স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রবাসীদের মনোনয়ন : কিছু জিজ্ঞাসা !! || মোঃ মাহমুদ হাসান
সারাদেশে চলছে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা স্থানীয় সরকারের শুধু শক্তিশালী ভিত্তিই নয়; টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কেন্দ্রবিন্দুও বটে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডকে জনগনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে স্থানীয় সরকারের কোন বিকল্প প্রতিষ্ঠান গনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আজও গড়ে উঠেনি। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা সংযোজিত করেছে। তৃণমূলের রাজনীতিতে এই মনোনয়ন দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে নেতৃত্ব দেয়া তৃণমূলের ক্ষমতায়নে যেমন আশার সঞ্চার করেছে, ঠিক তেমনি নানামুখী সংকট আর হতাশার চিত্রকেও সমভাবে প্রসারিত করছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। একটি নতুন দেশ, নতুন পতাকা সংযোজন করে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড উপহার দিয়ে দলটি গণমানুষের দলে পরিনত হয়েছে। পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনার পর একুশ বছর দলটির উপর রাষ্ট্রীয় কালাকানুন প্রয়োগ করে দলটিকে যেভাবে নির্মূলের প্রচেষ্টা হয়েছিল,তা রাজনীতির ইতিহাসে নজিরবিহীন। যারা আওয়ামী লীগ কে ভালোবাসেন, বঙ্গবন্ধু মুজিবকে হ্রদয় দিয়ে লালন করেন, তারাও একসময় কল্পনা করেননি, আওয়ামী লীগ আবার ঘুরে দাঁড়াবে, রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একদিন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করে বিস্ময়কর উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে!!
একুশ বছরের সীমাহীন যাতনা কে পেছনে ফেলে ১৯৯৬-২০২১ সময়ের মধ্যে প্রায় আটারো বছর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায়। এমন অসম্ভব কে সম্ভব করে তুলতে যে মানুষ টি নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। আর এই ম্যাজিক সাফল্যের মূল কারিগর হচ্ছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা, যারা জেল জুলম নির্যাতন সহ্য করে আওয়ামী লীগ কে অত্যন্ত শক্তভাবে হ্রদয়ে ধারন করেছিল। তাইতো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তৃণমূলের ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে বলেন, সৎ আর সুবিধা বঞ্চিত ত্যাগীদের ক্ষমতায়নে স্থানীয় সরকারে দলীয় প্রতিকের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু বাস্তবতা যে বড়ই নির্মম!! তাই তো আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের অনেককেই বলতে শোনা যায় ‘আজকাল কাক আর কোকিলের পার্থক্য করা বড়ই কঠিন’!!
নানামুখী বিতর্ক থাকলেও, বিভাজনের প্রশ্নে ভিন্নমতের প্রতিফলন দেখা গেলেও, তৃণমূল আওয়ামী লীগের ক্ষমতায়নে মতামত প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে শেখ হাসিনা দলের দুর্দিনের নেতা কর্মীদের মূল্যায়নের যে সদিচ্ছা দেখিয়েছেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে যারা শেখ হাসিনার সদিচ্ছাকে বাস্তবায়নে নিয়োজিত, তারা যখন অনেক ক্ষেত্রেই নানা ছলচাতুরীতে সুবিধাবাদীদের হাতে বঙ্গবন্ধুর নৌকা তুলে দেন, তখন একদিকে যেমন শেখ হাসিনার সদিচ্ছাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, অন্যদিকে সারা জীবন ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করা নেতা-কর্মীদের হ্রদয়ের রক্তক্ষরণও বেড়ে যায়। উড়ে এসে জোরে বসে অর্থ বিত্তের দাপটে যখন বঙ্গবন্ধুর নৌকা ছিনতাই হয়ে যায়, যুগ যুগ ধরে অর্থ বিত্ত উজাড় করে যারা সততার সাথে ত্যাগ তিতিক্ষার রাজনীতিকে ধারণ করেছিলেন ; তাদের বুক ভরা হতাশায় আবারও তখন রাজনীতির বাতাস ভারী হয়ে উঠে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান তৈরি করেছে। নানা উন্নয়ন সূচকেও আছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। এই সাফল্য কে টেকসই করতে তৃণমূলে একঝাঁক সৎ আর ত্যাগীদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। আর নেতৃত্ব নির্বাচনে যদি পাপলুর মতো সুবিধাবাদীরা প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে ওবায়দুল কাদের, মাহবুবুল আলম আলম হানিফ আর জাহাঙ্গীর কবির নানকের মতো নেতাদের বক্তব্য তখন ঐতিহ্যবাহী দলটির নেতা-কর্মীদের কাছে মাঠের ফাঁকা বুলি হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হবে। সৎ, আর ত্যাগীদের নিষ্ঠুরতম বিদায়ে একদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের চিন্তাটিও হবে সুদূর পরাহুত।
বাংলাদেশের প্রায় সব নির্বাচনেই কিছু প্রবাসী কোকিলের আবির্ভাব ঘটে। গত একযুগে এমন কোকিলের সংখ্যা দলে দলে বাড়ছে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন কে সামনে রেখে এমন হাজারো কোকিল এখন দেশের আনাচে কানাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দামী গাড়ি হাকিয়ে চোখ ধাধানো উপহার আর কিছু অর্থ বিত্তের সুবিধাবাদীদের সংগে নিয়ে নীতি নির্ধারক নেতাদের মনোরঞ্জনে তাদের পিছু পিছু ঘুরছে। যুগ যুগ ধরে প্রবাসে শান্তির পরশ নিয়ে অর্থ বিত্তের যারা মালিক হয়েছেন, এদের হাতেই যখন বঙ্গবন্ধুর নৌকা ছিনতাই হচ্ছে, তখন মাঠে ঘাটে আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে থেকে যারা দলকে সংগঠিত করেছিলেন, তাদের গগন বিদারী হাহাকার দেখার মানুষও যেন আজ দুস্প্রাপ্য হয়ে উঠছে!!
বৃহত্তর সিলেট প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। অর্থ বিত্তেও সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীদের চমক আছে। বিদেশের রাজনীতিতেও কিছু সংখ্যক প্রবাসী গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখে চলেছেন। আবার কিছু সংখ্যক চতুর প্রবাসী উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই ক্ষমতার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে একটি বলয় সৃষ্টির চেষ্টা করেন। আর এই বলয়ের মারমুখী প্রভাবে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনা অন্তপ্রাণ ত্যাগী নেতা-কর্মীরা। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন কে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে আওয়ামী লীগের সাথে পাঁচে নেই, এমন প্রবাসী সুবিধাবাদীদের পদভারে বৃহত্তর সিলেটের আওয়ামী রাজনীতিতেও আজ কোকিল আতংক। এই আতংক নিরসনে শেখ হাসিনাই আজ ত্যাগীদের ভরসা।
দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় অতীতে নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন, এমন প্রার্থীদের মনোনয়ন না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। যুদ্ধাপরাধী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের চেতনার পরিপন্থী কারো হাতে নৌকা তুলে দেয়া যেমন গর্হিত অপরাধ, সেই সাথে প্রবাসে আরাম আয়েশে জীবন জীবিকা চালিয়ে যারা হঠাৎ করেই দুঃসময়ে দলকে লালনকারীদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, তাদের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের ভাবাটাও জরুরি নয় কি?
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ নেই। যে কোন মূল্যে, মৌলিক আদর্শের সংগে আপোষ করে ঠিকে থাকার প্রয়োজনীয়তাও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের নেই। যদি তাই হয়, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি একটি সুখী সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তৃণমূলের পরীক্ষিত, নির্লোভ, সৎ নেতাদের স্থানীয় সরকারে মনোনয়ন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কল্পিত আদর্শ সামাজিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সক্রিয় হতে আপত্তি কোথায়?
লেখকঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন