ফিচার্ড মত-মতান্তর

সংখ্যালঘু যে দেশে নিরাপদ নয় সে দেশ সভ্য নয়

তসলিমা নাসরিন

সংখ্যালঘু যে দেশে নিরাপদ নয় সে দেশ সভ্য নয়

তসলিমা নাসরিন | অনেকে বলছেন শাহরুখ খানকে টার্গেট করা হয়েছে, টার্গেট করা হয়েছে বলেই পুত্র আরিয়ান খানকে হেনস্থা করা হচ্ছে। আরিয়ানের পক্ষে যে আইনজীবী লড়ছেন, বলেছেন, আরিয়ানের কাছে কোনও মাদক পাওয়া যায়নি, তবে তার ফোনের চ্যাটে মাদকদ্রব্য নিয়ে যা লেখালেখি পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতেই আরিয়ানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের যে লোকটি আরিয়ানকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য আরিয়ানদের রেভ পার্টিতে ছদ্মবেশে ঢুকেছিলেন, তিনিই এর আগে শুল্ক বিভাগে চাকরিরত অবস্থায় শাহরুখ খানকে বিমানবন্দরে একবার আটকেছিলেন, শাহরুখের জিনিসপত্রের ওপর বড় অঙ্কের কর চাপিয়েছিলেন। এই দুই ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র নাও থাকতে পারে। সমীর ওয়াংখেড় হয়তো সৎ অফিসারের দায়িত্ব পালনই করেছেন। কিন্তু সংশয় জাগে আরিয়ানের কাছে মাদক পাওয়া যায়নি, আরিয়ান বড় কোনও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয়, তারপরও তাকে দিনের পর দিন রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে এবং এখনও জামিন দেওয়া হচ্ছে না দেখে। এ কারণে শাহরুখকেও নামিদামি বেশ কিছু বিজ্ঞাপন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কেন শাহরুখকে টার্গেট করা হয়েছে, তিনি বিরাট ধনী বলে,

বিরাট জনপ্রিয় বলে? নাকি তিনি মুসলিম বলে? টুইটার-ফেসবুকে লক্ষ করছি, শাহরুখের নিন্দে যারা করছে, তারা চরম ডানপন্থি গোষ্ঠীর লোক, এদের অধিকাংশই মুসলিম-বিরোধী। শাহরুখ নিঃসন্দেহে ধর্মনিরপেক্ষ একজন মানুষ। তিনি একটি হিন্দু মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন, এবং স্ত্রী গৌরী তাঁর পুজো শাহরুখের বাড়ি মান্নাতেই করেন।

শাহরুখের এই ঘটনা আমাকে মনে করিয়ে দিল ষাটের দশকের গোড়ার দিকে তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা দিলীপ কুমারকেও একসময় টার্গেট করা হয়েছিল। এক পাকিস্তানি গুপ্তচরকে কলকাতায় গ্রেফতার করা হয়েছিল, তার ডায়রিতে বেশ কিছু নাম পাওয়া গিয়েছিল, সেই নামের মধ্যে দিলীপ কুমারের নাম ছিল। তখন কংগ্রেসের রাজত্ব। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর হিরো ছিলেন দিলীপ কুমার। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতে দিলীপ কুমার ছিলেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক। কিন্তু তারপরও দিলীপ কুমারের বাড়ি ঠিকই তল্লাশি চলে। একটি রেডিও ট্রান্সমিটার মেলে তাঁর বাড়িতে, যেটির সাহায্যে তিনি পাকিস্তানের গান-বাজনা শুনতেন। সেটির দোহাই দিয়ে দিলীপ কুমারকে জেলে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, তিনি পাকিস্তানের গুপ্তচর ছিলেন তার কোনও প্রমাণ না মেলার পরও। উনিশ’শ আটানব্বই সালে পাকিস্তান থেকে সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান নিশান-ই-ইমতিয়াজ পাওয়ার পরও শিব সেনা দলের নেতা বাল থেকারে দিলীপ কুমারের বিরুদ্ধে খুব অপমানজনক কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন দিলীপ কুমার যেন ওই পদক ফেরত দেন, আর তা না হলে ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান। বিজেপির প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী তখন দিলীপ কুমারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, বলেছিলেন শিল্পী দেশ কালের ঊর্ধ্বে, তাঁরা যে কোনও দেশ থেকেই সম্মান গ্রহণ করবেন। বলেছিলেন, ভারতের জন্য দিলীপ কুমারের ত্যাগ এবং দেশপ্রেম নিয়ে কোনও প্রশ্ন চলতে পারে না।

আজও দিলীপ কুমারের প্রসঙ্গ উঠলে, শাহরুখ খানের নিন্দে যারা করছে তারাই দিলীপ কুমারের নিন্দে করে। বলে, দিলীপ কুমার পাকিস্তানের গুপ্তচর ছিলেন, সে কারণে তাঁকে নিশান-ই-ইমতিয়াজ দেওয়া হয়েছে। দিলীপ কুমার বলিউডের কিংবদন্তী অভিনেতা ছিলেন, তাঁর প্রতিভার ধারে কাছে কেউ আসতে পারেননি, বলিউডকে মূলত গড়ে দিয়েছেন দিলীপ কুমার এবং তাঁর সমসাময়িক কিছু শিল্পী। এর মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। মীনা কুমারী, মধুবালা, নার্গিস, নিম্মি, ওয়াহিদা রেহমান, পরিচালক মেহবুব খান, কে আসিফ, সঙ্গীত পরিচালক নওশাদ, কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ রফি এরকম অনেকে।

তাছাড়া দিলীপ কুমার দেশের সেবামূলক কাজে অঢেল দান করে গেছেন, ভারতের আর্ত-নিপীড়িতের জন্য তাঁর দরজা সবসময় খোলা ছিল। ধর্ম বর্ণ জাত নির্বিশেষে তিনি দান করতেন। তারপরও তাঁর নিন্দে করা হয়। কেন? তিনি ইউসুফ খান বলে। কিছু মুসলিম-বিরোধী হিন্দু কোনও খানকেই হয়তো রেহাই দেবে না।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের সংকটও কম নয়। বত্রিশ হাজার একশ’ আঠারোটি পূজামণ্ডপ হয়েছে এ বছর কিন্তু প্রতিটি পূজামণ্ডপে পুলিশ নিয়োগ করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মীয় উৎসবে তো এত নিরাপত্তা রক্ষীর দরকার হয় না! আমরা জানি কেন হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব নিয়ে ভয় হয় সবার। কারণ হিন্দু-বিরোধী মুসলমান মৌলবাদীরা হিন্দুদের প্রতিমার ওপর হামলা চালায়। তারা মন্দির ভেঙে দেয়, মণ্ডপ গুঁড়িয়ে দেয়। হিন্দুদের এমনভাবে অত্যাচার করে, এমন হুমকি দেয়, যেন তারা ভয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায়, আর সন্ত্রাসীরা হেসে খেলে দখল করে নেয় হিন্দুর সম্পত্তি। অনেক হিন্দুই নিজের নিরাপত্তার অভাবে চলেই গেছে দেশ ছেড়ে। বাকি যারা পড়ে আছে তারাও হয়তো এক সময় দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশের পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন মুসলিম জঙ্গিরা পূজামণ্ডপে হামলা করার ষড়যন্ত্র করেছে। এই খবর শোনার পর হিন্দুরা কি ঝুঁকি নেবে মণ্ডপে যাওয়ার? তারা বরং আতঙ্কে ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে থেকে বাঁচার চেয়ে দেশ ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করবে। আমাদের তো ভুলে যাওয়ার কথা নয় রসরাজ, টিটু রায় আর হালের ঝুমন দাসের কাহিনী। সরকার কোথায় হিন্দুদের নিরাপত্তা দেবে, উল্টে সরকার পক্ষের দলই হিন্দুদের জমিজমা অবৈধভাবে আত্মসাৎ করার জন্য ওত পেতে থাকে।

কিছুদিন আগে আফগানিস্তানের শিয়া মসজিদে বোমা হামলা করে পঞ্চাশেরও বেশি নামাজরত শিয়াকে খুন করেছে সুন্নি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এরা সংখ্যালঘু হাজারাদের ওপরও নির্যাতন চালায়। পাকিস্তানেও শিয়া, আহমদিয়া, হিন্দু, খ্রিস্টান সংখ্যালঘুরা বহুকাল থেকেই সুন্নি সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের শিকার। তারাও সুযোগ পেলে দেশ ত্যাগ ক’রে নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। কিন্তু সবার পক্ষে তো দেশ ত্যাগ করা সম্ভব নয়। সংখ্যালঘুদের অধিকাংশই দরিদ্র। অবশ্য সংখ্যালঘু ধনী হলেও নির্যাতনের কমতি হয় না। কাশ্মীরে বাস করতেন কাশ্মীরের ধনী গোষ্ঠী কাশ্মীরী পণ্ডিত। কাশ্মীরের মুসলমান মৌলবাদীরা এই হিন্দু পণ্ডিত সম্প্রদায়কে নিজ বাসভূমি থেকে উৎখাত করেছে নব্বই দশকে। কিছু পণ্ডিত ফিরে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন কাশ্মীরে। কাশ্মীরের উদারপন্থি মুসলমানেরা তাঁদের স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু কাশ্মীরের সুন্নি সন্ত্রাসীদের উৎপাতে সংখ্যালঘু হিন্দু পণ্ডিতরা আতঙ্কে আবারও কাশ্মীর থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কাশ্মীর ভারতের অংশ হলেও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিন্দু হলেও, কাশ্মীরে তারা নিরাপদ নয়, কারণ কাশ্মীরে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পূর্ব বাংলা থেকে পূর্ব পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ-এই অঞ্চলে হিন্দুরা সংখ্যালঘু, অধিকাংশ মুসলমান যদিও হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে, কিন্তু হিন্দুর ওপর অত্যাচার করতে দ্বিধা করেনি। এই অত্যাচারের কারণেই হিন্দুরা যুগে যুগে পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ত্যাগ করেছে, আজও করছে। ভারতের গুজরাটে পরিকল্পিত মুসলমান নিধন চলেছিল। হাজারো মুসলমান উদ্বাস্তু হয়েছিল। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করি গুজরাটের মুসলমানেরা পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ত্যাগ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে দলে দলে আশ্রয় নেয়নি। এর কারণ সম্ভবত ভারতের গণতন্ত্রের মান অন্যান্য মুসলিম দেশের তুলনায় ভালো। একজন মুসলমান হিন্দুর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আদালতে যেতে পারেন। আদালতে তিনি ন্যায়বিচার পেতেও পারেন। এরকম কিছু পাকিস্তানে, আফগানিস্তানে কল্পনা করা যায় না।

উপমহাদেশের একটি দেশও সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ নয়। বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর কোথাও সংখ্যালঘুদের অধিকার সংখ্যাগরিষ্ঠের সমান নয়। সব খানেই তারা অবহেলিত, অসম্মানিত, কোথাও কোথাও আবার অত্যাচারিত এবং নির্যাতিত। আমি তো ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড-এসব দেশ ছাড়া আর কোনও দেশেই সংখ্যালঘুদের একশ’ ভাগ নিরাপত্তা দেখি না। এসব দেশেও যে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার হয় না, তা নয়। মাঝে মাঝে হয়, তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় নিঃসন্দেহে অনেক কম।

আমি জোর গলায় বলি, সংখ্যালঘুরা যে দেশে নিরাপদ নয়, সে দেশ সভ্য নয়। অর্থনীতির উন্নতি, গণতন্ত্রের উন্নতি, রাজনীতির উন্নতি- যত উন্নতি এবং উন্নয়নই ঘটুক না কেন, সংখ্যালঘুদের সমান অধিকার এবং স্বাধীনতা ব্যাহত হলে কোনও দেশকে সত্যিকার সভ্য বলা যায় না। কোন দেশ কতটা সভ্য তা বিচার করতে হলে দেখতে হয় সে দেশের নারীরা এবং সংখ্যালঘুরা সমান অধিকার পাচ্ছে কিনা, যথেষ্ট নিরাপত্তা পাচ্ছে কি না।

সভ্য দেশ গড়তে হলে শিক্ষার উন্নতি সবার আগে দরকার। যে শিক্ষা মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শেখায়, সে মানুষ যে কোনও ধর্মে এবং আদর্শে বিশ্বাসী হোক, যে কোনও জাতের, বর্ণের, সম্প্রদায়ের হোক, যে কোনও লিঙ্গের হোক, এমনকী সমকামী বা রূপান্তরকামী হোক- কোনও ফারাক পড়বে না। যে শিক্ষা দরিদ্রকে অসম্মান করা, আর ধনীকে সম্মান করা শেখায় না, যে শিক্ষা কাউকে হিংসে করতে বা ঘৃণা করতে, বা কাউকে নির্যাতন করতে শেখায় না, যে শিক্ষা উদার হতে শেখায়, মহান হতে শেখায়- সেই শিক্ষারই অভাব আমাদের উপমহাদেশে। তাই দেখি মুসলমান হিন্দুকে ঘৃণা করছে, হিন্দু মুসলমানকে ঘৃণা করছে। এই ঘৃণা মানুষকে সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি করতে দেবে না। এই ঘৃণা শেষ অবধি সবাইকে ধ্বংস করবে। পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই আমাদের সামনে জাতি হিসেবে উন্নতি করার, মানুষ হিসেবে মহান হওয়ার। ধর্মান্ধতা কোনও সমাধান নয়, ধর্মনিরপেক্ষতাই সমাধান।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

 

এসএস/সিএ


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন