ধা রা বা হি ক…….পূর্ব প্রকাশের পর
জাপানের যাপিত জীবন – ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার
বন্ধু মাধব। ওর সাথে আমার পরিচয় ওসাকার ডর্মে । আমরা পাশাপাশি রুমে থাকি। ও দিল্লীবাসী হলেও চমৎকার বাংলা বলে। দেখতে অনেকটা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মতো। অকালে চুল পড়ে যাচ্ছে বলে মাথাটা চেঁছে ফেলেছে, তাতেই ওর চেহারাতে এসেছে একটা আলাদা রকমের দৈব দীপ্তি। ও নয়াদিল্লীর কোন এক আর্ট কলেজের শিক্ষক। জাপানে এসেছে পিএইচডি করতে। ও ভীষণ রকমের বৈষয়িক। সবসময় অমূল্য রতন পাবার আশায় ছাইয়ে ফু দিয়ে চলে। ওর কাছ থেকে আমার অনেক কিছু শেখা। ডর্মের প্রথম প্রহরেই ওর কাছে আমাদের হাতে খড়ি। আমরা দুই বাঙালি আমাদের লাগেজ নিয়ে আমাদের নিদিষ্ট কক্ষের দিকে হেঁটে চলেছি। বালকনির দুপাশে কার্পেটের উপর থরে থরে সাজানো অসংখ্য জিনিস। টেলিফোন, টেপরেকর্ডার, ভিসিআর, টেলিভিশন, এমনকি ভিডিও ক্যামেরা। আমরা ভাবতেই পারিনি ওগুলো পরিত্যক্ত সম্পত্তি। মাধব ঠিক বুঝে ফেলেছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রুম থেকে বেড় হোয়ে দেখি তেমন কিছুই আর পড়ে নেই। মাধব একই জাতিয় একাধিক জিনিস দিয়ে ঘর ভর্তি করে ফেলেছে।
সুউচ্চ পাহাড়ের উপর আমাদের ডর্ম। হুহু করে বাতাস বয়ে যায় একটা নাকি শব্দ করে। রাতে সে শব্দ বড় বেশী অপার্থিব মনে হয়। মাঝে মাঝে সে শব্দের মধ্যে আমি এক অশরীরী আত্মার বিলাপ শুনি। রাতে ঘর থেকে বেড় হতে বড্ড বেশী ভয় হয়। জানালা দিয়ে ওসাকার দূর দুরন্ত আকা বাঁকা রেখার মতো চোখে পড়ে। প্রকৃতির এমন নিরাভরণ সৌন্দর্যে নিজকে ভীষণ একাকী লাগে। পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে বড় বেশী মন চায়। মাধব সেই শূন্যতা পূরণ করে। মাঝে মাঝে পাশের রুম থেকে ভেসে আসে গিটারের সুরেলা তান। ছোট খাট অমায়িক দক্ষিণ ভারতীয় শ্রীনিভাসন আপনমনে গিটার বাজায়। সুরের মূর্ছনায় এতোটাই ডুবে থাকে যে কখনো কখনো আমাদের উপস্থিতিই টের পায় না। ও একজন ভাবা পরমাণু বিজ্ঞানী। আমরা সবাই ওকে সম্মান করে শ্রীনিভাসন সান বলি।
জাপানে সান মানে মিস্টার। কেউ কখনো নিজকে মিস্টার অমুক বলে পরিচয় দেয়না। কিন্তু আমাদের মাধব জাপানিজে নিজের পরিচয় দিতে যেয়ে নিঃসংকোচে বলে ফেলে ওয়াতাশি ওয়া মাধব সান দেস (আমি মিস্টার মাধব)। এই নিয়ে কতো হাসাহাসি হয় কিন্তু মাধবের কোন ভাবান্তর হয় না।
বিদেশী ছাত্রদের জাপানী সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করবার জন্য হোস্ট ফ্যামিলি প্রোগ্রামে আমি আর মাধব হোস্টের বাসায় নিমন্ত্রিত হলাম। দৈব ক্রমে আমাদের দুজনের হোস্ট পরস্পরের আত্মীয়। তাই যেকোনো নিমন্ত্রণে আমরা দুজনে একসাথে যাই। জাপানীজরা অনেকটা সময় নিয়ে খায়। আমাদের সামনে অসংখ্য পদের খাবার। হোস্ট প্রতিটা খাবারের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন , সাথে পরিচিত হতে চাইছেন আমাদের সংস্কৃতির সাথে। ভাষার সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক কিছুই আকারে ইংগিতে বলতে হচ্ছে। মাধব সে সব শূন্যস্থান পূর্ণ করে দেয় কলম দিয়ে ছবি একে। বেশ জমে ওঠেছে। আমি খেতে খেতে দেখি একটা বাটিতে সবুজ বর্ণের একটা পেস্ট। ওটাকে আচার মনে করে বেশ কিছুটা মুখে দিয়ে স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকি। আমার তালুতে এক ভয়ংকর দাবানল জিহ্বাকে পুড়িয়ে খাদ্যনালী হয়ে পাকস্থলীর দিকে যাত্রা করেছে। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। পরে জেনেছি ঐ জীবনঘাতী খাদ্যটার নাম ওয়াছাবি।
নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে অনেক রাত হলো। এবার ফিরে আসার পালা। আমরা বিনীত ভাবে জাপানি রীতিতে বললাম গোচিশো সামা দেশতা (পরিপূর্ণ উপভোগ্য একটা ভোজ ছিল)। প্রতি উত্তরে জাপানি পরিবার সমস্বরে বলে উঠলো ওসকারে সামা দেশতা ( ধন্যবাদ তোমারা কষ্ট করে যা করেছ তার জন্য)।
নিঝুম রাত্রি। পাহাড়ি আকা বাঁকা রাস্তা ধরে হোস্টের গাড়িতে আমরা এগিয়ে চলছি। পথে যেতে যেতে হোস্ট আমাদের ওসাকা শব্দের অর্থ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। ও মানে বড় আর সাকা মানে ঢাল। সুউচ্চ পাহাড়ের উপর আমাদের ডর্ম। বহু দূর হতে ডর্মের মিটিমিটি আলো চোখে পড়ে। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি দূরে বহুদূরে। মাধব ক্রমাগত আমায় ইশারায় কি যেন বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি এতক্ষণ খেয়াল করিনি। ও ঘেমে চলেছে। হোস্টের বাড়িতে একবারও ওকে বাথরুমে ঢুকতে দেখিনি। তিন চার ঘণ্টা চর্ব্য চোষ্য খাবার পর বাথরুম চাপা স্বাভাবিক। এই বিব্রতকর মুহূর্তে আমরা বাথরুমের জাপানিজ শব্দটা ভুলে গেছি। ও আমায় বারবার বলছে হোস্টকে বলতে যেন গাড়ীটা থামায়। আমি ইতস্তত করি। ও আর পারছে না। সমস্ত সঙ্কোচ পরিত্যাগ করে ও বলে ফেলল – শূমীমাছেণ, ওয়াতাশি ওয়া ওতেরা নি ইকিতাই (ক্ষমা করবেন, আমি মন্দিরে যেতে চাই)। হোস্ট চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে বলল, শোণ্ণা মাইউনাকা নি ( এতো গভীর রাত্রিতে!)! ওয়াতাশিতাচি ওয়া নিচীইউবি একিমাছ (আমরা রোববার যাবো)। মাধব নাছোড়বান্দার মতো বলে চলেছে, ইয়ে, এমা একি তাই (না, এখনিই যাবো)। হোস্ট কিছুতেই বুঝতে পারে না মাধবের এ অদ্ভুত আচরণ। এতক্ষণে আমি বুঝে গেছি যেহেতু ওতেরা শব্দটা নিয়ে বিভ্রাট ঘটেছে, তাই নিশ্চয়ই শব্দটা ওতেরাই হবে। আমি কথাটা বলতেই, হোস্ট অত্যন্ত লজ্জিত হোয়ে বারংবার বলতে লাগলো, গোমেন কুদাশাই মাছে চোততো মাততে, গামেণ শীততে, গামেণ শীততে ( আমাকে মাফ করে দাও, এক্টূ ধৈর্য ধর, আর একটু, আর একটু)…
চলবে…
লেখকের স্মৃতিচারণের অন্যান্য পর্বগুলি দেখতে হলে
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ১ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৩ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৫ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৬ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৭ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৮ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৯ |
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ১ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ২ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৩ | , স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৪ | ,
জাপানের যাপিত জীবন – ১ |
জাপানের যাপিত জীবন – ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
এস এস/সিএ
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন