করোনা এবং জীবন |||| আলিফ আলম
হঠাৎ একদিন শেষ রাতের আবছায়া ঘুমের দুঃস্বপ্নের মতো একটা ভাইরাস এসে, কিছুদিনের মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত জায়গায় বিশ্রী ভাবে ছড়িয়ে গেল। এটা মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় বলে, ক্রমে ক্রমে মানুষ তার স্বাভাবিক জীবন ফেলে, ঘর বন্দী হতে থাকে। হঠাৎ কোন আচমকা ধাক্কায় ট্রেন যেমন থেমে যায়, তেমনি আমাদের চলমান জীবন মাঝপথে আটকে গেল। এরপর ট্রেনের ভিতর থাকা মানুষজন সব নড়ে উঠল। তারপর গোলমাল , হৈ চৈ আর দিশেহারা অবস্থা।
আমরা কোনদিন ভুল করে ও ভাবেনি, এমন কোন দিকহীন কঠিন বাস্তবতা আমাদের সামলাতে হবে। অন্যদিকে প্রিয় পৃথিবী তার চিরচেনা রূপ এক নিমিষে বদলে ফেলেছে। এতদিন ধরে দাপিয়ে বেড়ানো পুঁজিবাদ যন্ত্রণায় মোচড় খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। প্রকৃতির মাটি -জল, বাতাস, জীবনের প্রতিদিনকার প্রয়োজন ছেড়ে, মানুষ এখন ঘরে বন্দী। এমন দম বন্ধ করা পরিস্থিতিতে আমাদের কেবলেই মনে হতে লাগল, প্রকৃতি কি তবে আমাদের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে, নাকি আমাদের প্রকৃতিকে আলাদা ভাবে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন ছিল?
আমাদের সবার সামনে এখন এক অঘোষিত যুদ্ধ। ভোরে ঘুম ভাঙলে এতদিন চোখের আলো ফেলে যে পৃথিবীকে দেখেছি ,তা আর আমাদের সেই চিরচেনা পৃথিবী নেই। এ যেন দুঃস্বপ্নে আসা কোন এক অদৃশ্য ,অশরীরীয় শক্তি যা আমাদের সব সুখবোধ কেড়ে নিতে চায়। ঘুম ভাঙ্গলেই আমরা আবার আগের পৃথিবীতে ফিরে যাব। তবে বাস্তবিক অর্থে তা সত্যিই স্বপ্নের বিপরীত।
ধীরে ধীরে ভাইরাস খুব দ্রুত ছড়াতে লাগল। বাইরে বের হওয়া এখন বারণ । এখন চাইলেও আগের মতো প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়া যায় না। এখন চাইলেও প্রিয় মানুষদের জড়িয়ে ধরা যায় না। ফলে সবার সাথে সবার যোগাযোগের তার ছিঁড়ে পড়ে। মানুষকে দেখলেই এখন বরং ভয় হয় । খুব দরকার ছাড়া বাইরে বের হওয়া অনিরাপদ। জানালা দিয়ে আকাশ এসে যখন উঁকি দেয় তখন বড় হতাশ লাগে।
এদিকে স্কুল কলেজ জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ ঘোষণা করা হল । ছেলে মেয়েরা ঘরে বসে বসে ক্লান্ত । সহপাঠীদের সাথে দেখা নেই। বাইরে দৌড়-ঝাপ নেই, হৈ – হুল্লোড় নেই। অনেকে বাড়ি বসেই সব কাজ সেরে নেবার কথা ভাবল। একসময় সারাদিন প্রযুক্তির সাথে কাটিয়ে আমরা ক্লান্ত হতে শুরু করলাম। কিন্তু এই যে আমাদের চেনা পৃথিবী এমন করে অসাড় হয়ে গেল, এরপর আমরা কি এর একটা অর্থ বা কারণ বোঝার চেষ্টা করছি?
ফোনের পর্দায় হঠাৎ একদিন একটা প্রতিবেদন ভেসে উঠল। পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে যাবার কারণে মেরু প্রদেশের বরফ গলে যাচ্ছে, আর তার নিচে থাকা এমন সব প্রাচীন ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গিয়েছে, যা মানব শরীরে প্রবেশ করলে, আমরা ভয়ংকর বিপদের মুখোমুখি হব। বহুদিন ধরে ‘পৃথিবীর জ্বর ‘ বলে একটা শব্দ আমরা শুনে আসছি । প্রতিদিন পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে । পৃথিবীর তুলনায় আমরা খুব ছোট হবার কারণে আমরা যেমন তার ঘূর্ণন বুঝি না তেমনি আমাদের তৈরি কলকারখানার ধোঁয়া বা মানুষ সৃষ্ট নানাবিধ কাজের প্রভাব এত ধীর যে, প্রকৃতির উপর আমাদের কাজের বিরূপ প্রভাব ও আমরা বুঝতে পারি না।
আজ ঘাসের উপর ফড়িঙের নাচন দেখে বারবার মনে হচ্ছে, আমাদের চারপাশের এই যে এত জীবনধারণের আয়োজন, তা কি সত্যিই আমাদের খুব প্রয়োজন আছে? আমাদের আগের প্রজম্মের মানুষদের তো এত প্রয়োজন ছিল না, তবে কি তারা পিছিয়ে ছিল? নাকি আমাদের সুন্দর আধুনিক কাঠামোগত উন্নয়নের খোলসের ভিতর আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিন দিন দুর্বল হতে হতে ভেঙ্গে পড়ছে? প্রকৃতির অনুশাসন ভেঙ্গে, আমাদের যে উন্নয়ন সাধিত হয় ,তা কি সত্যিকারের উন্নয়ন? মানুষ তার নিজস্ব চিন্তা ভাবনায় ডুব দিয়ে অন্ধের মতো এগুচ্ছে। এ যেন তীরচিহ্ন দেয়া একমুখী রাস্তার মতন, যেখানে গাড়ির চালক একবার এই রাস্তায় ঢুকলে, আর সে নিয়ম ভেঙ্গে পেছন আসতে পারে না।
তবে এটা ভীষণ সত্য যে এমন একটা মহামারী পৃথিবীতে না আসলে, হয়ত আমরা কোনদিন আমাদের মাঝে পারস্পারিক আন্তঃক্রিয়ার গুরুত্ব বুঝতেই পারতাম না। আমরা বুঝতেই পারতাম না আমাদের জীবন কতশত ছোট বড় সুখের সমষ্টি। এখন আর আগের মত প্রিয় মানুষরা আমাদের দরজায় কড়া নাড়ে না । দরজার কলিং বেলে কারো হাতের ছাপ পড়ে না। পাপোশে এখন আর আগের মতো প্রিয় মানুষদের পায়ের ধুলোর গড়াগড়ি লেগে থাকে না।
অথচ কি দারুন ছিল এতদিন আমাদের জীবন! সকালের সাদা আলো গায়ে মেখে, হাতে চা কিংবা কফি নিয়ে কাজে বের হওয়া, দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরা, কিংবা সুযোগ পেলেই প্রিয় মানুষদের সাথে আড্ডায় মাতা । আর এখন মাস্কের নিচে আমাদের ঘন শ্বাসের শব্দ আর তার সাথে ঢাকা পড়া আমাদের হাসিমুখ। কাজ-কর্ম ফেলে অনেক মানুষদের এখন ঘরে বসে দিন কাটে আবার কেউবা ঘর থেকেই কাজ চালায়।
প্রকৃতির সাথে আমাদের যে গভীর যোগাযোগ রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বিকার, নিরুত্তাপ এই আবেগহীন পৃথিবীতে, এখন কারো সঙ্গে কারো আগের মতো যোগাযোগ নেই। একটা অদৃশ্য ভাইরাস পুরো পৃথিবীকে একঘরে করে দিয়েছে। এক অজানা মৃত্যুভয়, হিজিবিজি চিন্তা , জীবনের অনিশ্চয়তা সারাক্ষণ মাথার ভিতরের অলিগলি ঘুরে ফিরে। কিন্তু এতসব কিছুর জন্য দায়ী কে, আমরা? নাকি এটা আমাদের জন্য প্রকৃতির সতর্ক বার্তা?
ঘরের বাইরে মানুষজন এখন ভিতু চেহারা নিয়ে বের হয় । মানুষ মানুষকে দেখলে আঁতকে উঠে দূরে সরে যায়। এই অচেনা পৃথিবীকে এর আগে আমরা কখন ও দেখিনি। চিরচেনা রাস্তা ঘাটে মানুষহীন নিরবতা , চারদিকে হতাশার ঘোর অন্ধকার। কেমন যেন গোলমেলে হয়ে গেল সব।
প্রকৃতির কিছু নিজস্ব নিয়ম রয়েছে , তা ভাঙ্গলে মানুষই তার ফল ভোগ করবে। পৃথিবীকে আমরা নানা ভাবে ব্যবহার করে চলছি। অথচ এই পৃথিবীকে আমাদের জন্য কতই না উপযুক্ত করে বানানো হয়েছে। আমার কেন যেন মনে হয় আমাদের সামনে কুয়াশার মতো ধোঁয়াটে কিছু বিষয় রয়েছে যার কারণে আমরা এই বস্তুবিশ্বের অর্থ বুঝতে পারি না। এতো সুন্দর পৃথিবী আমাদের অথচ এর আলাদা করে কোন যত্ন নেই! মানুষের চাহিদা অসীম আর এই প্রয়োজনকে সামনে রেখে আমরা দিব্যি জীবন কাটিয়ে দেই। এত কিছু ভাববার আমাদের সময় কোথায়!
প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ,আর তাতে যোগ দিচ্ছে কতশত প্রিয় মানুষেরা ! হাসপাতাল আর মর্গে জীবিত আর মৃতদের ভিড় । এমন একটা পৃথিবী আমরা কি কখনও ভেবেছিলাম ? এতদিন বইয়ের পাতায় দেখা মহামারী এবার যেন স্ব-শরীরে এসে হাজির। টিভি খুললেই ভয়ে হাত-পা কেঁপে উঠে। জানালা দিয়ে উঁকি দেয়া এক টুকরো আকাশ দেখলে মনে একটা কথাই বেজে উঠে, আমাদের উপর কেন এই প্রতিশোধ, আর কতদিন এমন চলবে?
এখন মাস্ক আর হাত পরিষ্কারকের উপর নির্ভর আমাদের জীবন। মাস্কের নিচে ক্লান্ত হয় আমাদের প্রতিদিনকার নিঃশ্বাস। দম আটকে আসে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেবার জন্য কখন কখনও শহর ছেড়ে, আমাদের খোলা আকাশের নিচে যেতে হয়। না! এমন পৃথিবী আর ভাল লাগে না। কবে সব আগের মতো হবে? নাকি হবে না। এমন নানা অস্পষ্ট চিন্তার ভয় মনকে প্রায়েই ঘিরে ধরে।
কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। আর একে থামানো ও সম্ভব নয়। তাই আমরা ধীরে ধীরে এই জীবনকে মেনে নিলাম। চারপাশে এত ভয় আর উদ্বেগ, এর মাঝেও জীবনকে ভীষণভাবে অনুভব করার চেষ্টা করছি আমরা। নানা মানুষের নানা চিন্তার বিকিরণে আমরা এখন আবদ্ধ। তবে হতাশা সুযোগ পেলেই আমাদের ঘিরে ধরে। আমরা তবুও অনুভব করি চারপাশে জীবনের উত্তাপ,মানুষের চলাচল আর বাতাসে জীবনের গন্ধ!
এই বর্তমান জীবন এখন আমাদের অনেকটাই সয়ে গেছে। কিছুদিন স্কুল কলেজ বন্ধ ছিল, এবার এটাও খুলে দেয়া হল কারণ বাসায় এমন বন্দী থাকলে শিশুদের মানসিক বিকাশ ভয়ংকর ভাবে ক্ষতি হতে পারে । এ নিয়েও আমাদের মনে তুমুল চিন্তার ঝড়। বাচ্চারা আক্রান্ত হবার ভয়ে ভিতরে ভিতরে আমাদের হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠে ! তবুও সব ভাগ্যের উপর ছেড়ে আমরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠালাম। এমন বাড়ি আটকা থাকতে থাকতে, আমরা বড়রাও নানা মানসিক সমস্যায় ভুগছি। আমাদের সচেতন মন ভাল থাকার চেষ্টা করলেও , অবচেতন মনে এর বিরূপ প্রভাব স্পষ্ট। মানুষ মানুষের কাছাকাছি আসতে পারে না , আসলেই ভাইরাস দ্রুত ছড়াতে থাকে। এর প্রতিরোধ হিসেবে আমাদের ঘরে থাকা চাই। কিন্তু মানুষ এমন করে আর কতদিন মানুষ থেকে দূরে থাকবে ? এ তো প্রকৃতি বিরুদ্ধ আচরণ! এ নিয়ম মানা বড় কষ্টের।
প্রতিদিন চারপাশের ঘটে যাওয়া মৃত্যু আমাদের ভারাক্লান্ত করে। হতাশা এসে আমাদের সব সুখ কেড়েকুরে নেয়। চিন্তিত মনে জীবনের প্রতিদিনের যাপিত সুখ গুলো নতুন করে উপলব্ধিতে ধরা দেয়। আমরা হয়ত বুঝতে পারছি আমদের পরিবার, বন্ধু বান্ধব আর চারপাশের মানুষজন আমদের প্রতিদিনকার জীবনে, কতই না সুখ নিয়ে জড়িয়ে থাকত!
এত কিছুর পরেও প্রতিদিন রোদ এসে আমাদের দরজায় কড়া নাড়ে। মানুষ যে যার মতো বাঁচার চেষ্টা করে। আজও প্রতিটি সকাল এসে বলে যায় , আমরা বেঁচে রয়েছি! আজও জীবন প্রতিনিয়ত আমাদের ভীষণভাবে বাঁচার তাগিদ দেয়। এই তাগিদ এড়ানো অসম্ভব কারণ একটা মহামারী থেকেও আমাদের এই মহার্ঘ জীবন হাজার গুন বেশী মূল্যবান!
করোনা এবং জীবন |||| আলিফ আলম, কথা সাহিত্যিক, মন্ট্রিয়ল