মত-মতান্তর

সাকিব যে ভুল করলেন

সাকিব যে ভুল করলেন

সাকিব যে ভুল করলেন

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার একটি কালীপূজার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বড় অস্বস্তিতে পড়েছেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান। সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছুদিন ধরে তাকে নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছিল। কিন্তু এবার ফেসবুকে খুনের হুমকি পেলেন সাকিব। রোববার রাতে সিলেটের এক যুবক হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ফেসবুক লাইভে সাকিবকে হত্যা করার কথা ঘোষণা করে। এর পরই সাকিব নিজে ফেসবুকে এসে পূজায় যাওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।

সাকিব আল হাসান পূজায় গিয়ে কোনো ভুল করেননি। কিন্তু মাফ চেয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করলেন বলেই মনে হচ্ছে। যে ছেলেটি হত্যার হুমকি দিয়েছে, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে আজ (১৭ নভেম্বর), আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু সাকিবের মতো একজন তারকা খেলোয়াড় যদি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রটোকলের ভেতরে থেকে এমন এক সামান্য হুমকিতে আত্মসমর্পণ করে, তাহলে সাধারণ মানুষের যাওয়ার জায়গা কোথায়? বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাকিব নিজেকে শেষ পর্যন্ত শুধু মুসলমানই ভাবলেন, তিনি যে সবার ওপরে  মানুষ এই সত্যটি ভাবার সাহস দেখালেন না।

তবে এই ঘটনা এক ভয়াবহ পরিস্থিতিও আমাদের সামনে তুলে ধরে। শুধু সিলেটের সেই যুবক নয়, অতি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষজনও কতটা সাম্প্রদায়িক মনোভাবের হয়, তার নমুনা ফেসবুক আর ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে। আমরা জানি না সমাজের পরতে পরতে সাম্প্রদায়িকতার যে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, সে আগুন আর কোনো দিন নেভানো সম্ভব কি না।

বিষবৃক্ষ বাড়ছে রকেট গতিতে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে এই বিষ। খুব অবাক হতে হয়, যখন দেখি প্রোফাইলে বঙ্গবন্ধুর ছবি, কিংবা নিজেকে পরিচয় দিচ্ছে উদারনৈতিক হিসেবে, অথবা কিছুকাল আগেও যাদের কথা শুনে তাদের ভাবনাচিন্তা আমাদের আলোড়িত করত, তাদের অনেকেও আজ হঠাৎ কেমন কেমন কথা বলেন। তাই ভয় অনেক বেশি। ঘোরতর অন্ধকারের দিকে এই যে আমাদের যাত্রা, সেখান থেকে ফেরার মতো রাজনীতি কোথায়?

খেয়াল করলেই বোঝা যায়, যারা সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে, যারা উদারনৈতিক লোকদের হুমকি দিচ্ছে, এরা মূলত মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। আজগুবি তথ্যে ভরা ভিডিও আর গল্প ছড়িয়ে দিচ্ছে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য। অতি সামান্য কাজকর্মকেও তারা ধর্মের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণের চেষ্টা করছে। রাজনীতিসহ সমাজের অতি স্বাভাবিক সব পরিসরে কট্টরভাবে ধর্মকে টেনে আনার প্রচেষ্টা সর্বত্র। এভাবে ক্রমাগত মিথ্যায় সত্যের মহিমা যেন ক্রমে ম্লান হয়ে আসছে।

সাম্প্রদায়িক দুর্বুদ্ধির মোকাবিলায় অনেক তত্ত্ব পেশ করে থাকি আমরা, অনেক তর্ক তুলি। আমরা প্রথমেই যে ভুলটা করি সেটা হলো এদের মোকাবিলা করতে গিয়ে আমরা নিজেরাও কতটা ধার্মিক সেই যুক্তি তুলে ধরি, যেমনটা করেছেন সাকিব আল হাসান। এখান থেকেই আদতে এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রতি প্রশ্রয়ের বান ছোটে। কোথায় আমরা তাদের পাল্টা চ্যালেঞ্জ করব তা নয়, আমাদের কণ্ঠে যেন কৈফিয়তের সুর। আমরা আমাদের মৌলিক রেটরিক, যে রেটরিক নির্ধারিত হয়ে গেছে ১৯৭১ সালেই, সেখানে আমরা স্থির না থেকে যেন পরাজিত শক্তির রেটরিককে ধারণ করে পাল্টা যুক্তি দিচ্ছি কৈফিয়তের মতো করে।

সাকিব যা করেছেন, এমনটা করেন অনেক আলোকিত মানুষও। তারা তর্ক করতে যান মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির সুরকে ধার করে। এতে করে সমাজে যে গল্প সৃষ্টি হয়, তা বহু মানুষের মনকে ছুঁয়ে যায় না, বরং তারুণ্যকে বিভ্রান্ত করে। সাহস করে এদের তিরস্কার করতে না পারলে সমাজে নতুন আলো তো জ্বালানো হবেই না, পুরোনো আলোও নিভে যাবে। অনন্ত তত্ত্ব এবং তর্ক সমাজকে কোনো সম্ভাবনার পথ দেখাবে না। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন, আর তা হলো ওদের মতের কাছে আত্মসমর্পণ করে কোনো কালেই আমরা মহৎ হয়ে উঠতে পারব না। আমাদের স্বাভাবিকতাই আমাদের সম্ভাবনা।

এ রকম চলতে থাকলে হয়তো আমাদের শুনতে হবে লালমনিরহাটে মসজিদের ভেতর একজন মানুষকে পিটিয়ে পুড়িয়ে মারা বা কুমিল্লার মুরাদনগরে হিন্দু বসতিতে আগুন আর লুটপাটের ঘটনায় কোনো সাম্প্রদায়িক বিষয় নেই। এই শক্তি যখন-তখন আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারে, এদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার নজিরও কমে আসছে।

ক্রীড়া, শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরে যারা সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনছে, তাদের রাজনীতি আছে। তারা রাজনৈতিক ফসল ঘরে তুলতে বিশাল আর্থিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। তারা খুব পরিকল্পিতভাবে সমাজের স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানকে ধ্বংস করে চলেছে। তাদের প্রতিহত করতে হলে অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে কৈফিয়তের সুরে কথা বললে চলবে না। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কেবল নাগরিক সমাজের বিষয় নয়, নিয়ে যেতে হবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যা করছে সহিংস সাম্প্রদায়িক শক্তি। যে জীবনতত্ত্ব, স্লোগান ছিল আমাদের একাত্তরে, ‘যে দেশ আমরা পেয়েছি, ইতিহাসের চড়াই-উতরাই পার করেছে। সেই অজস্র গল্প নিয়ে আবার নামতে হবে মাঠে।

একমাত্র সে পথেই উগ্রতা ও সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করে আমাদের জীবনকে আবার অপার মনুষ্যত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারব আমরা। একাত্তরে যেমন গুটিকয়েক রাজাকার ছাড়া সবাই মিলে বেঁচেছিলাম, আবার সেভাবে বাঁচার পথ খোঁজার এখনই সময়। সাম্প্রদায়িক চিন্তামুক্ত রাজনীতিই পারে সেই পথে আমাদের ফেরত নিতে।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্রঃ সারাক্ষণ

 

এসএস/সিএ



সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন