লেখালেখি

সৌদি আরবের কাছে বাংলাদেশের শেখার আছে ||| তসলিমা নাসরিন

সৌদি আরবের
তসলিমা নাসরিন

সৌদি আরবের কাছে বাংলাদেশের শেখার আছে ||| তসলিমা নাসরিন

১. জামায়াতে ইসলামী দলটি গঠিত হয়েছিল মুসলিম ব্রাদারহুড দলের আদর্শে। আজ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত সবখানে টিকে আছে, কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ হচ্ছে। এ দলটি মিসরে তৈরি হয়েছিল ১৯২৮ সালে। মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী আন্দোলন করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছানোর জন্য সমাজ সেবামূলক কাজ করার ব্রত নিয়ে নেমেছিল এই দলটি। দেশে দেশে দলটি এবং দলের আদর্শ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই মিসরে স্বৈরাচারী একনায়ক মোবারককে সরিয়ে দেওয়ার পর ক্ষমতায় এসেছিল মুসলিম ব্রাদারহুড। কিন্তু বেশি দিনের জন্য ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয়নি। মিসরের রাষ্ট্রপতি আব্দেল ফাতাহ আল-সিসি এই দলকে সন্ত্রাসী দল আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। মুসলিম ব্রাদারহুড মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতেই নিষিদ্ধ। জর্দান, সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত, মিসর, সিরিয়া, রাশিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান এই দেশগুলোও নিষিদ্ধ করেছে মুসলিম ব্রাদারহুডকে।

সম্প্রতি সৌদি আরব মক্কার মসজিদগুলোর ১০০ ইমাম এবং ইসলাম প্রচারককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে। ওঁদের দোষ কী ছিল? দোষ ছিল ২০১৪ সালে নিষিদ্ধ হওয়া মুসলিম ব্রাদারহুডের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সম্পর্কে জনতাকে জানানোর সরকারি নির্দেশ তাঁরা মান্য করেননি। তাঁরা প্রচার করেননি ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠী মুসলিম ব্রাদারহুড ইসলামের শিক্ষা মেনে চলে না। সৌদি আরবের কেন এত রাগ মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর। এরও কাহিনী আছে। পাঁচের দশকে মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মীরা যখন মিসরে, সিরিয়ায়, ইরাকে এবং অন্যান্য দেশে মার খাচ্ছিল, তাদের ধরে ধরে জেলে ভরছিল ওইসব দেশের সরকার, তখন সৌদি আরব হাজারো ব্রাদারহুড কর্মীকে আশ্রয় দিয়েছিল। আশ্রিত দলটি ধীরে ধীরে সৌদি যুবসমাজে জনপ্রিয় করতে লাগলো নিজেদের। সৌদি আরবের মাটিতে মার্কিন মিলিটারির অবস্থানের বিরোধিতা করতে লাগলো। সৌদি জনতাকে কট্টর ইসলামপন্থি বানাতে লাগলো। সৌদি আরব তা মেনে নেয়নি, দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের স্বার্থ রক্ষা করছে আমেরিকা। আর মুসলিম ব্রাদারহুড কিনা সৌদি আরবে বসে সৌদি আরবের স্বার্থবিরোধী সন্ত্রাসী দল গড়ে তুলছে, এ হতে দেয়নি সৌদি সরকার। আজ ইসলামী সন্ত্রাসী দলগুলোর ক্ষোভ কিন্তু মূলত আমেরিকার বিরুদ্ধে। সকলে মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শ অন্তরে লালন করে।

২. লক্ষ করছি জিহাদি দলগুলোর বিরুদ্ধে মুসলিম দেশ যেভাবে দাঁড়াতে পারে, পাশ্চাত্যের উদারপন্থি দেশগুলো সেভাবে দাঁড়াতে পারে না। এই তো সেদিন সিরিয়ার

জিহাদি আইসিস ক্যাম্প থেকে জার্মানি আর ফিনল্যান্ড কিছু মেয়ে ও শিশুকে দেশে ফেরত নিয়ে এলো। এই মেয়েগুলো কিন্তু আইসিস জঙ্গিরা কোথাও থেকে ধরে আনেনি, ইয়াজিদি মেয়েদের যেমন এনেছিল। এদের জোর করে জিহাদি বানানো হয়নি। এরা স্বেচ্ছায় সব জেনে বুঝে, জিহাদি আদর্শে দীক্ষা নেওয়ার পর জঙ্গি হওয়ার সংকল্প নিয়ে সিরিয়ায় গিয়েছিল জিহাদে জীবন উৎসর্গ করতে। এই মেয়েরাও আইসিসের পুরুষদের মতো জিহাদি। মনে আছে শামীমার কথা, ১৫ বছর বয়সে লন্ডন থেকে চলে এসেছিল সিরিয়ায় আইসিসের খাতায় নাম লেখাতে, জিহাদি পুরুষদের যৌনসঙ্গী হতে, যেন যৌনজীবনে তৃপ্ত হয়ে পুরুষগুলো ঠান্ডা মাথায় জিহাদ করতে পারে, ধ্বংস করতে পারে প্রাচীন স্থাপত্য, বিধর্মীদের হত্যা করতে পারে। বাংলাদেশি বাবা-মা’র সন্তান শামীমা বলেছিল এইসব বিধর্মী হত্যায় সে বিশ্বাস করে এবং রাস্তার ডাস্টবিনে বিধর্মীদের কাটা মু-ু দেখতে তার এতটুকু খারাপ লাগে না, বরং ভালো লাগে। সেই শামীমা আইসিসের পতনের পর লন্ডনে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে, তাকে ফেরানোর জন্য ইউরোপের মানবাধিকারকর্মীরা লড়ছেন। আমি বুঝি না জিহাদি পুরুষ এবং নারীতে পার্থক্য কোথায়? কোনও জিহাদি নারীকে অস্ত্র হাতে খুন করতে দেখা যায়নি বলে? কিন্তু ওরা তো খুন করতে জানে, ওরা মগজ ধোলাই করতেও জানে। তাহলে ওদের ক্ষতিকর মনে করা হচ্ছে না কেন? এত জিহাদি সন্ত্রাসের শিকার হয়েও ইউরোপের শিক্ষা হয়নি। জার্মানি বোধহয় মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বিশ্বের এক নম্বর হওয়ার পণ করেছে। ১০ লাখ সিরিয়ার শরণার্থীকে তো আশ্রয় দিয়েছে জার্মানি। ভেবেছিল এরা বুঝি আইসিসের ভয়ে পালিয়েছে। একেবারেই না, আইসিসের অত্যাচারের বদলে তারা সিরিয়ার সরকারের অত্যাচারের কথা বলেছে। আইসিসকে বরং অধিকাংশই সমর্থন করেছে। ইউরোপের দেশগুলোতে আইসিস ক্যাম্প থেকে হয়তো আরও জিহাদিকে নিয়ে আসা হবে। ইউরোপে জিহাদি হামলা মনে হয় না অচিরে শেষ হবে। ইউরোপকে আর নিরাপদ জায়গা বলে মনে করার কারণও নেই কোনও।

ভালো কাজ হতো যদি এদের মগজ থেকে জিহাদি ভাবনা দূর হতো। কিন্তু তা তো হয়নি। বিধর্মী হত্যার জিহাদে অংশ নিয়েও আবার বিধর্মীদের দেশে ফেরত আসা যায়। এটি মানুষকে, আমার আশংকা হয়, উৎসাহিত করবে জিহাদি হতে। কিছুই তো হারাবার নেই, শাস্তিও নেই কোনও। সবচেয়ে ভালো হতো এরা যদি ক্যাম্পেই থেকে যেত। ক্যাম্পে যদি এরা অনুশোচনায় ভুগত, জিহাদি কার্যকলাপ যে অমানবিক, বর্বর, মানব সমাজের জন্য ধ্বংসাত্মক একটি কাজ তা অনুধাবন করতো। সভ্য সমাজে ফেরার যোগ্য হওয়ার পর যদি ওদের ফেরানো হতো তাহলে হয়তো কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকা যেত। মনে আছে শামীমা লন্ডনে ফিরতে চেয়েছিল তার সন্তানকে বাঁচাবার জন্য, যেহেতু তার দুটো সন্তান সিরিয়ায় মৃত্যু হয়েছে। শামীমা কোনও অনুশোচনা থেকে সিরিয়া থেকে বের হতে চায়নি।

৩. বাংলাদেশে মাদ্রাসা মসজিদে নানা অপরাধ বাড়ছে। শিশু ধর্ষণ চলছে। মাদক ব্যবসা বাড়ছে। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন না করে ইসলামী দলগুলো ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙেছে, সেদিন কুষ্টিয়ায় বাঘা যতীনের ভাস্কর্যের ওপর হামলা করেছে। জিহাদিদের কাজ ভাস্কর্য মূর্তি মাজার ইত্যাদি ভেঙে ফেলা। সন্ত্রাসী দল আইসিস ইরাকে আর সিরিয়ায় এভাবেই হাতুড়ি শাবল নিয়ে ভেঙে ফেলেছিল প্রাচীন সব কীর্তিস্তম্ভ, স্মৃতিলিপি।

বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে নিজের মূর্তি ভাঙা নীতি মানা মুসলমান পরিচয়খানি দিলে এদের আর বিশ্বের কোথাও স্থান হবে না, এমনকী পাকিস্তানেও নয়। ইরাকে সিরিয়াতেও নয়। একটি দেশেই তারা নিজের ধ্বংসাত্মক জিহাদি কার্যকলাপের কথা চিৎকার করে জানিয়ে দিতে পারে, কী ভাঙবে, কী পোড়াবে, কাকে খুন করবে, কাকে জবাই করবে, তাও ঘোষণা করে দিতে পারে, কিন্তু কোনও শাস্তি হয় না, বরং অনুরাগী ভক্তের সংখ্যা বাড়ে, সে বাংলাদেশ।

রাজনীতিকদের মধ্যে যাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত তাঁরা ধর্মের ধ্বজা তুলে সাধু সেজেছেন। আর তাঁদের ওই ধ্বজার তলায় জন্মেছে লাখ লাখ জিহাদি। রাজনীতিকরা দেখেও না দেখার ভান করেছেন। এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের কোনও চরিত্র নেই বলে তাঁরাও দেশ ও দশের চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। এমন চমৎকার জিহাদোপোযুক্ত ভূমি আর দুনিয়ার কোথায় মিলবে!

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো ইসলামী জিহাদি দলকে নিষিদ্ধ করে বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের নিষিদ্ধ করা যায়। মুসলিম দেশ হলেই সব ইসলামী দলকে বৈধতা দিতেই হবে তা ঠিক নয়। সৌদি আরবের মতো প্রভাবশালী দেশ যদি মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো দলকে নিষিদ্ধ করতে পাবে, তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করতে, কেন পারবে না হেফাজতে ইসলামকে নিষিদ্ধ করতে? চাইলেই পারে। কিন্তু মুশকিল হল চাইছে না। জামায়াতে ইসলামী আর হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যত ক্ষতি করেছে, তত ক্ষতি আমি নিশ্চিত মুসলিম ব্রাদারহুড করেনি মধ্যপ্রাচ্যে। সৌদি আরব ইমাম এবং ইসলাম প্রচারকদেরও চাকরি খেয়েছে। বাংলাদেশ তো জিহাদি আদর্শে যুবসমাজকে বিপথে নিচ্ছে জেনেও কোনও ইমাম বা কোনও ইসলাম প্রচারক হুজুরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না! তাই বলি, সৌদি আরবের কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে বাংলাদেশের।

সৌদি আরবের কাছে বাংলাদেশের শেখার আছে ||| তসলিমা নাসরিন  : নির্বাসিত লেখিকা।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন