দেশের সংবাদ ফিচার্ড

১৭ দেশে পাচার ৪১৬ কোটি টাকার খোঁজে দুদক

১৭ দেশে পাচার ৪১৬ কোটি টাকার খোঁজে দুদক

এফ এম আবদুর রহমান মাসুম।। মূলধনী যন্ত্রপাতি কিংবা পণ্য উৎপাদনের বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল আমদানির আড়ালে চোখের সামনেই আইনি কাঠামোর মধ্যে পাচার হচ্ছে দেশের টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন কৌশলে বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে থাকে।

সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ, ওভার ইনভয়েসিং (আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো) ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (রফতানিতে মূল্য কম দেখানো) মাধ্যমে এসব অর্থ পাচার হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন সংস্থার কাছে অর্থপাচার সংক্রান্ত তিন হাজারের মতো প্রতিবেদন জমা রয়েছে। যা নিয়ে কাজ করছে দায়িত্বপ্রাপ্ত পাঁচটি সংস্থা। সংস্থাগুলো হলো- দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় থাইল্যান্ড, দুবাই, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, চীন, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, ভারত, নেদারল্যান্ডস, বুলগেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড ও বেলজিয়ামে। ওই সময় কাস্টম আইনে লাইসেন্স বাতিলসহ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের আলোকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কিংবা পাচার করা অর্থ ফেরতের দৃশ্যমান উদ্যোগ আর দেখা যায়নি।

এনবিআরের টাস্কফোর্স কমিটির প্রস্তুত করা ২০১৬ সালের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ১৭টির বেশি দেশে প্রায় ৪১৬ কোটি টাকা পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তের হদিস পাওয়া যায়। শুল্ক ফাঁকি ও মিথ্যা ঘোষণায় ওই টাকা বিভিন্ন দেশে পাচারের প্রমাণ পাওয়ায় শতাধিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দও করে এনবিআর।

এনবিআর থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় থাইল্যান্ড, দুবাই, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, চীন, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, ভারত, নেদারল্যান্ডস, বুলগেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড ও বেলজিয়ামে। ওই সময় কাস্টম আইনে লাইসেন্স বাতিলসহ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের আলোকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কিংবা পাচার করা অর্থ ফেরতের দৃশ্যমান উদ্যোগ আর দেখা যায়নি।

যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক সুপারিশে অর্থপাচারে সহায়তাকারী ব্যাংক কর্মকর্তা ও শুল্ক শাখার অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছিল এনবিআরের তদন্ত দল। অজানা কারণে ওই সুপারিশ ফাইলবন্দী হয়ে যায়।

এবার দুদকের নজর ওই প্রতিবেদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে। অর্থপাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় ১৩২টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার ধরন এবং তাদের আমদানি করা পণ্যের বিবরণসহ অডিট রিপোর্ট ও তদন্ত প্রতিবেদন তলব করেছে দুদক।

এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বরাবর পাঠানো চিঠিতে তলব করা নথিপত্রের মধ্যে রয়েছে- ১৩২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় ৪১৬ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি, বিভিন্ন দেশে অর্থপাচার ইত্যাদি বিষয়ে টাস্কফোর্স কমিটির ২০১৬ সালের জুলাই ও অক্টোবরে দাখিল করা প্রতিবেদন ও রেকর্ডপত্র।

এছাড়া কে মরিয়ম গার্মেন্টস লিমিটেড, লাজিম পলি অ্যান্ড এক্সেসরিজ লিমিটেড, মাহমুদ এপারেলস লিমিটেড, মার্স প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ ও মার্ভেলাসি ফ্যাশন লিমিটেডের বিরুদ্ধে শুল্ক ফাঁকি ও বিভিন্ন দেশে অর্থপাচারের অভিযোগের বিষয়ে ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের অডিট রিপোর্ট ও তদন্ত প্রতিবেদনও তলব করা হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও উপপরিচালক আব্দুল মাজেদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু অনুসন্ধান চলা অবস্থায় এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন তিনি।

অন্যদিকে, দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, কিছু অসাধু সরকারি কর্মচারীর সহযোগিতায় কতিপয় গার্মেন্ট মালিক আমদানি ও রফতানির আড়ালে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। এ বিষয়ে পৃথকভাবে দুটি দল গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধান দল প্রতিবেদন দাখিল করলে তা পর্যালোচনা করে কমিশন আইন মোতাবেক পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

প্রায় ১৩২টি প্রতিষ্ঠান ৪১৫ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচার করেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির নামে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল আমদানি, উৎপাদন বৃদ্ধি, আমদানি ও বিপণন খাতে নতুন ক্রেতা খোঁজা, এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিশেষজ্ঞ আনা এবং বিদেশে সেমিনার আয়োজনের নামেও পাচার হয়েছে দেশের টাকা।

তবে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকে এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থপাচারের তথ্য-উপাত্ত রয়েছে বলে জেনেছি। যেহেতু লিগ্যাল চ্যানেলে টাকা পাচার হয়েছে, তাই এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হবে না। দুদক তার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর থেকে তথ্য পেতে শুরু করেছে। সব নথিপত্র পেলে অর্থপাচারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।

এনবিআরের প্রতিবেদন ও দুদকে পাঠানো অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১৩২টি প্রতিষ্ঠান ৪১৫ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচার করেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির নামে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল আমদানি, উৎপাদন বৃদ্ধি, আমদানি ও বিপণন খাতে নতুন ক্রেতা খোঁজা, এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিশেষজ্ঞ আনা এবং বিদেশে সেমিনার আয়োজনের নামেও পাচার হয়েছে দেশের টাকা।

সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা পরিচালকরা বিদেশ ভ্রমণের ব্যয়ও নিজস্ব ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের রেজিস্টারে যে হিসাব উল্লেখ করা হয়েছে বাস্তবে তার বহু গুণ বেশি বলে এনবিআরের প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবেদনে তাইওয়ান, চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড, দুবাই, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, বুলগেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচারের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে।

dhakapost

সূত্র আরও বলছে, অনেক প্রতিষ্ঠান মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি জন্য এলসি খুলে অর্থ বিদেশে পাঠায়। আমদানি করা পণ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে কার্টনভর্তি অথবা খোলা অবস্থায় বন্দরে দীর্ঘ সময় পড়ে থাকে। সেগুলো গ্রহণ করে না সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই প্রতিষ্ঠান যন্ত্রপাতি আমদানির নামে এলসি খুলে আবারও অর্থ পাঠায়। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান যন্ত্রপাতির দাম বেশি দেখিয়ে কমদামি যন্ত্রপাতি কারখানায় ব্যবহার করেছে। অধিকাংশই বন্ডেড সুবিধার আওতার শুল্ক পরিশোধ না করে কাঁচামাল আমদানির সুবিধা গ্রহণ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই তৈরি পোশাক খাত, ওষুধ, প্লাস্টিক ও চামড়া খাতের বলে জানা গেছে।

এনবিআরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সংস্থাটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর, মূসক মূল্যায়ন ও নিরীক্ষা অধিদফতর, ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল এবং ট্যাক্সেস অ্যান্ড লিগ্যাল এনফোর্সমেন্ট শাখার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ২১ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি প্রায় এক বছর ধরে কারখানা, ব্যাংক, বন্দর, বন্ডেড ওয়্যার হাউসসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শনে তথ্য-প্রমাণ জোগাড় ও যাচাই-বাছাই করে অর্থপাচারের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। যা ২০১৬ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানের কাছে জমা দেওয়া হয়। কমিটির সুপারিশ অনুসারে প্রায় ১৩২ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয় ওই সময়।

এনবিআরের প্রতিবেদন অনুসারে, খান অ্যাপারেলস লিমিটেডের বিরুদ্ধে দুই কোটি ২৪ লাখ ৭৭ হাজার ৬১৫ টাকা, এ বি প্যাকেজিংয়ের বিরুদ্ধে এক কোটি ৪৩ লাখ ৪৬ হাজার ৩১৮ টাকা, লুনা অ্যাপারেলস লিমিটেডের বিরুদ্ধে এক কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার ৫৩২ টাকা, ম্যাজিটিক অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৬৪ লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৫ টাকা, উইন ওয়্যার লিমিটেডের বিরুদ্ধে তিন কোটি ৭১ লাখ ৬৪ হাজার ৭৮০ টাকা এবং এন গার্মেন্টস লিমিটেডের বিরুদ্ধে ছয় কোটি ৮৮ লাখ ১৪ হাজার ১২১ টাকার অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায়।

এছাড়া ওয়েল ড্রেসেস লিমিটেডের বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি ৫৭ লাখ ৭৫ হাজার ৭৯১ টাকা, ইউনিটেক ফ্যাশন লিমিটেডের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৯৫ লাখ ৮৮ হাজার ৫১৬ টাকা, টাজ ফিউচার ডিজাইন লিমিটেডের বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি ৮১ লাখ ১২ হাজার টাকা, অ্যাকিউরেট প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে এক কোটি ৭১ লাখ ছয় হাজার টাকা এবং অ্যাসিভ এক্সেসরিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে তিন কোটি ৫৫ লাখ ৫০ হাজার ৬০২ টাকার অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায় তদন্তে। এভাবে মোট ১৩২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায়।

এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রতিষ্ঠানের মালিক, তাদের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা। প্রভাবশালী ওই মালিকরা কাগজপত্রে স্ত্রী ও সন্তানদের নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন।- ঢাকাপোস্ট

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন