আমাদের সমর্থন জানিয়েছেন তাদের আমি ধন্যবাদ জানাই।
এ সময় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। মনে রাখতে হবে, যে মানুষ মরতে প্রস্তুত তাকে কেউ মেরে ফেলতে পারে না।
ওই দিন শীতের সকালে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি লন্ডনের হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে বিমান থেকে বের হন বঙ্গবন্ধু। ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশের সময় ঘোষণা এলো ‘শেখ মুজিবুর রহমানের’ টেলিফোন এসেছে।
এ সময় বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে থাকা ড. কামাল হোসেনকে ফোনে কথা বলতে বলেন। ফোনটি ছিল ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের ইয়ান সাদারল্যান্ডের। তিনি ড. কামালকে বলেছিলেন, এক ঘণ্টা আগেই ব্রিটিশ সরকার তাদের আগমনের খবর জেনেছে এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়েছে।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এমএম রেজাউল করিমকে হিথ্রো বিমানবন্দরে পাঠিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যখন লাউঞ্জে অপেক্ষা করছিলেন, তখন সেখানে আসেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার ও সাবেক সাংবাদিক নাসিম আহমেদ। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘স্যার, আমি আপনাকে স্বাগত জানাতে এসেছি। দয়া করে আপনি বলুন, আমরা আপনার জন্য কী করতে পারি?’ তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আপনি যথেষ্ট করেছেন, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’
এর কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন ইয়ান সাদারল্যান্ড। তিনি ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ সরকার নির্ধারিত সরকারি লিমোজিন ব্যবহার না করে রেজাউল করিমের গাড়িতে চড়েই হোটেলে যান। হোটেলে পৌঁছার পর বঙ্গবন্ধু ঢাকায় তার পরিবার, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এ সময় হাজার হাজার বাঙালি হোটেল ক্যারিজেস ঘিরে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করেন। অনেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ করেন; যা নিয়ে সমস্যায় পড়ে হোটেল কর্তৃপক্ষ। পরে সিদ্ধান্ত হয় পাঁচজনের একটি দল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে পারবে। দুপুরে হোটেলে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু।
তিনি বলেন, আজ আমি মুক্তভাবে দেশবাসীর সঙ্গে স্বাধীনতার আনন্দ ভাগ করে নিতে পারছি। এক মহাকাব্যিক সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই লড়াইয়ের চূড়ান্ত অর্জন হল একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠন করা। জাতির পিতা আরও বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ যে পরিমাণ মূল্য দিয়েছে এবং কষ্ট ভোগ করেছে, অন্য কোনো জাতিকে তা করতে হয়নি। আমি আমার দেশের মানুষের কাছে ফেরার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছি না।
বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগোষ্ঠীকেও তাদের সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। এখন আমি সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাই বাংলাদেশকে অতিসত্বর স্বীকৃতি দিতে এবং জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তিতে সমর্থন জানাতে।
তিনি বলেন, আমি দেশ ও দেশের বাইরে থাকা প্রত্যেক বাংলাদেশিকে ধন্যবাদ জানাই। অভিনন্দন জানাই মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে। যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করা লাখ লাখ মানুষের শোকাহত পরিবারের প্রতি জানাচ্ছি সমবেদনা এবং বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দেন বঙ্গবন্ধু। একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আপনি কি কখনও ভেবেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবে? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি প্রায় ৩৫ বছর ধরে রাজনীতি করছি। যেদিন আমাকে কারাগারে নেয়া হয় আমি বুঝতে পারছিলাম না বেঁচে থাকব নাকি মরে যাব। তবে আমি জানতাম বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন হবে, তাদের কেউ দমাতে পারবে না।
আরেক সাংবাদিক পশ্চিম পাকিস্তানে আটক এবং সেখানে যেকোনো সময় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়ে জানতে চান। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। মনে রাখতে হবে, যে মানুষ মরতে প্রস্তুত তাকে কেউ মেরে ফেলতে পারে না।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাকে কারাগারের যে সেলে রাখা হয়েছিল সেখানে সূর্যের আলো বা বাতাস কিছুই ঢুকত না, কোনো রেডিও বা খবরের কাগজও দেয়া হতো না। বিশ্বের কোনো কিছুর সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ছিল না। অবশ্য জুলফিকার আলী ভুট্টো আমার কাছে এসেছিল। তার মাধ্যমেই প্রথম জানতে পারি বাংলাদেশের সরকার গঠনের কথা, আমাকে প্রেসিডেন্ট করার কথা।
এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশে কী বীভৎসতা চালানো হয়েছে তা শুনলে আপনারা আশ্চর্য হবেন। লাখ লাখ মানুষকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, মাইলের পর মাইল যেভাবে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, বেঁচে থাকলে হিটলারও হয়তো লজ্জা পেতেন।
বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, বাংলাদেশ যে কতটা সম্পদশালী ছিল তা আপনারা জানেন। কিন্তু একশ’-দেড়শ’ বছরের বিদেশি শাসনে অনেক কিছুই হারিয়েছে বাংলাদেশ। আমি মনে করি ব্রিটিশ সরকারেরও এখন দায়িত্ব বাংলাদেশকে সহায়তা করা।
আরও পড়ুনঃ ওই মহামানব আসে…
আরও পড়ুনঃ মুজিববর্ষে আমাদের প্রত্যাশা
আরও পড়ুনঃ জগতে জ্যোতির্ময় জাতির জনক
আরও পড়ুনঃ ইরানের বিধ্বস্ত ইউক্রেনের বিমানের ভিডিও প্রকাশ করল যুক্তরাষ্ট্র
আরও পড়ুনঃ ভবঘুরে মজনুর বিকৃত জীবন
আরও পড়ুনঃ যুদ্ধ এক দুঃখ
আরও পড়ুনঃ মুজিববর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানে জাস্টিন ট্রুডো
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
কারণ বাংলাদেশের সম্পদ আহরণ করেই আজকের ব্রিটেনে অনেক স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। সেই ঋণ আজ পরিশোধের সময় এসেছে। শুধু ব্রিটেন নয়, আমি সারা বিশ্বের প্রতি লাখ লাখ মানুষকে ক্ষুধার জ্বালা থেকে বাঁচানোর আহ্বান জানাই।
ওই দিন সন্ধ্যায় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু। বৈঠকে ব্রিটিশদের বাংলাদেশকে সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্ন তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দলিল অনুযায়ী, ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি হিথ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে এক বার্তায় বলেছিলেন, ‘তিনি (মুজিব) আত্মবিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির সঙ্গে কথা বলেছেন।
যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা পৌঁছতে উদগ্রীব হয়ে আছেন তিনি। মুজিব আমাকে বলেছেন, বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এখন কোনো আনুষ্ঠানিক যোগসূত্র নেই। মুক্তির আগে ভুট্টোকেও একই কথা বলেছেন তিনি।’
নিক্সনকে লেখা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বার্তাটিতে আরও বলা হয়েছিল- ‘তিনি পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার তিক্ততার কথা বলেছেন, তবে ভুট্টোর প্রতি কোনো বিরক্তি প্রদর্শন করেননি; বরং তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।’
পরদিন ৯ জানুয়ারি লন্ডন সময় সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে ঢাকায় ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু ওঠেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবহরের কমেট জেটে। ঢাকায় ফেরার পথে বিমানটি দুই ঘণ্টার যাত্রাবিরতি করে দিল্লিতে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লিতে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। এরপর ঢাকায় ফিরলে বঙ্গবন্ধুকে ঐতিহাসিক গণসংবর্ধনা দেয়া হয়।