পূর্ব প্রকাশের পর…
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ৪
বাবা জানতেন না আমরা কোথায় আছি, কোন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছি ফলে অনেক খোঁজাখুঁজির পর বিশ্বাস বাবুর বাড়িতে গিয়ে জানতে পেরেছিলেন শ্রীনাথপুর ক্যাম্পের কথা। আমরা যে কৈলাশহরে গিয়ে বিশ্বাস বাবুর বাড়িতে উঠেছি সেটা বাবা জানতেন না, কারণ বিশ্বাস বাবুর বাড়িতে উঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিলো রাস্তায়। আমাদের ভারত যাত্রার বিশাল দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিশির কাকু। শিশির কাকুর সিদ্ধান্তেই সেই বাড়িতে উঠা হয়েছিলো। আমরা শ্রীনাথপুর শরনার্থী ক্যাম্পে যাবার বেশ ক’দিন পর বাবা আর ঠাকুরমাকে দেখে কি যে আনন্দ হয়েছিলো। প্রায় ১০/১৫ দিন বাবা আর ঠাকুরমার কোনো খোঁজ ছিলো না, অনেককে জিজ্ঞাসা করার পরও কেউ বলতে পারেনি ওরা কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন কি-না রাজাকাররা মেরে ফেলেছে ফলে মা আর আমরা অজানা শঙ্কায় কাঁদতে শুরু করি। সেসময়ে টেলিফোন, মুঠো ফোন নাথাকলেও মানুষের মুখে মুখে চা্উর হয়ে যেতো যে প্রতিদিনই কতো পরিচিত জনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যেতো, কী ভয়ানক নৃশংসভাবে হত্যার খবর চাউর হতে লাগলো ফলে ভয় আর শঙ্কা বেড়ে গিয়েছিলো। এদিকে বাবা না থাকাতে ক্যাম্পে আমাদের রেশন নিয়েও সমস্যা শুরু হলো, মা একা একা সব কিছু করতে গিয়ে ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিলেন। সবচেয়ে অবাকের বিষয় ছিলো আমাদের কুকুর টমটম আবারো বাবা আর ঠাকুরমার সঙ্গে ভারতে এসেছিলো এবং তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে ২/৩ দিন ঘুরে ক্যাম্প পর্যন্ত গিয়েছিলো। পরদিন আবার টমটম ক্যাম্প থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়, পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম, টমটম বাড়িতেই ফিরে যায় এবং যুদ্ধ চলাকালীন খালি বাড়িটি পাহাড়া দেয় যা দেশে ফিরে বুঝতে পেরেছিলাম। এই কুকুরকে ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। পশু হয়ে প্রভু ভক্ত দেখিয়েছে নিস্বার্থভাবে অথচো যারা সারা জীবন আমাদের বাড়িতে কাজ কর্ম করে আমাদের জায়গা জমি ক্ষেত করে জীবন আর পরিবার পরিজন চালাতো তারাই আমাদের বিপদের সময় সব কিছু নেবার জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলো, বাবা এবং ঠাকুরমাকে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়েছিলো।
প্রথমে ক্যাম্পের পরিবেশটা আমার কাছে খুব খারাপ লেগেছিলো। সব সময় যেন ভয় ভয় করতো। অচেনা-অজানা-অপরিচিত পাহাড়িয়া এলাকায় একা একা ভীষণ নিঃসঙ্গ ভীষন্ন লাগতো। বারবার বাড়ির কথা মনে হতো, গ্রামের বন্ধুদের কথা মনে হলেই কষ্ট লাগতো, ফিরে যেতে ইচ্ছে করতো। সত্যি কথা বলতে কি বন্ধুদের কথা বাড়ির কথা মনে হলেই কান্না আসতো। গোপনে গিয়ে কাঁদতাম। লেখাপড়া-খেলাধূলা কিছুই করা সম্ভব হতো না। গ্রামের সমবয়সীরা পাশে নেই বলে ওদের কথা মনে হলেই কান্না বেড়ে যেত। না, বেশী দিন এমনি করে যায়নি, বেশ ক’জন সঙ্গী জোটিয়ে নিলাম। অনেকের বাড়িই আমাদের এলাকায় নয়, তা হলে কি হলো? তখোনতো আমরা সবাই এক ও অভিন্ন সবাই আত্মার আত্মীয়, ধনী-গরিব, জাত-ধর্ম কিছুই ছিলো না মনের মাঝে। সেখানে রান্না ঘর আর থাকার ঘরে যাওয়া আসায় কোন বাধ্য-বাধকতা কিংবা কোন কুসংসার ছিলো না। শ্রীনাথপুর ক্যাম্পে গিয়ে অনেক বন্ধু জোটেছিল তাদের অনেকের নাম এখন মনে নেই, কারণ একটাই ৪৯টি বছর পার হয়ে গেছে, আর এই ৪৯ বছরে জীবনের অনেক উত্থান পতন ঘটেছে। এই ৪৯ বছরের মধ্যে ক্যাম্পের তিন বন্ধু সন্তোশ ও অরুন (বর্তমানে প্রয়াত) (কমলগঞ্জ) আর করিম ( বাবা শহীদ হওয়াতে মা আর মামার সঙ্গে সম্ভবত নবিগঞ্জ থেকে ক্যাম্পে এসেছিলো) দু’বার দেখা হয়েছে। বাকী বন্ধু চিন্ময়, অবনী, ভাষ্কর দাদা, বাপ্পু, রঞ্জন, পাবলু, শহীদ, সুমন, মিলিসহ অনেকের সঙ্গেই আর কোনদিন দেখা হয়নি, জীবিতকালে আর দেখা হবে বলে বিশ্বাস করি না, কারণ কে কোথায় আছে কেমন আছে জানিনা। আর আমিতো এখনো এক পথহীন দেশছাড়া সুদূর প্রবাসে জীবন আর জীবিকার তাগিদে নির্বাসনে। যতই আমার হৃদয় কাঁদুক মা-দেশ-মাটি- আর স্বজন মানুষের জন্যে, জানি তবুও আর কোন দিন ফিরে যাওয়া যাবে না।
স্মৃতিচারণের অন্যান্য পর্বগুলি পড়তে হলে
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ৩
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ২
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ১
লেখাপড়া-কাজকর্ম নেই, বাবার চোখ রাঙানো নেই ফলে আমরা ক্যাম্পের লাইনে লাইনে দিন-দুপুর সকাল-সন্ধ্যা ঘুরতাম। কে কত নম্বর লাইনের ঘরে থাকতো তা হয়তো আমরা অনেকেই জানতাম না কিন্তু প্রতিদিন সকালে আমরা ক্যাম্পের পাশেই বড় ঘরের ( চা শ্রমিকদের মন্ডপে) সামনে সমবেত হতাম, চষে বেড়াতাম সারা ক্যাম্প। এই শরণার্থী ক্যাম্পের পাশ্বেই সম্ভবত ছিলো একটি মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং সেন্টার। ছিল ভারতের আর্মীদের বিশাল দু’টি ক্যাম্প, সেখান থেকেই ভয়ার্ত চোখে দেখেছি বড় বড় কামান আর মর্টার-সেলিং নিক্ষেপ করে বাংলাদেশ বিরোধী শত্রুপক্ষকে আক্রমন করতে। ভারতীয় আর্মীরা যখন মর্টার শেল নিক্ষেপ করতো তখন ভাবতাম তারা কি করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থানে নিক্ষেপ করতে পারে! আমরা সেখানে গিয়ে তাদের মর্টার আর শেল নিক্ষেপের দৃশ্য দেখতাম। আমাদেরকে আর্মী ক্যাম্পের ভিতরে যেতে না দিলেও ভারতীয় আর্মীরা আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতো না, অনেকেই আমাদেরকে আদর করতো। তাদের খাবার ‘বিশাল আকৃতি’র রুটি আর সবজি ভাঁজি খেতে দিত। এত বড় রুটি আমি এর পূর্বে আর কখনো দেখিনি। একটি সম্পূর্ণ রুটি আমি একা কখনোই খেতে পারিনি। আমরা সারাদিনব্যাপি কত রকমের খেলায় মত্ত থাকতাম আর তখন মনে হতো আমরা সেখানেই জন্মগ্রহণ করে বড় হয়ে উঠছি, যত দিন যাচ্ছিল এলাকাটা আমাদের কাছে ভীষণ আপন ও পরিচিত মনে হচ্ছিল। বাড়ির কথাও ভুলে যাচ্ছিলাম এক এক করে। নতুন নতুন সমবয়সী বন্ধুদের সংখ্যাও বেড়ে চললো। খাওয়া নাওয়ার চেয়ে শরণার্থী ক্যাম্প থেকে বস্তি, বস্তি থেকে আর্মীর ক্যাম্প, সেখান থেকে খেলাধূলা করেই যাচ্ছিল দিনগুলো। ক্যাম্পের পাশের বস্তির একটি বাড়ির পুকুরে সাঁতার কাটার জন্য গিয়ে পুকুরপাড়ের পিয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা খেতে গিয়ে মালিকের হাতে ধরা পরেছি, সে লজ্জা আজও ভুলতে পারছি না। না, মালিক একটুও রাগ করেননি, বরং নিজ হাতে পেয়ারা পেড়ে আমাদেরকে দিয়েছিলেন, যা দেখে শৈশবের চোখে অবাক বিষ্ময়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, পৃথিবীতে এমন মানুষের জন্ম হয়েছে বলেই পৃথিবীটা এত সুন্দর এত অমায়িক। একদল মানুষরূপী হায়েনার তাড়া খেয়ে সহায়-সম্পত্তি সব ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছি অন্য দেশে, অথচো অন্য দেশের মানুষ আমাদেরকে কতইনা সহানুভুতি দেখিয়ে আপন করে নিয়েছে, ভাবলে কতইনা অবাক লাগে। ক্যাম্পে আমাদের রেশন হিসেবে নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসই দিতো। একবার আমার বন্ধুদের কথায় বাবা-মাকে না জানিয়ে তাদের সাথে পাশের জঙ্গলে চলে যাই রান্নার জন্য লাকড়ি সংগ্রহ করতে। ভেবেছিলাম বাবা-মা হয়তো খুশি হবেন লাকড়ি দেখে। সকালে ঘর থেকে পাহাড়ের ভিতরে হাঁটতে হাঁটতে গহীন জঙ্গলে চলে যাই, লাকড়ি সংগ্রহ করে ফিরতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এদিকে সারাদিন আমি ঘরে না ফেরাতে বাবা-মা দুঃচিন্তায় পরে গিয়েছিলেন, সন্ধ্যায় যখন মাথায় এক মুটো লাকড়ি নিয়ে ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বাবা আমাকে এমন মার দিয়েছিলেন যা চার দিন জ্বর নিয়ে ঘরে থাকতে হয়েছিলো। আমাদের ক্যাম্পে যদিও বিভিন্ন রকমের রোগব্যাধি কম হয়েছিল, ফলে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল কম কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পগুলোতে রোগব্যাধির কারণে অগণিত মানুষের মৃত্যুবরণ করতে শোনা গেছে। কোন কোন ক্যাম্পে প্রতিদিন সেখানে ডাইরিয়া, ম্যালারিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্নরকমের অসুখে মানুষের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যেত।
ভারতে তখন আমাদের পরিচয় ছিল জয়বাংলার লোক হিসেবে। আমরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বাস কিংবা ট্রেনে কোথাও গেলে টিকিট কিংবা ভাড়া লাগতো না। জয় বাংলার লোকদের জন্য ফ্রি, বরং অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত।
সদেরা সুজনঃ প্রধান নির্বাহী, কানাডা-বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি সিবিএনএ, কানাডা
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ৪ ⇒ আ গা মী কা ল থা ক ছে প র্ব ৫
এস এস/সিএ
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন