প্রবাসের সংবাদ ফিচার্ড

শ্রমবাজারে সতর্ক সংকেত

শ্রমবাজারে সতর্ক সংকেত

নূরে আলম জিকু। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে সৃষ্ট সংকট কাটিয়ে উঠছে বহির্বিশ্বের অনেক দেশ। স্বাভাবিক হয়ে উঠছে বাণিজ্যিক খাতগুলো। তবে বাংলাদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় ধুঁকছে দেশের শ্রমবাজার। বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে একের পর এক শর্ত আরোপ করছে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ। এতে প্রবাসে ফেরা নিয়ে বেড়েছে অনিশ্চয়তা। যা জনশক্তি রপ্তানিতে বড় ধাক্কা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ভ্যাকসিন প্রয়োগের বিলম্বের কারণেই প্রবাসী কর্মীরা বেশি সংকটে পড়েছেন। দেশে আটকে পড়া প্রবাসীরা ভ্যাকসিন না পাওয়ায় বহির্বিশ্বের শ্রমবাজারে তাদের অবস্থান নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

এদিকে দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ায় বাংলাদেশের ওপর বিধিনিষেধ জারি করেছে অনেক দেশ।

এদিকে বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞার ফাঁদে পড়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে অনেক প্রবাসীর। তাদের বেশির ভাগই পড়েছেন ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায়। আন্তর্জাতিক রুটের বাণিজ্যিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকায় চাকরিতে সময় মতো যোগ দিতে পারছেন না অনেকেই। এতে কারও কারও ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আবার অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন।

এদিকে বিশ্বের অনেক দেশই উন্মুক্ত করছে শ্রমবাজার। তবে ভ্যাকসিন গ্রহণ ব্যতীত কর্মী নিয়োগে জারি করছেন বিধিনিষেধ। যদিও বাংলাদেশে আটকে পড়া অধিকাংশ প্রবাসী কিংবা বিদেশ যেতে ইচ্ছুকরা এখনো ভ্যাকসিন পাননি। এতে কর্মী নিয়োগে বাড়ছে জটিলতা। সম্প্রতি সৌদি সরকার নানা বিধিনিষেধের মধ্যেই শ্রমবাজারের দুয়ার খুলেছে। তবে ভ্যাকসিন ছাড়া দেশটিতে প্রবেশ করতে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে প্রবাসীদের। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবের সঙ্গে সীমিত পরিসরে ফ্লাইট চলাচল চালু রয়েছে। আছে বিধিনিষেধও। ভ্যাকসিন গ্রহণ ছাড়া যাত্রীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর জন্য সকল খরচ বহন করতে হচ্ছে যাত্রীকেই। দেশে থেকেই সৌদিতে কোয়ারেন্টিনের জন্য হোটেল বুকিং দিতে হচ্ছে। যার খরচ প্রায় ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া বেড়েছে বিমান ভাড়াও। গত ২০শে মে থেকে দেশটির সরকার এ ব্যবস্থা কার্যকর করে আসছে। তবে প্রবাসীরা দেশটিতে প্রবেশ করার সুযোগ পেলেও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে তাদের বাড়তি খরচ। এরই মধ্যে অনেক প্রবাসীর ভিসা ও আকামার মেয়াদ শেষ পর্যায়ে।  মেয়াদ বাড়াতে কফিলের (নিয়োগদাতা) সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাচ্ছেন না তারা। এতে সময় মতো প্রবাসে ফেরা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন কয়েক হাজার সৌদি প্রবাসী।

সৌদি আরবের শ্রমবাজার নিয়ে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) সূত্র মতে, করোনাকালীন সময়েও গত বছর বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে ১ লাখ ৬১ হাজার ৭২৬ জন কর্মী প্রবেশ করেছে। চলতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে দেশটিতে ৬৫ হাজার ৪৬ জন কর্মীর কর্মসংস্থান হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নানা নির্দেশনার কারণে বাংলাদেশ থেকে কর্মীরা যেতে বাধার মুখে পড়ছেন।

বাংলাদেশিদের জন্য আরেকটি বৃহত্তম শ্রমবাজার কুয়েত। তবে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রবাসীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে কুয়েতের স্থানীয় বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (ডিজিসিএ)। কুয়েতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে ডিজিসিএ এই নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে প্রবেশ করতে হলে এর আগে অন্যকোনো দেশে অন্তত ১৪ দিন অবস্থান করে করোনা নেগেটিভ হতে হবে। এতে দেশে আটকে আছেন কুয়েত প্রবাসীরা। ভিসার মেয়ার শেষ ও চাকরি হারানোর আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।

সংযুক্ত আরব আমিরাতও বাংলাদেশ থেকে যাত্রী ও ফ্লাইট প্রবেশে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বাংলাদেশি কর্মীরা আমিরাতে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দেশটির ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি ক্রাইসিস অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটির (এনসিইএমএ) নির্দেশনা অনুযায়ী ১৩ই মে থেকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার কোনো যাত্রী ও উড়োজাহাজ আমিরাতে প্রবেশ করতে পারছে না। এমনকি এ চার দেশে ট্রানজিট নেয়া যাত্রীদের জন্যও আমিরাতের দুয়ার বন্ধ রয়েছে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা কতোদিন বহাল থাকবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) গত ৮ই মে দেশে প্রথম করোনার ভারতীয় ধরন শনাক্ত করে। এদিন বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে কর্মী ও ভ্রমণকারীদের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মালয়েশিয়া। এতে ছুটিতে এসে কর্মীরা দেশে আটকা পড়েছেন।

এদিকে মালয়েশিয়ায় সরকার জানিয়ে দিয়েছে করোনার টিকা দেয়া ব্যতীত সে দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানির  কোনো সুযোগ থাকছে না। বাংলাদেশ থেকে করোনা ভ্যাকসিন দিয়েই অভিবাসী বাংলাদেশিদের মালয়েশিয়ায় প্রবেশের সুযোগ পাবেন। মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী দাতুক শ্রী সারাভানান মুরুগান গত ১৯শে মে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীকে এক জরুরি চিঠিতে এ বিষয়টি অবহিত করেছেন।

একইভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ইতালি, সিঙ্গাপুর, ওমান প্রবেশেও। এতে আটকে পড়া প্রবাসী কর্মীদের অনেকেই ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায় চাকরি ঝুঁকিতে রয়েছেন। ফলে দেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা করছেন জনশক্তি ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ডিভিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জনশক্তি রপ্তানিতে ইন্ডিয়া, মেক্সিকো, চীন, রাশিয়া এবং সিরিয়ার পরই বাংলাদেশের অবস্থান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ৮০ লাখের বেশি কর্মী কাজ করতেন। যার অর্ধেকের বেশি   সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন এবং ওমানে অবস্থান করছেন। গালফ লেবার মার্কেটস অ্যান্ড মাইগ্রেশনের তথ্য অনুযায়ী শুধু মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলোতে ৪২ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন। করোনাভাইরাসের কারণে এসব দেশগুলোতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। এতে বিপুল সংখ্যক কর্মী কাজ হারিয়ে দেশে ফেরত এসেছে। নতুন করে এসব দেশে ঢুকতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন প্রবাসীরা।

বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা)-এর সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান মানবজমিনকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমবাজার বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন দেশ তাদের দেশের জনগণকে সুরক্ষা ও নিরাপদ রাখার জন্য আমাদের দেশসহ বহু দেশের কর্মী নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। তবে আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ কমে গেলেও প্রবাসীদেরকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হলে এমনটি হতো না। এখন যেসব দেশে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তাতেও প্রবাসী কর্মীদেরকে খরচের বাড়তি চাপ মাথায় নিয়ে যেতে হয়। সরকার দেশেই কর্মীদেরকে কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করে তারপর বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করলে বাড়তি খরচ হতো না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে। তাহলে আমাদের শ্রমিকরা তাদের কর্মস্থলে ফিরতে পারবে। এ ছাড়া সবাইকে দ্রুত ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হলে শ্রমবাজারের পথ উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, অনেকেই রেমিট্যান্স নিয়ে কথা বলেন। বাস্তবে  রেমিট্যান্সের সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানির কোনো সম্পর্ক নেই। যারা প্রবাসে থাকেন, তারা রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্যই বিদেশ গেছেন। ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশি কর্মীরা কাজ করেন। তার মধ্যে ১২ থেকে ১৫টি দেশে বিপুল সংখ্যক কর্মী আছেন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বেশি। চলমান নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেকেই কর্মস্থলে যেতে পারছেন না। এই বিষয়ে তাদেরকে দ্রুত কর্মস্থলে ফেরাতে সরকারকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। তাহলেই শ্রমবাজার টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। -মানবজমিন


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন