অতীতের ডায়েরী থেকে – নির্বাচন | সুশীল কুমার পোদ্দার
আমি তখন এক শিক্ষা নবিসী সহকারী কমিশনার । লোকে পরম্পরায় সন্মান করে ম্যাজিষ্টেট সাহেব বলে। হাতে নোট বুক, পকেটে বিভিন্ন বর্ণের কলম নিয়ে ঘুরে বেড়াই এক অফিস থেকে অন্য অফিসে । উদ্দেশ্য জেলার বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে হাতে কলমে পরিচিত হওয়া। ঘুরে বেড়াই কিন্তু কোন শিক্ষা লাভ করতে পারিনা। খাদ্য অফিসে যাই, খাবার খেয়ে চলে আসি, বন কর্মকর্তার সাথে বন নিয়ে আলোচনা করতে না করতেই প্রসঙ্গ চলে যায় শাল, গজারী, মেহগনী গাছের আসবাবের দিকে। পুলিশ সুপারের অফিসে যাই, উনি অত্যন্ত সমাদর করেন। পান চিবুতে চিবুতে অত্যন্ত হেয়ালী ভরে বলে যান – ‘আরে ম্যাজিষ্টেট সাহেব, রাখেন আপনার খাতা কলম। আগে কি খাবেন বলুন? এখানে কোন কিছু শেখার নাই । সব একা একাই শিখে যাবেন। আচ্ছা বলুন তো বাচ্চা শিশুকে কে শেখায় খাবার খেতে । ও দেখে দেখে শেখে তাই না!’ আমি অপ্রতিভ হয়ে যাই।
ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসি সার্কিট হাউসে। হঠাৎ করে নতুন এক assignment পেয়ে যাই- নির্বাচনের ডিউটি। শহর থেকে বেশ দূরে এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। পরদিন সকালে দুজন পুলিশ ও একজন আনছার আডজুটেন্ট নিয়ে আমরা ধুলো উড়িয়ে, উঁচু নিচু গ্রাম্য পথে আছারী পাছারি খেতে খেতে অনন্ত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলি। পেছনে তাকিয়ে দেখি পিছু নিয়েছে বেশ কিছু নগ্ন দেহ গ্রাম্য শিশু। আমাদের অনভিপ্রেত আগমনে খুশী হয়নি কিছু গ্রাম্য কুকুর। ওরা তারস্বরে ঘেউঘেউ করে আমাদের গাড়ীর সামনে পেছনে দৌড়াদৌড়ি করছে।
অবশেষে আমরা বিশাল দলবল নিয়ে পৌঁছে গেলাম uno অফিস ভবনে। একটু ফ্রেস হয়ে হেটে চললাম ভোট কেন্দ্রের দিকে। পথে যেতে যেতে নিজকে অত্যন্ত আজব প্রাণী বলে মনে হলো। পিছে এক দল বাচ্চা ছেলেমেয়ের নিরলস চেঁচামেচি এবং বেড়ার ফাঁকে ফাঁকে গ্রাম্য মেয়েদের অতি উৎসাহী চোখ আমায় ভিতরে ভিতরে সংকুচিত করে ফেললো। হঠাৎ চেয়ে দেখি প্রায় পুরোটা আকাশ ছেয়ে আছে পোস্টারে। পোস্টারে একজন শ্মশ্রুমণ্ডিত ব্যক্তি খুব সুন্দর করে হাসছেন । আস্তে আস্তে জন সমাগম বাড়তে লাগলো। অদূরে চোখে পড়লো একখানা স্কুল ঘর, চারিদিকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মানুষ। একটা চাপা আতঙ্ক। ভোটকেদ্র বন্ধ হয়ে আছে । presiding অফিসার অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত। কিছুক্ষণ আগে জাল ভোট দেয়া নিয়ে হাতা হাতি হোয়ে গেছে। আমাকে দেখে উনার মুখে রক্ত ফিরে এলো। আমি অনভিজ্ঞ, কিন্তু বুঝতে পেরেছি আমার ভয় পাবার আর কোন পথ খোলা নেই। কোথা থেকে শক্তি পেলাম জানিনা। ভীত সন্ত্রস্ত মানুসগুলোকে লাইনে দাড় করে দিয়েছি। আমি অবিরাম কেন্দ্রের ভেতরে বাইরে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছি।
বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ দেখছি একজন শ্মশ্রুমণ্ডিত ব্যক্তি হাতে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে আমার পিছে পিছে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রথমে আমলে নেইনি। হঠাৎ মনে হোল কোথায় যেন উনাকে দেখেছি। তাইতো এই সে ব্যক্তি যাকে আমি পোষ্টারে দেখেছি। ডেকে বললাম – আপনি একজন প্রার্থী হোয়ে ভোট কেন্দ্রে কি করছেন? উনি বললেন – স্যার, আপনি সারাদিন না খেয়ে আছেন, আপনি আমার মেহমান, তাই আপনার জন্যে কয়েকটা পরটা আর মুরগীর গোস্ত এনেছি। স্যার, আপনি বসেন, আমার ভালো লাগবে। আমি প্রচণ্ড বিরক্ত হোয়ে বললাম – জানেন, আপনার প্রার্থী-পদ বাতিল হোয়ে যেতে পারে, আমাকে বাধ্য করবেন না। চেয়ারম্যান সাহেব মুখটা অন্ধকার করে বিদায় নিলেন।
ভোট আপন গতিতে এগিয়ে চলছে। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ uno স্যারের চিরকুট এলো। দুপরের খাবার জন্য উনার পিয়নের সাথে আমি এগিয়ে চলছি। কলা বাগান, আম বাগান পার হোয়ে বিশাল এক বাড়ির আঙ্গিনায় এসে পড়লাম। বাড়ির আঙ্গিনায় অনেক গুলো গাড়ী। ভেতরে ঢুঁকে uno স্যার সহ অনেক বড় বড় স্যারদের সাথে দেখা হোল। প্রায় সবাই খেয়ে উঠেছেন। যা সন্দেহ করেছিলেম তাই হোল। হঠাৎ করে চেয়ারম্যান সাহেব অত্যন্ত বিনীত ভাবে আমার সামনে উদয় হলেন। আমাকে প্রয়োজনের চেয়ে অধিক সৌজন্যতা দেখিয়ে সযত্নে বসালেন একটা চৌকীর উপর। চারিদিকে রাশি রাশি খাবার। উনি মৃদু হেসে হেসে আমার থালায় মাছ উঠিয়ে দিচ্ছেন ‘ স্যার, এটা হাওরের মাছ’, পাখীর মাংস উঠিয়ে দিচ্ছেন ‘ স্যার, এটা হাওরের বিদেশী পাখী, ?? সাহেব খুব পছন্দ করেছেন। অপমানিত, অবনমিত, অসহায় আমি লজ্জায়, ঘৃনায় আমার দিকে তাকাতে পারছিনে। যতটুকু উৎসাহ নিয়ে গিয়েছিলেম, ততোটুকুই নৈরাশ্য নিয়ে ফিরে এলাম। সারা রাস্তায় ভাবছি DC সাহেবকে বলে হালকা হবো। জেলা সদরে পৌছতে অনেক রাত হোল। রাতটা খুব দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে পার হোল।
DC সাহেব খুব প্রসন্ন ইলেকশন ভালো হয়েছে জেনে। আমি কথায় কথায় আমার অপমানের কথা বলে ফেললেম। আবারো বিস্ময়ের পালা। DC সাহেব চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বললেন ‘ প্রশাসনে চাকুরী কর – সবসময় চোখ কান খুলে রাখবে আর মুখ বন্ধ’
অতীতের ডায়েরী থেকে – নির্বাচন | সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান