ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব -৪ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব -৪ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

পূর্ব  প্রকাশের পর। পর্ব- ৪

ছবিটা গাড়িতে রেখে ওরা নন্দনের চারপাশটা একটু ঘুরে নিল৷ তারপর গাড়িতে উঠে পার্কস্ট্রীটে গিয়ে ট্রিঙ্কাসে একটা টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসল৷

অনীক জিজ্ঞাসা করল, কি খাবে ?

নীলা বলল, তুমি যা খাওয়াবে৷

অনীক বলল, না আজকের দিনটা তোমার৷ তাই তুমি যা চাইবে৷ তাই হবে৷

নীলা বলল, বেশ তবে চাইনিজ হোক৷

অনীক চাইনিজ ডিসের অর্ডার দিল৷

নীলা বলল, আজকে আমার মনটা খুশীতে ভরে উঠেছে৷

অনীক হেসে বলল, সত্যি তুমি কি অল্পতে খুশী ৷

নীলা বলল, হুমম৷ আমার ভালবাসার জায়গায় যে তুমি নিয়ে এসেছ৷ আমি খুশী হবো না৷

জানো তো মানুষ  কোথায়  ছুটছে সে নিজেই জানে না৷ কোথায় থামতে হবে, তাও অজানা। ছুটতে ছুটতে যে রাস্তাটাই শেষ হয়ে যাবে ৷ সেটাই মানুষ বোঝে না৷

টলস্টয়ের একটা গল্প আছে চাষী বলে৷ সেই চাষীটি লোভি ছিল৷ তাকে বলা হয়েছিল, সূর্য ডোবার আগে যতটা জমি তুমি দৌড়ে ঘুরে আসবে ততটা জমি তোমার৷ সে এত ছুটেছিল, খেয়াল করেনি সূর্য ডুবতে চলেছে, তখন এত জোরে দৌড় শুরু করে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছল, তখন তার জীবনী শক্তি শেষ৷ সে সেই জায়গায় পৌছে মাটিতে পরে গেল৷ আর উঠল না৷ তখন তার জমি রইল মাত্র ছয় ফুট৷ যেখানে তাকে কবর দেওয়া হল৷

নীলার কথা শেষ হতেই সুগন্ধ ভরা চাইনিজ ডিস চলে এল৷

অনীক বলল, নাও খাওয়া শুরু করো৷

নীলা শুধু এটুকু অনুভব করল, নীলার বলা কথাগুলো অনীকের মনে এতটুকু রেখাপাত করল না৷

নীলা আর কিছু বলল না৷ কাঁটা চামচে চিকেনের টুকরো মুখে পুরল৷

বাড়িতে ফিরতে আজকে একটু রাতই হল৷ নীলার মনটা আজকে বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে৷ বাড়িতে এসেই ফ্রেশ হয়ে ছবিটা প্যাকেট থেকে খুলল নীলা৷ অনীককে বলল, এটা কোথায় লাগানো যায় বলো তো ?

অনীক বলল, তোমার যেখানে মন চায়৷

নীলা ওর শোবার ঘরের চারপাশটা দেখে  খাটের বা দিকের দেওয়ালটা দেখিয়ে বলল, এই দেওয়ালটায় লাগাব বুঝলে ৷

অনীক একটা ইংরেজি বিজনেস জার্নালের পাতা ওল্টাচ্ছিল, দেওয়ালের দিকে না তাকিয়েই মুখে হু করল৷

নীলা বলল, কালকে গোবিন্দদাকে বলব দেওয়ালে যেন টাঙিয়ে দেয়৷

গোবিন্দদা নীলার শ্বশুর বাড়িতে থাকেন অনীকের দাদু প্রাণতোষের আমল থেকে৷ মুর্শিদাবাদে সাবলদহ গ্রামে তার বাড়ি৷ বিয়ে করেছিল৷ স্ত্রী মারা গিয়েছে।অনীকের দাদু প্রাণতোষের মুর্শিদাবাদে  একটা কুড়ি বিঘে জমি ছিল৷ ওখানে উনি একটা পাটকল বসিয়েছিল৷ ওই পাটকলে ওখানকার স্থানীয় লোকেরা কাজ করত৷

প্রাণতোষকে ওখানকার মানুষরা ভগবানের মতন দেখত৷ তিনি  প্রতি মাসেই দশ বারো দিনের জন্য মুর্শিদাবাদে যেত৷

ওখানে তিনি  জমি কিনে একটা ছোট্ট বাড়িও করেছিল৷ ওই বাড়ির দেখাশুনা করত গোবিন্দর মা ৷ গোবিন্দ তখন স্কুলে পড়ত৷ বয়স তেরো কি চোদ্দ হবে৷

গোবিন্দর মা বারো মাস বাড়ি ঝাড়পোছ করে পরিষ্কার রাখত৷ আর প্রাণতোষ গেলে রান্নার কাজটাও করত৷ আর বাড়ি পাহাড়ার জন্য সুবল এবং তার পরিবার থাকত৷

প্রাণতোষের বাড়ির পেছন দিকে গোবিন্দদের আর সুবলদের থাকার জন্য ঘরের ব্যবস্থা ছিল৷ গোবিন্দর বাবা গোবিন্দর যখন চার বছর  বয়স তখন কিডনির অসুখে মারা গিয়েছিল৷ তারপর গোবিন্দর মা ছেলেকে বুকে আঁকড়ে সংসার করছিল৷ স্বামী চলে যাবার পর গ্রামের যেটুকু জমি ছিল দুই ভাসুর সামান্য কিছু টাকা  গোবিন্দর মাকে দিয়ে বাড়ি আর গোবিন্দর বাবার ভাগের জমিটুকু লিখিয়ে নিল৷ গোবিন্দকে নিয়ে গোবিন্দর মা মুর্শিদাবাদে ভাইয়ের সংসারে উঠল৷ গোবিন্দর মামা প্রাণতোষের পাটকলে কাজ করত৷ গোবিন্দর মা দাদার বাড়িতে এসে প্রথমে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান ঝাড়া, বাড়ির গিন্নীদের রান্নার কাজে সাহায্য করার কাজ , কাঁথা সেলাই করে সামান্য রোজগার করত৷

গোবিন্দকেও একটা অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল৷ তারপর যখন প্রাণতোবাবুর বাড়িতে সবসময়ে থাকার জন্য মহিলা পরিচারিকার খোঁজ পরল, তখন গোবিন্দর মামা পাটকলের ম্যানেজার সত্যগোপালকে ধরে গোবিন্দর মায়ের প্রাণতোষবাবুর বাড়িতে পরিচারিকার কাজটার ব্যবস্থা করে দিল৷ এই কাজটা পাবার গোবিন্দর মায়ের আর কোনওদিকেই অসুবিধা রইল না৷

পরের হলেও মাথা গোঁজার নিজস্ব ঘরও হল, আর খাওয়া পরার দিকেও সুব্যবস্থা হল৷

গোবিন্দও স্কুলের পড়া শেষ করল৷ প্রাণতোষ যখন মুর্শিদাবাদে আসত তখন গোবিন্দ প্রাণতোষের টুকটাক ফাইফরমাশ খাটত৷ সেজন্য গোবিন্দকে প্রাণতোষের বেশ ভালও লাগত৷ বরাবরই নম্র স্বভাবের গোবিন্দ৷

মাধ্যমিক পাশ করার পর গোবিন্দর মা প্রাণতোষকে বলল, বাবু ওতো টেন পাশ করেছে ওকে যদি আপনার কাছে কোনও কাজে লাগিয়ে দেন৷

প্রাণতোষ বললেন, ও যদি আরও পড়তে চায় পড়ুক, তারপর কাজের কথা ভাবা যাবে৷

গোবিন্দ তারপর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কলেজে ভর্তি হল৷ যে বছর ফাইনাল পরীক্ষা সেই বছরই গোবিন্দর মা হার্ট ফেল করে মারা গেল ৷

প্রাণতোষ গোবিন্দর পাশে অভিভাবকের মতন দাড়াল৷ মায়ের শ্রাদ্ধ মিটে যাবার পর বিএ পরীক্ষা দিয়ে গোবিন্দ চলে এল কলকাতায় প্রাণতোষের কাছে৷

দমদমে প্রাণতোষের একটা  রাবার ফ্যাক্টরি ছিল৷ সেখানেই ম্যানেজারের চাকরি পেল গোবিন্দ৷ ফ্যাক্টরির পাশে আলাদা একটা জমিতে ম্যানেজার, সিকিরিউটি গার্ড, সুপারভাইসারদের থাকার জন্য কোয়াটার্স ছিল৷ সেখানেই দুকামরার ঘরে গোবিন্দরও থাকার ব্যবস্থা হল৷

মাঝখানে একবার মুর্শিদাবাদ গিয়ে গোবিন্দ বিএ পাশের রেজাল্ট নিয়ে এসেছিল৷ আর এত বছরে কোনওদিন আর মুর্শিদাবাদ যায় নি৷

কাজকর্ম করে, রেডিওর গান, নাটক শুনে গোবিন্দর বেশ ভালই চলছিল৷

গোবিন্দর বরাবরই যাত্রা, নাটক খুবই প্রিয়৷ মুর্শিদাবাদে থাকতে শীতকালে যাত্রার আসর বসত৷ গোবিন্দ ওর মায়ের সঙ্গে যাত্রা দেখতে যেত৷ আর কলেজে পড়ার সময় কলেজের বাংলার স্যার উমেশবাবু ওদের কয়জনকে নিয়ে একটা ছোট নাটকের দল গড়েছিলেন৷ সপ্তাহে তিনদিন করে নাটকের রিহার্সাল হত৷

কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে ওরা রবীন্দ্রনাথের “বিসর্জন” নাটকটা মঞ্চস্থ করেছিল৷

তারপর ওই নাটকটাই ওরা বেশ কিছু জায়গায় করেছিল৷ গোবিন্দ যখন বিএ পাসের রেজাল্ট আনতে গিয়েছিল, তখন গিয়ে শুনেছিল নাটকের দলটা নাকি ভেঙে গিয়েছে৷

যা হোক প্রত্যেক রবিবার করে গিরিশ মঞ্চে নাটক দেখতে যেত গোবিন্দ৷ অবিবাহিত গোবিন্দ ফেরার পথে মোগলাই, কাটলেট খেয়ে বাড়ি ফিরত৷

একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল৷ রাস্তায় প্রায় হাটু সমান জল৷ গোবিন্দ দেখল একটি মেয়ে টিনের শেড দেওয়া বাসস্ট্যান্ডে একা দাঁড়িয়ে আছে৷ সঙ্গে ছাতাও নেই৷ গোবিন্দর খুব খারাপ লাগল৷ বৃষ্টির জন্য দোকানপাট প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, রাস্তাঘাটও নির্জন৷

গোবিন্দ মেয়েটির কাছে গিয়ে জানতে চাইল, আপনি যাবেন কোথায় ?

মেয়েটি বলল, আমি বেলগাছিয়া যাব৷ আমি এখানে একটা কাজে এসেছিলাম ৷ বাড়ি থেকে বেরুবার সময় বৃষ্টি ছিল না৷ এখন এত বৃষ্টি নেমেছে যে আমি আটকে পরেছি৷ বাসও আসছে না, সঙ্গে ছাতাও নেই৷

গোবিন্দ এক মুহূর্তও ভাবল না৷ বলল, চলুন আপনাকে পৌছে দিই৷

একটা ফাঁকা ট্যাক্সি আসছিল৷ গোবিন্দ ড্রাইভারকে একটু বেশী টাকার লোভ দেখিয়ে মেয়েটিকে ট্যাক্সিতে তুলে বেলগাছিয়ায় ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে, দমদম ফিরেছিল৷

ট্যাক্সিতে মিনিট পনেরো পাশাপাশি বসে গোবিন্দ শুধু মেয়েটির নাম জানতে পেরেছিল৷

মেয়েটির নাম ইরা৷ গোবিন্দও ওর নাম বলে রাবার ফ্যাক্টরির পাশেই যে ও থাকে সেটুকুই বলেছিল৷

তারপর যে যার বাড়ি চলে গিয়েছিল৷ কিন্তু সব কিছু যদি অত সহজেই জীবন থেকে চলে যেত তাহলে জীবনের জলছবির রঙটা একই থাকত৷

গোবিন্দর জলছবির জল রঙটা শুকোতে সময় লেগেছিল বহুদিন৷ সেদিন সেই বৃষ্টি রাতের পর প্রায় তিনমাস কেটে গেছে৷ গোবিন্দর জীবনের নিয়ম তার মতনই চলছে৷

একদিন দুপুর বেলা তখন ফ্যাক্টরিতে দুপুরের লাঞ্চ আওয়ার চলছে৷ সিকিরিউটি গোবিন্দকে এসে বলল, দাদা আপনাকে গেটের বাইরে একজন মহিলা দেখা করার জন্য এসেছে৷

গোবিন্দ একটু অবাকই হল৷ তাকে এখানে কোন মহিলা খোঁজ করতে আসবে৷ যাই হোক গোবিন্দ গেটের কাছে যেতেই দেখে ইরা দাঁড়িয়ে আছে৷

সেদিন রাতের অন্ধকারে মুখটা অত পরিষ্কার ভাবে দেখা না গেলেও ইরার থুতনির জরুলটা গোবিন্দকে ইরাকে চিনিয়ে দিল৷

গোবিন্দকে দেখে ইরা এগিয়ে এল৷ চেহারা উদভ্রান্ত৷ মুখ চোখ শুকনো৷ গোবিন্দ বলল, কি ব্যাপার বলুন?

ইরা বলল, আমি ভীষণ বিপদের মধ্যেই আছি৷ আমাকে যদি একটু সাহায্য করেন৷

গোবিন্দ বলল, বলুন৷

ইরা বলল, কোথাও যদি গিয়ে একটু বসে কথা বলা যেত৷

গোবিন্দ বলল, আপনি দাঁড়ান, আমি আসছি

গোবিন্দ ফ্যাক্টরির ভেতরে গিয়ে সুপারভাইসারকে বলে ইরাকে নিয়ে হাটতে হাটতে ক্লাইভ হাউসের মাঠটায় এল৷

লাল সিমেন্টের একটা বেঞ্চে ইরাকে নিয়ে বসে বলল, বলুন৷

ইরা বলল, আমি বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে৷ মা ছোটবেলাতেই মারা গেছেন৷ বাবা আমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন৷

বেলগাছিয়ায় আমাদের শরিকী বাড়ি৷ আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে সেলসের কাজ করি৷ বাবার গত বছর স্ট্রোক হয়ে গেছে৷ শরীরের একটা অংশ প্যারালাইসিস হয়ে গেছে৷ বিছানায়ই সব কিছু৷ আমিই বাবার সব কিছু করি, আর কাজে বেরুলে আমার জেঠতুতো বৌদি রেখা বাবাকে দেখাশুনো করে৷

সবই ঠিক চলছিল৷ কিন্তু কদিন আগে পাড়ার এক মস্তান রবি আমার পেছনে পরেছে৷ বলছে, যদি আমি ওকে বিয়ে না করি ও আমাকে তুলে নিয়ে যাবে৷

বাড়ির সবাই এই নিয়ে খুব চিন্তায় আছে৷ আমি বাড়ি থেকে বেরুলেই ও ওর চামচে লাগিয়ে দেয়৷ আমি কোথায় যাই, কি করি সব ওর চামচেগুলো ওকে গিয়ে দেয়৷

গোবিন্দ বলল, তা আপনাদের বাড়ির লোকেরা থানায় যাচ্ছেন না কেন ?

কে যাবে বলুন৷ আমাদের না আছে অর্থ বল না লোক বল৷

তাছাড়া শাসক দলের পোষা মস্তান৷ এরা থানা, পুলিশ সব কিনে রাখে৷

গোবিন্দর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ইরা মাঠের পূর্ব দিকে দাঁড়ানো একটা লোককে দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে গেল৷  গোবিন্দ বলল, কে ওই লোকটা৷

রবির চামচে৷

দেখেছেন ঠিক পিছু নিয়ে এখানে এসেছে৷

গোবিন্দ এক ঝটকায় উঠে দাড়াল৷ তারপর লোকটার দিকে এগিয়ে গেল৷ লোকটার চেহারা দেখেই গোবিন্দ বুঝল মস্তান টাকা দিয়ে এদের পোষে৷

চলবে…

কৃষ্ণা গুহ রয়- উপন্যাসিক, কবি। পশ্চিমবঙ্গ


অন্যান্য পর্বগুলো পড়তে হলে

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব -১ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব -২ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব -৩ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

 

 





সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন