দেশের সংবাদ ফিচার্ড

সর্বজনীন পেনশনের টাকা কোথায় বিনিয়োগ হবে?

সর্বজনীন-পেনশনের-টাকা-কোথায়-বিনিয়োগ-হবে

সর্বজনীন পেনশনের টাকা কোথায় বিনিয়োগ হবে?

সর্বস্তরের জনগণকে টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে দেশে প্রাথমিকভাবে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা- এই চার ক্যাটাগরিতে সর্বজনীন পেনশন চালু হয়েছে। ১০ কোটি মানুষকে এই সুবিধা দেয়ার চিন্তা মাথায় রেখে স্কিমটি চালু করা হয়।

আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হওয়ার পর এনিয়ে একদিকে মানুষের মাঝে যেমন ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্যদিকে এটা কতোটা কার্যকর এবং ঝামেলামুক্ত হবে সেই প্রশ্নও করছেন অনেকে। এ ছাড়া পেনশনের মাধ্যমে পাওয়া অর্থ কোথায় বিনিয়োগ হবে সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। পাশাপাশি কোটি কোটি মানুষের নামে পৃথক হিসাব খোলা, সেটি স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করা হবে কিনা, ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত কিস্তি দিয়ে কোনো ঝামেলা ছাড়াই পেনশন পাওয়া যাবে কিনা সেই সংশয়ে আছেন অনেক গ্রাহক। সবশেষ এই স্কিমে অন্তর্ভুক্তির জন্য এ পর্যন্ত আবেদন পড়েছে প্রায় ৫০ হাজার। পেনশনের আওতায় আসা ব্যক্তিরা তিন কোটি টাকার উপরে চাঁদা জমা দিয়েছেন।

নিয়মানুযায়ী কারও বয়স ১৮ বছর থেকে ৫০ বছরের মধ্যে হলে অনলাইনে এই স্কিমে নিবন্ধনের সুযোগ পাবেন। সুবিধাভোগীর বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি হওয়ার পর আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। এ ছাড়া ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সীরা ন্যূনতম ১০ বছর পর্যন্ত চাঁদা দেয়া সাপেক্ষে এই সুবিধা পেতে পারেন। পেনশনের বিস্তারিত নিয়মকানুন সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েব সাইটে দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা পাওয়ার বিষয়ে এখনো নেতিবাচক মনোভাব আছে।

বিশেষ করে সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনের টাকা নিয়ে হয়রানির উদাহরণ ভূরি ভূরি রয়েছে। নতুন পেনশন স্কিমে সেই দুর্ভোগের পুনরাবৃত্তি হয় কিনা, সেই চিন্তায় আছেন অনেকেই। এ কারণে, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এখনো নিজের নামে স্কিমটি চালু করার সাহস করছেন না সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া পেনশনের টাকা তোলার জন্য সরকারি অফিসে ছুটতে ছুটতে আর ঘুষ দিতে দিতে আসল টাকাটাই থাকবে না- এমন বক্তব্যও কেউ কেউ দিচ্ছেন। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, ভোগান্তি যাতে না হয় সেই ব্যবস্থা তারা করেছেন।

এ বিষয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, পেনশন পেতে দীর্ঘসূত্রতা বা হয়রানির কোনো সুযোগ নেই, কারণ সব গ্রাহকদের থেকে কিস্তি সংগ্রহ এবং পেনশন দেয়ার সম্পূর্ণ লেনদেন অনলাইনে সম্পন্ন হবে। সেটাও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। কিস্তি দাতার বয়স ৬০ বছর হওয়ার পর তার ব্যাংক হিসাবে অথবা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে মাসিক পেনশন পৌঁছে যাবে বলে জানিয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে গ্রাহক তার ইউনিক পেনশন আইডি দিয়ে প্রবেশ করে বছর শেষে মুনাফাসহ জমা হওয়া টাকার পরিমাণ জানতে পারবেন। এ ছাড়া পেনশন তহবিলে সুবিধাভোগীদের যে অর্থ জমা হবে, সেখান থেকে কোনো অর্থ সরানো হবে না, এমনকি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের যাবতীয় পরিচালন ব্যয় সরকারের আলাদা বরাদ্দ থেকে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এই স্কিমটি মূলত প্রবাসী বাংলাদেশি, বেসরকারি চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং স্বল্প আয়ের বিশাল জনগোষ্ঠীকে আর্থিক নিরাপত্তা দিতে চালু করেছে সরকার। আগ্রহীরা অনলাইনে নিবন্ধন করলেই পেনশন স্কিম চালু করতে পারবেন। এ জন্য কোনো সরকারি অফিসে কাগজপত্র জমা দেয়ার প্রয়োজন হবে না। শুধু অনলাইনে নিবন্ধন করে অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মাসিক টাকা জমা দিলেই হবে।

পেনশন তহবিলের টাকা বিনিয়োগ হবে কোথায়?

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, স্কিমটি চালু হওয়ার পর আবেদন জমা পড়েছে ৫০ হাজারের মতো। তবে সুবিধাভোগীরা কিস্তি বাবদ যে অর্থ দেবে সেটার তহবিল ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, কীভাবে এবং কোথায় পেনশন তহবিল বিনিয়োগ হবে, লভ্যাংশ কীভাবে বণ্টন করা হবে, সেগুলো নিয়ে অস্পষ্টতার মধ্যে থাকার কথা জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।

জানা গেছে, পেনশনের আওতায় আসাদের জমা দেয়া এই চাঁদা ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ খাতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে এই টাকা কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করা হবে, তা এখনো ঠিক করা হয়নি। এ লক্ষ্যে একটি বিনিয়োগ নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এই নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। নীতিমালা তৈরি হয়ে গেলে সেই অনুযায়ী পেনশন স্কিমের টাকা বিনিয়োগ করা হবে।

এ বিষয়ে আলাদা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধিমালা তৈরি হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। বলা হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে এই তহবিল সরকারি বন্ড বা ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগের কথা রয়েছে। যেসব বিনিয়োগে ঝুঁকি কম সেদিকেই যাবে কর্তৃপক্ষ। যদি ফান্ড আরও বড় হয় তাহলে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হতে পারে। এটা সময়ের পরিক্রমায় হবে। এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা তৈরি হচ্ছে, সেই মোতাবেক কাজ হবে। বিধিমালাটি প্রক্রিয়াধীন আছে।

তবে এই পেনশন তহবিলের অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। অতীতে সরকারি বা আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের তহবিলের অর্থ অব্যবস্থাপনার নজির রয়েছে। তাই যারা সুবিধাভোগীর টাকা বিনিয়োগ করবেন, তাদের স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। বিনিয়োগগুলো এমন জায়গায় করতে হবে যেখানে ঝুঁকি কম কিন্তু ভালো রিটার্ন আসবে। সঠিকভাবে বিনিয়োগ করতে পারলে এ পেনশন তহবিল থেকে যা আয় হবে তা দিয়েই মাসিক পেনশন দেয়া সম্ভব। তার জন্য প্রয়োজন সতর্কতা এবং সুশাসন। নতুন এই পেনশন স্কিমে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র সোনালী ব্যাংককে লেনদেনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রাহকরা যেন নিজ নিজ ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্ট ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, উদ্যোগটা (সর্বজনীন পেনশন) প্রশংসনীয়। তবে কথা হচ্ছে কাভারেজ কতোটুকু হয়। কেননা, যারা ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করে তারা কি প্রিমিয়াম দিতে পারবে? প্রিমিয়াম দিতে না পারলে এর আওতায় আসতে পারবে না। তারপর এই ফান্ড ফাইন্যান্সিং হয়, নাকি এখানে আবার সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। এসব কতোগুলো বিষয় আছে। ফান্ডের টাকা কোথায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সুষ্ঠু বিনিয়োগ করে যাতে ফান্ডটা সেভ ফাইন্যান্সিং হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বিনিয়োগটা যাতে লাভজনক হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিনিয়োগ থেকে যেন অবশ্যই ভালো রিটার্ন পাওয়া যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সরকার মোট ৬টি স্কিমের কথা ঘোষণা করেছে। তবে আপাতত চালু হয়েছে চারটি স্কিম। এগুলোর নাম দেয়া হয়েছে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা।

প্রবাস: এটি শুধু বিদেশে কর্মরত বা অবস্থানকারী বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য। এর মাসিক চাঁদার হার ধরা হয়েছে ৫ হাজার, সাড়ে ৭ হাজার ও ১০ হাজার টাকা করে। ব্যক্তি চাইলে এই চাঁদার সমপরিমাণ অর্থ তিনি যে দেশে আছেন সে দেশের মুদ্রায় দিতে পারবেন। আবার দেশে এসে দেশীয় মুদ্রাতেও দিতে পারবেন। এ ছাড়া প্রয়োজনে প্রবাস স্কিম পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকছে।

প্রগতি: এই স্কিম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য। এক্ষেত্রেও তিন ভাগে চাঁদার হার ভাগ করা হয়েছে। কেউ চাইলে মাসে ২ হাজার, ৩ হাজার বা ৫ হাজার টাকা করে দিয়ে এই স্কিমে অংশ নিতে পারবে। আবার প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের মালিকও প্রগতি স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে মোট চাঁদার অর্ধেক কর্মচারী এবং বাকি অর্ধেক প্রতিষ্ঠান বহন করবে।

সুরক্ষা: এই স্কিমটা স্বনির্ভর ব্যক্তির জন্য। অর্থাৎ কেউ কোথাও চাকরি করছেন না কিন্তু নিজে উপার্জন করতে পারেন, তারা সুরক্ষা স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। এর আওতায় পড়েন ফ্রিল্যান্সার, কৃষক, শ্রমিক ইত্যাদি পেশার লোকজন। এই স্কিমে চাঁদার হার চার রকম- মাসে এক হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার ও পাঁচ হাজার টাকা করে।

সমতা: এই স্কিমে চাঁদার হার একটিই এক হাজার টাকা। তবে এক্ষেত্রে প্রতিমাসে ব্যক্তি দেবে পাঁচশ টাকা আর বাকি পাঁচশ’ দেবে সরকার। মূলত দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসরত স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এই স্কিম। এক্ষেত্রে দারিদ্রসীমা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। যেমন বর্তমানে বছরে যাদের আয় এখন বছরে ৬০ হাজার টাকার মধ্যে তারাই কেবল এই স্কিমের অন্তর্ভুক্ত হবেন।

সূত্রঃ মানবজমিন

এফএইচ/বিডি
সংবাদটি শেয়ার করুন