শিল্পী সেলিম চৌধুরী :পর্দার অন্তরালে এক অতি মেধাবী মানব হিতৈষী মানুষের প্রতিচ্ছবি —সৈয়দ মাসুম
এক সময় লোক সঙ্গীতকে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের সঙ্গীত বলে মনে করা হত। অতি দরিদ্র ও গ্রামীণ মানুষের মধ্যেই এর চর্চা ছিল সীমাবদ্ধ। এই লোক সঙ্গীতকে দেশের যে কয়েকজন শিল্পী আধুনিক মন মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ তথা আমরা যাদেরকে শহুরে মানুষ বলে মনে করি তাঁদের কাছে জনপ্রিয় করেই শুধু তোলেননি,লোক সঙ্গীতকে বাঙালির ভাত মাছের মত জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ করে তুলতে হয়েছেন সক্ষম শিল্পী সেলিম চৌধুরী হচ্ছেন তাঁদের একজন।
স্বনামধন্য এই শিল্পীর জন্ম ১৯৬৬ খৃষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর শমসেরনগর বিমান বন্দর সড়কস্থ পৈতৃক নিবাস বাহার কুঠিতে। তাঁর পিতা আব্দুল হান্নান চৌধুরী আর মায়ের নাম বেগম বাহরুন্নেছা চৌধুরী। আব্দুল হান্নান চৌধুরী ছিলেন শমসেরনগর ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান। তাঁদের মূল পৈতৃক নিবাস হচ্ছে কমলগঞ্জ পৌরসভাধীন আলেপুরে।
সেলিম চৌধুরীর লেখাপড়ার হাতেখড়ি নিজ বাসভবনে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর লেখাপড়া বাসায় সম্পন্ন করে শমশেরনগরের রামচীজ রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি ভর্তি হন তৃতীয় শ্রেণীতে।পঞ্চল শ্রেণীতে টেলেন্টপুলে বৃত্তি লাভকরেন। শমসেরনগর এ এটি এম হাই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর পড়া সম্পন্ন করে চলে যান সুনামগঞ্জে। সেখানে সরকারি জুবিলি হাই স্কুলে ভর্তি হন। প্রখর মেধাবী সেলিম চৌধুরী উক্ত হাই স্কুল থেকে ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তি লাভ সহ ও সমগ্র গ্রেটার সিলেটের বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। দশম শ্রেণীতে উঠে আবারও শমসেরনগর চলে আসেন এবং শমসেরনগর এ এটি এম হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এস এস সি পাশ করেন।
তৎকালীন সিলেট সরকারি কলেজ যেটি বর্তমানে এম সি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ সেটি থেকে তিনি প্রথম বিভাগে এইচ এস সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিষয়ে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এসসি (অনার্স ) ডিগ্রি লাভ করেন।
সারা জীবন প্রথম হওয়া এই মানুষটি মাস্টার্স করেন মাইক্রো বায়োলোজি নিয়ে এবং এই বিষয়ে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও প্রথম শ্রেণীতে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন।
সেলিম চৌধুরী সঙ্গীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যাকে বলে সেই ধরনের কোন শিক্ষা অর্জন করেননি। প্রচন্ড মেধাবী হওয়ায় একাডেমিক শিক্ষার দিকেই সব সময় বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
তাঁর পরিবারের মধ্যে সংস্কৃতি চর্চার একটা পরিবেশ ছিল। সেই সত্তরের দশকেই বাংলাদেশতো বটেই বিশ্বের নামিদামি শিল্পীদের গাওয়া গানের লংপ্লে গ্রামোফোন রেকড তাঁর বাসায় বাজানো হতো। সঙ্গীতের নানা ধরনের ইন্সটুমেন্টও তাঁদের বাড়িতে ছিল। বাবা ভাই বোন সকলেই ছিলেন সঙ্গীত পিপাসু। ছোটবেলা থেকে তিনিও গুন্ গুন্ করে গান গাইতেন।
এক সময় শমসেরনগর সুরাসুর শিল্পী গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।সুরাসুর শিল্পী গোষ্ঠীতে তিনি ওস্তাদ আলী আকবর ও মীর লিয়াকত আলীর কাছে কিছু দিন তালিম নেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পী শুভ্র দেব, তার বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার, তাছাড়া তাঁর ছোট বোন তাহেরা চৌধুরীর স্বামী হাছন রাজার দৌহিত্র মমিনুল মউজদীন যিনি সমগ্র দেশে জল জ্যোৎস্নার কবি বলে পরিচিত তিনিও তাঁকে সঙ্গীত সাধনা করতে উৎসাহ দেন।
বন্ধু বান্ধব আর আত্মীয় স্বজনের অনুরোধে আর প্রণোদনায় মাঝে মধ্যে দু একটা অনুষ্টানে তিনি গান গাইতেন।
সেলিম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদুল্লাহ হলের যখন আবাসিক ছাত্র বরেণ্য কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ তখন উক্ত হলের হাউস টিউটর ।
হলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এস সিতে গানের মাধ্যমেই তিনি দর্শক শ্রোতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।
১৯৯৫ সালে সেলিম চৌধুরী হুমায়ুন আহমদকে সুনামগঞ্জে অনুষ্ঠিত হাছন উৎসবে নিয়ে যান। সেখানে সেলিম চৌধুরীর কন্ঠে হাছন রাজার গান ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ শুনে হুমায়ুন আহমেদ এত বেশি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন যে তিনি এর পরবর্তী সময়ে দেশের সেরা সেরা সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে সেলিম চৌধুরীকে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর সেলিম চৌধুরী থেমে থাকেননি। সঙ্গীতকেই করে নিয়েছেন তাঁর কর্ম ,সাধনা আর চলার পাথেয় হিসাবে।
হুমায়ুন আহমদের নাটক ছাড়াও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের গানে সেলিম চৌধুরী কন্ঠ দিয়েছেন।
গানের জন্য অর্জন করেছেন অসংখ্য সম্মাননা।
আধুনিক ও লোক সঙ্গীতের জনপ্রিয় এই সঙ্গীত শিল্পী রাধারমন, হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিমসহ বাংলাদেশের অসংখ লোক কবিকে আজকের দিনের মানুষের কাছে নতুন ভাবে উপস্থাপন করতে হয়েছেন সক্ষম।
ইউরোপ ,আমেরিকাসহ বাংলাভাষী আছেন পৃথিবীর এমন খুব কমসংখ্যক দেশ আছে যেখানে শ্রোতারা সেলিম চৌধুরীর গানে বিমুগ্ধ হয়নি। ২০থেকে ২৫টি দেশে এ পর্যন্ত তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন।
১৯৮৯সালে তাঁর প্ৰথম গানের এ্যলবাম ’কবিতার মত চোখ ’বের হয়। এ পর্যন্ত ১৪/১৫টি এ্যলবাম বেরিয়েছে।
১৯৯৭খ্রিস্টাব্দে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন নুহাশ চলচিত্র পুরুষ্কার।
সেলিম চৌধুরীর আবাসস্থলে ১৯৭১সালে আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীরা মর্টার আক্রমন করে। ঘটনা স্থলেই তাঁর বোন রিনা চৌধুরী মারা যান। প্রচন্ড ভাবে তিনি আহত হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র পাঁচ। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত শরীরে নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
খ্যাতিমান এই সঙ্গীত শিল্পী নীরব জীবন যাপনটাকেই বেশি পছন্দ করেন। রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকান্ড থেকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন সব সময়।
ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও এলাকার সাংসদ হওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে তিনি প্রস্তাব পেয়েও বিনয়ের সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
শমসেরনগর হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক তিনি। পারিবারিক আর বন্ধুবান্ধবদের চাপ এবং এলাকার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তিনি এ দায়িত্ব কাঁধে তোলে নিয়েছেন। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরে দ্রুত এগিয়ে চলেছে হাসপাতাল বাস্তবায়নের কাজ।
গান আর হাসপাতাল এই দুটিকে তাঁর দুই চোখ ধরেই জীবনের বাকি পথটুকু এগিয়ে চলার দীপ্ত মনোবৃত্তি এখন বাংলা মরমী গানের প্রবাদপ্রতিম এই সঙ্গীত শিল্পীর। জীবনে সবগুলো পরীক্ষায় যে মানুষটি প্রথম হয়েছেন হাসপাতাল নির্মাণের এই পরীক্ষায়ও তিনি প্রথম হবেন এটি তাঁর বন্ধু বান্ধব আর আত্মীয় স্বজনেরই নয় এলাকাবাসীদেরও বিশ্বাস।
(লেখক :কবি ,গবেষক ও সম্পাদক। লেখাটি শিল্পীর সাথে লেখকের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি করা।)