ধা রা বা হি ক…….পূর্ব প্রকাশের পর
জাপানের যাপিত জীবন – ৬ | সুশীল কুমার পোদ্দার
আমি যে শহরে এসেছি সেখানে শীতের তেমন উপদ্রব নেই, নেই কোন তুষারের উৎপাত। মার্চ এপ্রিলের এই সময়টা একটা গভীর স্নিগ্ধতায় ভরে থাকে এখানকার প্রকৃতি। রাস্তায় বের হলে চোখে পড়ে ফুল-ভারে আনত চেরী ও প্লাম গাছগুলোর অভাবনীয় সৌন্দর্য।
এক মায়া কারা অপরাহ্ণে বেড় হয়েছি পথে। রাস্তা ধরে হেটে চলেছে অজস্র তরুণ তরুণী, বৃদ্ধ বৃদ্ধা। মায়ের কোলে ফুলের মতো শিশু, বাবার হাত ধরে প্রজাপতির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে ছোট্ট ছোট্ট বালক বালিকা। আমি ওদের পিছু নেই।
বিরাট এক উদ্যান, শত শত মানুষ চেরী বৃক্ষের নীচে, প্লাম বৃক্ষের নীচে আসন পেতে শুয়ে বসে। টুপ টাপ করে ঝরে পরছে সাদা, গোলাপি, লাল রঙা ফুল। সন্ধ্যা হতেই জলে ওঠে অজস্র রঙিন লণ্ঠন। ভেসে আসে বাদ্যযন্ত্রের উচ্চা নিনাদ। এ উৎসব নাকি চলে রাত অবধি, সপ্তাহ ব্যাপী। পরে জেনেছি এটা একটা জাপানিজ ট্র্যাডিশনাল উৎসব – হানামি ( হানা – ফুল, মি – দেখা)। প্রকৃতির সৌন্দর্য বিমোহিত হয়ে, জীবনের জটিলতা থেকে নিজকে ক্ষণকালের জন্য সরিয়ে রেখে অপার আনন্দে মেতে থাকা মানুষগুলোকে দেখে মনটা এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে যায়। মনে প্রশ্ন জাগে আমরাও তো ফুল দেখে আপ্লূত হই, বকুল, কৃষ্ণচূড়া, পলাশের অভাবনীয় সৌন্দর্যে যখন আকাশ বাতাস মাতোয়ারা, আমরাও তো সবাই মিলে উপভোগ্য করতে পারি সেই সময়টাকে!
প্রকৃতির এ অভাবনীয় সৌন্দর্য জনজীবনে এমন ছাপ রাখতে পারে তা না দেখলে বুঝতাম না। সেদিন আমাদের ডিপার্টমেন্টের বরফ ভাঙন পর্ব। আন্ডারগ্রাড, মাস্টার্স, ও পিএইচডী ছাত্ররা নিজের নিজের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে – যা আমি কখনও শুনিনি বা দেখিনি। একজন ছাত্র দাঁড়ায়ে কবিতার মতো বলে যায় – আমি যখন আমার গ্রাম ছেড়ে এ শহরে আসি, মনটা ভীষণ খারাপ ছিলো। পথে আসতে আসতে সাকুরার (চেরী) শ্বেতশুভ্র ফুলগুলো আমায় অভিবাদন জানালো। হাই ওয়াতাশি ওয়া হারুইয়ামা দেস, ইমাবারী কারা কিমাসতা ( আমি হারুইয়ামা, ইমাবারী থেকে)। আরেক জন মুখে হাসি নিয়ে বললো, আমি যখন সাকুরার দিকে তাকিয়ে ছিলেম, ওর সৌন্দর্যে আমি এতোটাই আত্মহারা হয়েছিলেম যে ভুলেই গিয়েছিলাম আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টার কথা। হাই ওয়াতাশি ওয়া নাকামুরা দেস, … । আমার পরিচয় পর্বে আমি সাকুরার ধারে কাছে না যেয়ে, কোন অলংকার না চড়িয়ে চাঁচাছোলা ভাবে বলে যাই- ওয়াতাশি ওয়া সুশীর দেস। বাংগুরাজীন।
সময় যতো এগিয়ে যায় পরিচিত হই নতুন নতুন সংস্কার, নতুন নতুন রীতির সাথে। আমার প্রফেসরের অধীনে সবমিলে ৩০-৪০ জন ছাত্রছাত্রী। ছাত্রীর সংখ্যা খুবই কম মাত্র দুজন। আমাদের দুই সপ্তাহ অন্তর অন্তর শিমন (রিপোর্টিং সেসন) । আমরা আমাদের শিমন পাঠ করে চলেছি। তার ফাকে ফাকে দুই ছাত্রী সেনসেই সহ অনেকেই চা পরিবেশন করছে। পরে জেনেছি জাপানী সমাজে এটাই পরম্পরা সেটা শিক্ষালয় হোক আর কর্ম ক্ষেত্র হোক। এ পরম্পরার মধ্যে নারীদের প্রতি বৈষম্য পরিলক্ষিত হলেও সবাই এব্যাপারে কেন জানি নীরব।
সেনসেই আমাকে সহ বেশ কিছু বিদেশী ছাত্রকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছেন। আমি কি নেব কি দেব ভেবে চলেছি। যেখানে সস্তায় সবজী কিনি সেখানে অনেক বড় বড় তরমুজ। একটা ঠাউশ আকারের তরমুজ হাতে নিয়ে পাকা কিনা নিশ্চিত হতে যেই বাজাতে গিয়েছি জাপানীজ দোকানী রা-রা করে আসলো। তরমুজটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিলো নির্দয় ভাবে। আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে আমি অমন তরমুজ কেনার উপযুক্ত নই। আমারও জেদ চেপে গেল। দুহাজার (২০ ডলার) ইয়েন দিয়ে নিলামে জয়ী হবার আনন্দ নিয়ে সেনসেই বাসায় উপস্থিত হলাম। সেনসেই অনেকটা উল্লসিত হোয়ে উনার মিসেস কে ডাক দিলেন – ওকাসান, ওকাসান বলে। না, জাপানিজ ভাষাটা মাঝে মাঝে ধরা দিয়েও ধরা দেয় না । আমি শিখিছি ওকাসান অর্থ মা, নিজের স্ত্রী কে ‘মা’ বলে ডাকার অর্থ কিছুতেই বুঝতে পারলেম না। পরে জেনেছি, জাপানী সমাজে একজন স্ত্রী যখন মায়ের ভূমিকায় তখন তার পরিচয় হয় সন্তানের দিক থেকে। ঠিক কিছুটা আমাদের দেশের গেদার মা বা গেদির মার মতো …
দরিদ্র কৃষক। পড়ন্ত বেলায় অতিথি এসেছে ঘরে। তা যা-তা অতিথি নয়- একে বারে ধর্মগুরু। কিন্তু তাকে তো সমাদর করার মতো সাধ্যি নেই তার। তাই সে –
সবিনয়ে প্রণতি করে, করজোড়ে করে নিবেদন
তোমায় কি দিয়ে আমি করিব আপ্যায়ন,
আছে শুধু তণ্ডুল আর ভর্তা বেগুন
কিভাবে তোমাকে দেই করিতে ভক্ষণ।
ধর্মগুরু অভয় দিয়ে কৃষককে বলে তার কোন ক্ষুধা নেই। রাত্রি গভীর। ক্ষুধায় গুরুর ঘুম আসেনা। কৃষক যে তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য ঋণ করে হলেও একটু ভালো খাবারের বন্দোবস্ত করবে না এ তার জানা ছিলনা। অগত্যা গভীর রাতে কৃষককে শুনিয়ে শুনিয়ে দৈববাণীর মতো সে উচ্চকণ্ঠে বলে যায় –
লেখা আছে পঁচিশ পাতার তলে,
রাত্রি বেলা মুরগী না হলেও বেগুন ভর্তা দিয়ে চলে।
নিয়ে আয় তোর বেগুন ভর্তা ভাত
এতে জানি মিটিবে, তোর অপূর্ণ সাধ।।
আমাদের এ বঙ্গদেশে আমরা ঋণ করে হলেও অতিথি কে সমাদর করতে এতটুকু কুণ্ঠিত হই না। অতিথি কপটতা বা নিজের ওজন বাড়ানোর জন্য না না করলেও আমরা তাকে চেপে ধরি, আর অতিথিও সেই সুযোগের জন্য উৎ পেতে থাকে। কিন্তু, আপনি যদি কষ্মিণ দেশান্তরী হয়ে জাপানে যান এবং আশা করেন আর একবার বলিলেই খাইবো, তবে সে আশায় কিন্তু গুড়ো বালি ।
সুজুকী সেনসেই। খুব চটপটে তরুণ, associate professor। তিনি একদিন আমাকে সপরিবারে নিমন্ত্রণ করলেন এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টটা শহর থেকে বেশ দূরে। আমরা সেনসেই এর সাথে, ওনার সহধর্মিণীর সাথে গল্প করতে করতে হাজির হলেম এক তন্দুরি রেস্টুরেন্টে। টেবিলে বসা মাত্র জাপানিজ রেস্টুরেন্ট মালিক স্বয়ং এলেন আমাদের সাথে গল্প করার জন্য, বিশেষ করে আমার সহধর্মিণীর সাথে। ভারতীয়/বঙ্গীয় মেয়েদের বৃহৎ আয়ত লোচন জাপানিজদের কাছে অত্যন্ত ঈর্ষনীয় ও আকর্ষণীয় । তা তারা সরাসরি বলতেও দ্বিধা করে না। টেবিলে মেন্যু দেখে সেনসেই খাবার পছন্দ করলেন। আমায় বললেন এরান্দে কুদাসাই (পছন্দ কর)। আমার পরম্পরা আমায় নিঃশব্দে জানিয়ে দিলো – যেখানে শিক্ষক নিমন্ত্রণ করেছেন, সেখানে আবার আমার পছন্দ অপছন্দ কিসের, ওনার পছন্দই আমার পছন্দ। আমি আকার ইঙ্গিতে সে কথাই আমার স্বল্প জাপানিজ দিয়ে বলার চেষ্টা করলেম। আমি মুখে বললেম – ইরা নাই ( দরকার নেই)। সেন্সেই অর্ডার দিলেন। প্রায় মিনিট বিশেকের মধ্যে খাবার এসে গেল, কিন্তু শুধু ওনাদের জন্য। টেবিলে তন্দুরি রুটি, বাটার চিকেন, সালাদ, অনেককিছু। সেন্সেই ও তার পত্নী দীর্ঘ সময় নিয়ে খেয়ে যাচ্ছেন। আমার সহধর্মিণীর কাছ থেকে জেনে নিচ্ছে রেসেপী, রন্ধন প্রক্রিয়া।
এদিকে দুপুর গড়িয়ে যায়। এখানে আসার আগে সেই সকালে প্রাতঃরাশ করে এসেছি। হারা নো মুসি নাইতে ইরু ( পেটের মধ্যে ইঁদুর কান্না করছে)। আমার সহধর্মিণী বার বার আমায় ইশারা করছে। আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। কিন্তু তখনও আমি আশা ছাড়িনি। আমার বার বার মনে হচ্ছে এই বোধ হয় গরম গরম বাটার চিকেন ও নান আসছে। আমি ওকে বাংলায় সেই আশার বানীই শুনিয়ে যাই। যখন ঘণ্টা পার হয়ে যায় তখন নিশ্চিত হই কিছু একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। সেন্সেই পরিতৃপ্ত হয়ে তার খাওয়া সাঙ্গ করলেন। অথচ একটি বারও ভাবলেন না আমরা তার নিমন্ত্রিত অতিথি। সৌজন্য হিসেবে রেস্টুরেন্ট মালিক আমাদের আইস ক্রিম খাওয়ালেন। আমরা ক্ষুধার্ত দুজন মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে গল্প করতে করতে বাসার কাছে এসে পৌঁছলেম। সেন্সেই আমাদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য অনেক ধন্যবাদ দিলেন। আমরাও শুষ্ক মুখে আমাদের অনেক খাবার খাওয়ানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেম।
ঘরে ফিরে ও আলু-ভাত চড়িয়ে দিয়েছে। আমি তখনও হতভম্ব। হিসেব মিলাতে পারছি না – কি হোল কেন হোল। দুঃখে দুজনই হাসছি। হঠাৎ মনে হোল আমাদের এখানকার সবার বড়ভাই ডক্টর আকবরকে টেলিফোন করে জেনে নেই কেন এমন হোল। আমি সব খুলে বললেম। তিনি হেসে বললেন সেন্সেই যা করেছেন তা মোটেই অসৌজন্যতা নয়। কোন কিছু পছন্দ/অপছন্দ হোল ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যাপার। জাপানিজরা কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। যেহেতু আমি বলেছি ইরা নাই, তিনি ভেবে নিয়েছেন আমার খাবার প্রয়োজন নেই। শুনে আরও হতভম্ব হয়ে গেলাম। মনে পড়লো আমার পরম্পরার কথা, মায়ের কথা। বাসায় অতিথি এলে খাবার দিয়ে মা পর্দার পেছনে অপেক্ষা করতেন কখন পাতে আবারো ভাত ঢেলে দিবেন!
চলবে…
জাপানের যাপিত জীবন – ৬ | সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
লেখকের স্মৃতিচারণের অন্যান্য পর্বগুলি দেখতে হলে
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ১ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৩ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৫ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৬ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৭ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৮ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৯ |
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ১ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ২ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৩ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৪ | ,
জাপানের যাপিত জীবন – ১ |জাপানের যাপিত জীবন – ২ | জাপানের যাপিত জীবন – ৩ | জাপানের যাপিত জীবন – ৪ | জাপানের যাপিত জীবন – ৫ |
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন