ফিচার্ড মত-মতান্তর

১৫ই আগস্টকেই কেন বেছে নেওয়া হল।। সিদ্ধার্থ সিংহ

১৫ই আগস্টকেই কেন বেছে নেওয়া হল।। সিদ্ধার্থ সিংহ
 
ভারতবর্ষের শেষ ভাইসরয় ও প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন তড়িঘড়ি বৈঠক করে ১৫ আগস্ট দিনটিতেই ভারতবর্ষের ওপর থেকে শাসন ক্ষমতা তুলে নিয়ে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
কারণ, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দিনটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের সম্রাট হিরোতিহোর আত্মসমর্পণ করার দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি। ওই আত্মসমর্পণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। কারণ এই সমর্পণের ফলে ওই বছরেরই ২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা বন্ধ হয়। শুধুমাত্র সেই সুন্দর স্মৃতিটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই তিনি এই দিনটিকে বেছে নিয়েছিলেন।
ডমিনিক লাপিয়ের এবং ল্যারি কলিন্স-এর যৌথ ভাবে  লেখা, ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ বইটি থেকে আরও একটি তথ্য জানা যায়। সেখানে লেখা আছে, ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দেওয়া হবে প্রাথমিকভাবে ঘোষণার পরেই ভারতীয় জ্যোতিষীরা শুধু অখুশিই হননি, তাঁরা ঘোরতর বিরোধিতা করে বলেন, ওই দিনটি মঙ্গলজনক নয়। তাই জ্যোতিষীদের মত মেনে নিয়েই, যেহেতু এ দেশের লোকেরা সকালের আলো ফোটার পরে দিন হিসেবে গ্রাহ্য করেন, ফলে ১৫ আগস্ট সকাল হওয়ার আগেই, অর্থাৎ ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও ১৫ অগাস্ট ভারতের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে লালকেল্লা থেকে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। 
এ দিন দেশের কোথাও কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য সারা দেশজুড়ে, বিশেষ করে দিল্লিতে কড়া নিরাপত্তা মোতায়েন করা হয়েছে।
তবে পৃথিবীর মোট ২০৩টি দেশের মধ্যে ভারত ছাড়াও আরও পাঁচটি দেশ রয়েছে, যারা এই ১৫ আগস্ট দিনটিকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উদযাপন করে।
সেই দেশগুলো হল—  উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, বাহারিন, লিচেনস্টেইন, রিপাবলিক অফ কঙ্গো।
 
ভারত
ভারতে স্বাধীনতা আসে প্রায় ২০০ বছরের দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। ভারত ছাড়ার আগে ব্রিটিশরা ভারতকে দু’‌টি স্বাধীন রাষ্ট্রে ভাগ করে দিয়ে যায়, একটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ভারত এবং একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ পাকিস্তান। পাকিস্তানে ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়।
 
উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট ৩৫ বছরের মার্কিন ও সোভিয়েত বাহিনী কোরিয়ান উপদ্বীপে জাপানের দখল ছেড়ে দেয়। ফলে জাপানি ঔপনিবেশিকতা কাটিয়ে কোরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। যদিও বর্তমানে কোরিয়া উত্তর ও দক্ষিণ দু’টি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রতি বছর ১৫ই আগস্ট দিনটি দুই দেশেরই বিশেষ ছুটির দিন। আর তাই বলাই বাহুল্য দুই কোরিয়ার স্বাধীনতা দিবস একই দিনে, আর তা হল ১৫ই আগস্ট। এই সাধারণ গণ ছুটির দিনটি ‘কোরিয়ার জাতীয় মুক্তি দিবস’ নামে অভিহিত করা হয়। এই দিনটিকে আবার গওয়াংবোকজিয়লও বলা হয়, মানে আলোর পুনরুদ্ধার।
স্বাধীনতার তিন বছর পর স্বাধীন কোরিয়ান সরকার গঠন করা হয়।
 
রিপাবলিক অফ কঙ্গো
রিপাবলিক অফ কঙ্গো আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত। এই দেশটি স্বাধীনতার আগে ৮০ বছর ধরে ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। ১৯৬০ সালের ১৫ই আগস্ট দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। রিপাবলিক অফ কঙ্গোর রাজধানী হল ব্রাজাভিল্লি। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ৫৫ লক্ষ।
 
বাহারিন
বাহারিন হল দিলমুন সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন কেন্দ্র। দেশটি ১৯৭১ সালের ১৫ই আগস্ট ইংরেজদের কাছ থেকে লাভ করে স্বাধীনতা। এই দেশের বেশির ভাগ বাসিন্দাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৭ লক্ষ। এই দেশটিকে মুক্তোর দেশ বলেও ডাকা হয়। বাহারিনের রাজধানী শহর হল মানামা। ব্রিটিশদের আগে পর্তুগাল ও আরবের উপনিবেশ ছিল এই বাহারিন।
 
লিচটেনস্টাইন
বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে ষষ্ঠস্থানে রয়েছে লিচটেনস্টাইন। ১৮৬৬ সালের ১৫ই আগস্ট জার্মানির কাছ থেকে মধ্য ইউরোপের এই দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। দেশটির পশ্চিম ও দক্ষিণ সীমান্তে সুইজারল্যান্ড এবং উত্তর ও পূর্ব সীমান্তে রয়েছে অস্ট্রিয়া। দেশটির আয়তন মাত্র ১৬০ বর্গ কিলোমিটার আর জনসংখ্যা ৪১,০০০ এর কাছাকাছি। এই দেশের রাজধানী হল ভাদুজ। এ দিন লিচটেনস্টাইনের রাজপরিবারের সঙ্গে খানাপিনার উৎসবে মেতে ওঠে দেশের আমজনতা।
 
তবে আমাদের এই ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কিত কয়েকটি তথ্য কিন্তু খুব কম লোকই জানেন। যেমন—
ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছিল ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ঠিকই, কিন্তু তার আগে ওই একই বছরের ১8 জুলাই অনানুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীনতা লাভ করেছিল ভারত। 
১৯৭৩ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা দিবসে রাজ্যগুলির রাজ্যপালই জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালে এর পরিবর্তন ঘটে। এম করুণানিধি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেন এবং তিনিই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী যিনি স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।  
স্বাধীনতার আগে ভারতে ৫৫০ জন রাজার ছোট্ট ছোট্ট রাজ্য ছিল। সর্দার বল্লভভাই পটেল তাঁদের একত্রিত হতে অনুরোধ করেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। তাঁরা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে রাজি হয়েছিলেন এবং অবশেষে যুক্তও হয়েছিলেন।
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। এটা সবাই জানি। কিন্তু তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী হননি। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জিতেছিলেন সর্দার বল্লভভাই পটেল। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর প্রিয় পাত্র ছিলেন নেহরু। তাই গান্ধীজি সর্দার বল্লভভাই পটেলকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করেছিলেন।  উনি পদত্যাগ করাতেই প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন জহরলাল নেহেরু।
যেহেতু দেশ স্বাধীন করাই ছিল জাতীয় কংগ্রেসের একমাত্র উদ্দেশ্য, তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মহাত্মা গান্ধী কিন্তু ভারতের সব চেয়ে বড় রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেসকে ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে একটি খসড়ায় স্পষ্ট করে লিখেছিলেন, জাতীয় কংগ্রেস তার লক্ষ্য পূরণ করেছে। এটির প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
কিন্তু জাতির জনক হিসেবে তাঁকে মান্যতা দেওয়া হলেও, তাঁর কথা যে রাখা হয়নি, সে তো সবাই দেখতেই পাচ্ছি।
সংবাদটি শেয়ার করুন