দেশের সংবাদ ফিচার্ড

হেলেনার দাপুটে উত্থানের পতন

হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল র‍্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নেয়া হয়। রাজধানীর গুলশান-২ ‘জেনেটিক রিচমন্ড’-এ অভিযানের পর তাকে আটক করা হয়। ইনসেটে অভিযানে জব্দ করা মদ, চেকবই, ওয়াকিটকি সেট ও পাসপোর্ট।

হেলেনার দাপুটে উত্থানের পতন

  • প্রিন্টিং এমব্রয়ডারিতে উত্থান চাকরিজীবী লীগে পতন 
  • রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ব্যক্তিদের সম্মানহানির অপচেষ্টায় গুলশান থানায় দুই মামলা, চাঁদাবাজিসহ আরও পাঁচ মামলার প্রস্তুতি 
  • চাঁদাবাজির হাতিয়ার জয়যাত্রা টেলিভিশন খেতাবের ঢাল জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন
  • নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে জড়িয়েছেন নামসর্বস্ব সংগঠনের সঙ্গেও

অবশেষে পতন ঘটলো রাজনৈতিক অঙ্গনে দাপুটে উত্থান আর পদচারণায় থাকা হেলেনা জাহাঙ্গীরের। পতনের আগে যিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য, ছিলেন কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাও। একাধিকবার হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদেশযাত্রার সফরসঙ্গীও। রাজনীতিতে দাপুটে উত্থানের এই আইকন হেলেনা জাহাঙ্গীরের কণ্ঠে দুদিন আগেও উচ্চারিত হয়েছিল ‘কোনো এমপি-মন্ত্রী গোনার টাইম নাই’।

এ ছাড়া আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে জাতীয় পার্টি এবং তারও আগে বিএনপির রাজনীতিতেও সংশ্লিষ্টতার খবর চাউর হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। খালেদা জিয়া ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গেও ছবি প্রকাশ পাচ্ছে তার। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র নির্বাচন করার উদ্যোগও নিয়েছিলেন তিনি। যদিও তখন দাবি করতেন কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে নয়, স্বতন্ত্র রাজনীতি করতে চান তিনি। পরে অবশ্য নির্বাচন থেকেও সরে দাঁড়ান। শুধু রাজনৈতিকভাবেই নয়— বিভিন্ন সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক সংগঠনের সঙ্গেও হেলেনা জাহাঙ্গীরের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তিনি প্রায় এক ডজন সামাজিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় দায়িত্বে রয়েছেন। ব্যাঙের ছাতার মতো সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হেলেনা জাহাঙ্গীরের সফল দাপুটে উত্থান আর পদচারণার মধ্যেই সম্প্রতি বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ গঠনের ঘোষণা দিয়ে নিজেই নিজের পতন ডেকে এনেছেন বলে মনে করছেন অনেকেই। দুদিন আগেও যার হাতে এমপি-মন্ত্রীর গোনার সময় ছিলো না, দুদিন পরই তাকে র্যাব গ্রেপ্তার করে পাঁচ অভিযোগে মামলার প্রস্তুতি নিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে। আর এরই মধ্যে একের পর এক বেরিয়ে আসছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। অতীতের সব আমলনামাই এখন আসছে প্রকাশ্যে। করোনা সংলাপ বাদ দিয়ে বিভিন্ন মহলে এখন আলোচনা-সমালোচনার খোরাকে পরিণত হয়েছেন দাপুটে এই নারী নেত্রী। যিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবেও পরিচিত।

র্যাব বলছে, অপকৌশলের মাধ্যমেই নিজেকে ‘মাদার তেরেসা’, ‘পল্লীমাতা’, ‘প্রবাসীমাতা’ হিসেবে পরিচিতি পেতে জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। তার পৃষ্ঠপোষকতায় একটি সংঘবদ্ধ চক্রও ভুয়া খেতাবের অপপ্রচার চালাত। এ ছাড়া সমাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যক্তিদেরও হেয় করতেন তিনি। বিভিন্ন বিষয় ছড়িয়ে দিয়ে সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতেন। চাঁদাবাজিও করতেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। দাপুটে উত্থানের দৌড়ে সফল এই নারী একজন উচ্চাভিলাষী মহিলা বলেও জানিয়েছে র্যাব। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে নিজের উদ্দেশ হাসিল করতেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশ্লীল শব্দ উচ্চারণকারী সেফুদার সঙ্গেও অবৈধ লেনদেনসহ নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো তার। দেশি-বিদেশি সংস্থা ও ব্যক্তি থেকেও মানবিক সহায়তার কথা বলে জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের নামে অর্থ সংগ্রহ করে নিজের খেতাব প্রচার-প্রচারণায় বেশি ব্যবহার করতেন বলেও জানিয়েছে র্যাব। সর্বোপরি ১৩টি সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে নিজের বিভিন্ন অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেন তিনি।

র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসা থেকে যেসব অবৈধ মদের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে, তার সবকিছু তার নিজ কক্ষ থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী আইন, মাদক, টেলিযোগাযোগ আইন, অবৈধ আইপি টিভি টেলিভিশন পরিচালনার জন্য টেলিযোগাযোগ আইনেও মামলার প্রস্তুতি চলছে। তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে একটি চাঁদাবাজি মামলাও হয়েছে। অবৈধ আইপি টিভি দিয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীর বিভিন্ন জেলায় চাঁদাবাজি করতেন। তিনি এসব বিষয় স্বীকারও করেছেন বলে জানিয়েছেন খন্দকার আল মঈন।

এর আগে ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অবৈধ মাদক, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে একাধিক মামলা করা হয়। তার জয়যাত্রা আইপি টেভির কোনো বৈধ কাগজপত্রও পাওয়া যায়নি। গত বৃহস্পতিবারের অভিযানে মিরপুরের জয়যাত্রা অফিস থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব নথি সংগ্রহ করা হয়েছে। এরপর থেকে বন্ধ রয়েছে টেলিভিশনের ট্রান্সমিশন। একই দিন গুলশানের বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। অভিযানের সময় হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসা থেকে কয়েক বোতল মদ, বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য, বন্যপ্রাণীর চামড়া ও ওয়াকিটকি সেট উদ্ধার করা হয়।

গতকাল শুক্রবার র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গুলশান থানা হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওসি আবুল হাসান। তিনি জানান, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে মিথ্যাচার, অপপ্রচার, ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও ব্যক্তিদের সম্মানহানির অপচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন মামলায়। এ ছাড়া এ মামলায় হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গতকাল রাতে পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালতে তোলা হলে আদালত তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

হেলেনা জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৭৪ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার তেজগাঁওয়ে। উইকি ফ্যাক্টসাইডার নামের একটি ওয়েবসাইটে তার পেশা হিসেবে অ্যাংকর বা উপস্থাপক উল্লেখ করা হয়েছে। স্বামী জাহাঙ্গীর আলম একজন ব্যবসায়ী। ১৯৯০ সালে তারা বিয়ে করেন। তিনি তিন সন্তানের জননী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাবা মরহুম আবদুল হক শরীফ ছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। সেই সূত্রে জন্ম কুমিল্লায় হলেও হেলেনা জাহাঙ্গীরের বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের হালিশহরের মাদারবাড়ি ও সদরঘাট এলাকায়। পড়াশোনা স্থানীয় কৃষ্ণচূড়া স্কুলে। চাকরি সূত্রে তার বাবা প্রমোশনাল প্রস্তাব পেয়ে রাশিয়ায় চলে গেলে মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়ি ফিরে যান তিনি।

জানা যায়, বিয়ের সময় স্বামী জাহাঙ্গীর আলম নারায়ণগঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠিত পোশাক কারখানার জিএম পদে চাকরি করতেন। পাশাপাশি সিঅ্যান্ডএফ অ্যাজেন্ট ব্যবসার সঙ্গেও সংশ্লিষ্টতা ছিলো। গৃহিণী হিসেবে বসে না থেকে পড়াশোনা শেষ করে হেলেনা জাহাঙ্গীর শুরুতে চাকরির চেষ্টা করেন। বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য ইন্টারভিউও দিয়েছেন তিনি। একদিন চাকরি খোঁজার সূত্র ধরে চলে যান স্বামী জাহাঙ্গীর আলমের অফিসে। সেখানে স্বামীর অফিস কক্ষ দেখে তিনি ঠিক করেন নিজেই উদ্যোক্তা হওয়ার। স্ত্রীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান স্বামী জাহাঙ্গীর আলম। বিয়ের ছয় বছর পর ১৯৯৬ সালে রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বরে একটি ভবনের দুটি ফ্লোর নিয়ে তিনি শুরু করেন প্রিন্টিং ও অ্যামব্র্রয়ডারি ব্যবসা। পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে নানান ধরনের পণ্যের জন্য লোগো ও স্টিকার প্রিন্ট করে এ প্রতিষ্ঠান। নিট কনসার্ন প্রিন্টিং ইউনিট লিমিটেড দিয়ে শুরু করে জয়যাত্রা গ্রুপের আওতায় একে একে হেলেনা গড়ে তোলেন জয় অটো গার্মেন্টস লিমিটেড, জেসি অ্যামব্র্রয়ডারি অ্যান্ড প্রিন্টিং এবং হুমায়রা স্টিকার লিমিটেড, যার সবকটিরই ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। তিনি গুলশান ক্লাব, গুলশান নর্থ ক্লাব, বারিধারা ক্লাব, কুমিল্লা ক্লাব, গলফ ক্লাব, গুলশান অল কমিউনিটি ক্লাব, বিজিএমইএ অ্যাপারেল ক্লাব, বোট ক্লাব, গুলশান লেডিস ক্লাব, উত্তরা লেডিস ক্লাব, গুলশান ক্যাপিটাল ক্লাব, গুলশান সোসাইটি, বনানী সোসাইটি, গুলশান জগার্স সোসাইটি ও গুলশান হেলথ ক্লাবের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হতে সবশেষ চাকরিজীবী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে গিয়েই মূলত নিজের পতন ডেকে এনেছেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। – আমারসংবাদ


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন