ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স || পর্ব -২ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ রয়
পর্ব- ২
নীলার কল্যাণীর প্রতি শ্রদ্ধায় মনটা ভরে উঠেছিল।অথচ নীলা আর অনীকের বিয়েটা হয়েছিল সম্বন্ধ করে৷ নীলা যখন ক্লাস এইটে পরে তখন নীলার মা মারা গেল৷ মায়ের ক্যান্সার হয়েছিল৷ নীলার মা মারা যাবার পর নীলার বাবা ভীষণভাবে ভেঙে পরলেন৷ নীলার কাকিমাই সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিল৷ নীলাকেও তিনি খুব যত্নআত্তি করতেন৷ একটা মৃত্যু কাছের মানুষদের যে কতটা দূরে সরিয়ে দেয় নীলা সেটা আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিল৷ মামার বাড়ির লোকেরা আস্তে আস্তে দূরে সরে গেল৷ মাসি মাঝে মধ্যে খোঁজ নিলেও সেটা ক্রমশঃ কমতে কমতে বন্ধ হয়ে গেল৷
কাকিমাও একদিন ডেকে বলল, নীলু তোদের রান্না আর করতে পারবো না রে৷ তোরা এবার নিজেদেরটা করে নিস৷
আর কদিন বাদেই নীলার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা৷ সেদিন সারা রাত নীলা মায়ের ছবিটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে খুব কেঁদেছিল৷
বাবা বলেছিল, ছোট বউ নীলার পরীক্ষাটা পর্যন্ত তুমি একটু রান্না করো, তারপর না হয় ….. কথাটা শেষ হবার আগেই কাকিমা ঝনাৎ করে উঠেছিল , না না দাদা আমার শরীর দিয়ে কুলোবে না৷ আপনাদেরটা আপনারা বুঝুন৷
পরদিন নীলাদের ঠিকে ঝি লতাকে নীলার বাবা ডেকে রান্নার লোকের কথা বলেছিল৷ লতাই প্রমীলা পিসিকে জোগাড় করে এনেছিল৷ প্রমীলা পিসি নীলার বাবা যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন নীলাদের সংসার আঁকড়ে রেখেছিল৷
নীলা তারপর গ্রাজুয়েট হয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট শেষ করল৷ কলেজ জীবনে নীলার জীবনে এসেছিল সৈকত৷ সৈকত ছিল নীলার ব্যাচমেট৷ নীলার ভাল লাগার বিষয়গুলোকে সৈকত সবসময়েই গুরুত্ব দিত৷
নীলার ছোটবেলা থেকেই খুব পেইন্টিঙের শখ৷ ও সব সময়েই প্রোট্রেট আঁকতে ভালবাসে৷ খাতায় নোট নেওয়া হয়ে গেলে পেন দিয়েই স্কেচ করত৷ জামশেদপুরে একটু ভেতর দিকে একটা সাওতাল পাড়া আছে৷ মাসে দুটো রবিবার সকাল হলেই আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে নীলা ছুটত সাওতাল পাড়ায়৷ সঙ্গে সৈকত৷ সেও খুব ভালো ছবি আকত। তুলিতে রঙ ভরিয়ে টান দিত আদিবাসী রমনীর পিঠে শিশু নিয়ে দৈনন্দিন কাজের খুঁটিনাটি৷ উনুনে ধোঁয়া দেওয়া মধ্য বয়সের নারীর চোখ জ্বালা করত ধোঁয়ায়৷ তবুও সে রান্না করত তার পরিজনদের জন্য৷
আদিবাসী পাড়ায় সবার কাছে নীলা আর সৈকত খুব প্রিয় ছিল৷ ওরা ওদেরকে ভালবেসে জোড়া পিরিত বলত৷ একদিন ও পাড়ার রানী মুর্মু নীলাকে বলেছিল, দিদিমনি তুর নাগরটা না খুব ভাল৷ দেখবি তুকে বিয়ার পরে এক্কেবারে ঘুমাইতে দিবে না৷
নীলা বলেছিল, ঘুমাতে না দিলে তোর কাছে পাঠিয়ে দেব৷ — তুই কি যে বলিস না দিদি৷ মোর ঘরে কি মরদ নাই৷ — তাতে কি হয়েছে তুই দুটো মরদকে নিয়ে একসঙ্গে থাকবি৷
রানী লজ্জা পেয়ে ছুটে পালিয়ে ছিল৷ নীলা ওর সরলতা দেখে সেদিন খুব হেসেছিল৷ সৈকত কাছেপিঠেই কোথায় ছিল৷ নীলাকে এভাবে একা একা হাসতে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিল, কি হয়েছে? তুই একা একা হাসছিস যে৷ ——— রানীর তোকে পছন্দ তো তাই৷ এই বলে পুরো কথাগুলো বলেছিল৷ সৈকতও হা হা করে হেসে বলেছিল, পারিসও তুই৷ সামনে ওদের পরব৷ নীলা আর সৈকতকে ওরা নিমন্ত্রন করেছে ওদের পরবে আসার জন্য৷
পাঁচ দিনের পরবে নীলা পাঁচদিনই শাড়ি পরেছে৷ শেষ দিন বাবাকে বলেই এসেছিল সে ওদের সঙ্গে থাকবে৷ রাতে বাড়ি ফিরবে না৷
মহুয়া ফুলের রস খেয়ে দুজনেই উদোম বাওয়ালি করেছিল৷ শেষ দিন নীলার সাওতালি বন্ধু রতন মুর্মু ওদের এত মহুয়ার রস খাইয়েছিল যে নীলার মন আর নিজের বশে ছিল না৷
রতন মুর্মুর ঘরে সারাটা রাত সৈকতের সঙ্গে নীলার চলেছিল মৈথুনের শীৎকার৷ পরদিন নীলার যখন ঘুম ভাঙল ওদের উদোম শরীরে ভোরের নরম রোদ খেলা করছে৷
নীলা খুব লজ্জা পেয়েছিল৷ সৈকত ওর লজ্জা ভাঙিয়ে বলেছিল, তুই তো আমার সারা জীবনের৷ ভগবান হেসেছিলেন৷ ওদের আর ঘর বাঁধা হয়নি৷
সময়গুলো পেঁজা তুলোর মতন , ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যায় দিকশূণ্যপুরের পথে৷ নীলার জীবনটাও হারিয়ে গিয়েছিল৷ তখন নীলা সবে পোস্ট গ্রাজুয়েট কমপ্লিট করেছে৷ বাবার হঠাৎ করেই হার্ট এটার্ক৷ বাবা একটু সুস্থ হতেই কাকা, কাকীমা বাবাকে বোঝালেন, নীলার এবার বিয়ে দেওয়াটা জরুরী৷ নীলা বলেছিল, আমি চাকরি করে বিয়ে করব৷ কাকিমা কড়া গলায় বলেছিল, যা করবে বিয়ের পরে করো৷
নীলা সেদিন রাতে মায়ের ছবিটা বুকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিল৷ পরদিন সকালে নীলার ফোলা চোখ দেখে বাবা আন্দাজ করে বলেছিল, মা আমার শরীরটা যে আগের মতন নেই, সেটা বেশ বুঝতে পারি৷ আমার কিছু হয়ে গেলে তোর কি হবে বল? সেখানে আমি থাকতে থাকতে তোকে যদি সৎ পাত্রস্থ করতে পারি৷ তাহলে আমি একটু নিশ্চিন্ত হই৷ নীলা বলেছিল, বাবা আমাকে আর একটা বছর সময় দেবে৷ বাবা বলেছিলেন, আমি যে কথা দিয়ে ফেলেছি৷
নীলা চমকে উঠে বলেছিল, কাকে?
তোর কাকীমার দূর সম্পর্কের মামাতো দাদা সোমনাথবাবুর প্রয়াত বন্ধু মনোতোষ চৌধুরীর ছেলে, ছেলেটি পড়াশুনোয় ব্রিলিয়্যান্ট৷ এমবিএ করেছে৷ বনেদি শিল্পপতি পরিবার৷ কলকাতায় থাকে৷ আগামী রবিবার ওনারা আসবেন৷ নীলা চিৎকার করে উঠেছিল৷ বাবা আমার মতামতের অপেক্ষা করলে না৷ বাবা বলেছিলেন, আমি যেটা ভাল বুঝেছি সেটাই করেছি৷
নীলা ছুটে গিয়েছিল সৈকতের বাড়ি৷ সৈকত ওকে সাইকেলের সামনের রডে বসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল নদীর পারে৷ সৈকত তখন স্কুল মাস্টারি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ বলেছিল, মাস্টারিটা আমি ঠিক পাব নীলু, তুই আমাকে একটু সময় দে৷
নীলা বলেছিল, আর সময় নেই রে৷ সামনের রবিবারই ফাইনাল৷ কথাটা বলেই ডুকরে উঠেছিল নীলা৷ আর কোনও উত্তর দেয়নি সৈকত৷ নীলা জানে সৈকতের কাছে কোনও উত্তর নেই, যেমন ছিল না নীলার বাবার কাছে৷
নীলার সেদিন মনে হয়েছিল, পুরুষের ধর্মই বুঝি এটা৷ ভালবাসার সময় কত প্রতিশ্রুতি, কিন্তু সমস্যা এলে তখন নিরুত্তর থাকা৷ ফেরার পথে সেদিন নীলা আর একটাও কথা বলেনি সৈকতের সঙ্গে৷ মেনে নিয়েছিল ওর ভবিতব্যকে৷
অনীকের সঙ্গে সাত পাঁকের বাঁধনে বাঁধা পরল নীলা৷ বিয়েটা বেশ ধুমধাম করেই হল৷ ফুলশয্যার রাতে নীলাকে অনীক একটা হীরের নেকলেশ, কানের আর একটা আঙটি উপহার দিল৷ নীলার মধ্যে কোনও উৎফুল্লতাই নেই৷ অনীকের সেসব বোঝার ক্ষমতাই নেই৷ সে নীলাকে তার বৈভবের গল্প শোনাল৷ হানিমুনে সুইজারল্যান্ডের টিকিট কেটেছে সেসব বলল৷ নীলা চুপ করে শুনতে লাগল৷ ওর কোনও প্রতিক্রিয়া নেই৷
কিছুক্ষণ পরে অনীক নীলার শরীর ছুঁল৷ তাতে নীলার কতটা সায় ছিল সেটা অনীক বুঝলই না৷ নীলাও সেই রাতে জীবন্ত পুতুল হয়ে ফুল ঘেরা বিছানায় শুয়ে রইল৷
বড়লোক শ্বশুরবাড়ি৷ শ্বশুরমশাই মারা গিয়েছেন নীলার বিয়ের বছর দুয়েক আগেই৷ শ্বাশুরী কল্যাণীই সামলে রেখেছেন সবকিছু৷ একমাত্র ছেলে অনীক৷ কাজেই নীলাকে খুব যত্নে রাখেন ওরা৷ বাড়িতে সব সময়ের কাজের লোক থাকায় নীলাকে কিছুই করতে হয় না৷
একে ভালবাসা বলে না অদৃশ্য শিকলে বন্দীর মতন জীবন কাটানো বলে, নীলা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারত না৷ ক্রমশঃ হাফিয়ে উঠছিল নীলা৷ উইকেন্ডে পার্টি আর মদের ফোয়ারা৷ এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই বাড়ির কৌলিন্য৷
বিয়ের এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নীলার বাবা মারা গেল৷ সেই শেষবারের মতন জামশেদপুরে যাওয়া৷ নিজে থেকেই কাকাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করল নীলা৷ নীলা একদিন মন শক্ত করে অনীককে বলল, শোনো আমি ভাবছি একতলার ঘরটায় আমার পেইন্টিঙের কাজ করব৷
অনীক তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিল, তা পেইন্টিঙ করে তুমি কি করবে? ওসব ফালতু৷ তারপর ছবি নিয়ে পার্কস্ট্রীটের ফুটপাথে দাড়াবে বিক্রির জন্য৷ নীলা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিল৷ অনীককে বলেছিল, আমি কি নিয়ে বাঁচব ? একদিন অশান্তি চরমে উঠল৷ নীলা বেঁকে বসল সে আর পার্টিতে যাবে না৷
এদিকে কাপল পার্টি, নীলা না গেলে অনীকের সম্মান থাকবে না৷ অনীক সেদিন নীলার গায়ে হাত তুলেছিল নীলা স্তম্ভিত ৷
অনীক সেদিন একাই গেল পার্টিতে৷ ফিরে এল আকন্ঠ মদ পান করে৷ রাতের বেলায় নীলার শরীরটাকে পশুর মতন হিংস্রভাবে ক্ষত বিক্ষত করল৷ নীলার শিল্পী মন ভেঙে চুড়মাড় হয়ে গেল৷ আর কত সহ্য করবে৷ কল্যাণী সে সময় বাড়ি ছিলেন না। প্রতিবেশিদের সঙ্গে মথুরা, বৃন্দাবন ঘুরতে গিয়েছিলেন।
সেই মাসে নীলার পিরিয়ড হল না৷
চলবে…
কৃষ্ণা গুহ রয়- উপন্যাসিক, কবি। পশ্চিমবঙ্গ
ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স || পর্ব -১ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ রয়
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান