পূর্ব প্রকাশের পর…
আমার দেখা ভিয়েতনাম |||| আবুল জাকের | দ্বিতীয় পর্ব
এর পর “পাপেট শো” তে যাওয়া। “থাং লং ওয়াটার পাপেট” শো। খুব পপুলার এখানে। টুরিস্টদেরকে নিয়ে যায়। গাড়ী ছিল দূরে। তাই বেশ খানিকটা হাটতে হোল। পাপেট শো টা ভিয়েতনাম কালচারের উপর। মিথোলজি নির্ভরশীল। উপাস্থপনা ও পরিবেশনা অপূর্ব। কালারফুল। বাচ্ছাদের জন্য খুব মজার। প্রায় এক ঘন্টার শো। তবে আমার ও ভালো লেগেছে। এর পর ফিরে আসি হোটেলে। শাওয়ার নিয়ে সোজা বিছানে।
ভিয়েতনামের ইতিহাস নিয়ে একটু বলি। ৪০০০ বছর আগে এখানে মানব সভ্যতা গড়ে উঠে। রেড রিভার ডেল্টার দেশ, আবার আছে পর্বতমালা। আমাদের সুন্দরবনের মত জঙ্গল আছে। তা ছাড়া সরকার এখন নতুন নতুন মেংরুভ ফরেস্ট তৈরি করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকাতে। বাংলাদেশে আছে মাত্র একটা, তাও আবার ধ্বংসের মুখে। খৃষ্টের জন্মের ২৮৭৯ বছর আগে প্রথম মিথোলজি ভিত্তিক ভিয়েতনাম রাষ্ট্রের সুচনা হয়। “হুং” রাজারা বহুদিন রাজত্ব করে এখানে। চীনারা রাজত্ব করে প্রায় এক হাজার বছর ( ১১১ বিসি থেকে ৯৩৮ এ ডি)। ১৮৫৮ পর্যন্ত তাদের রাজারা তাদের দেশ শাসন করেছে। গাইড এর কাছ থেকে জানা। ভিয়েতনাম স্বাধীন হয় ১৯৪৫ সনে । ফারাসিরা শাসন করেছে ১০০ বছর। তারা এখানে আসে ১৮৫৮ সনে। কিছুদিন জাপান এদেরকে শাসন করে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর পর। পরিবর্তন শুরু হয় ১৯৩৯ সালে, যখন “হো চি মিন” কমুনিস্ট পার্টি ঘটন করে। ভিয়েতনামকে দু ভাগে ভাগ করা হয়। নর্থ ও সাউথ। নর্থ কম্যুনিস্ট ও সাউথ রিপাবলিক ফারাসিদের দখলে আবার। সাউথ আমেরিকানদের সাহায্য চায়। আমেরিকা যোগ দেয় কমুনিউনিসম দমাতে। ১৯৪৬ এ শুরু হয় আবার যুদ্ধ। আমেরিকানরা আসে ১৯৬৫ তে। সেই বর্বর যুদ্ধের ইতিহাস আমরা জানি। বর্বর আমেরিকানদের আগুনে বোমার (নাপাম) ব্যাবহার কারোর অজানা নয়। অনেক নাম করা ছবি হয়েছে এর উপর। আমেরিকানরা বাধ্য হয় চলে যেতে ১৯৭৩ সনে। ১৯৭৫ এ ভিয়েতনাম আবার এক হয়। কম্যুনিস্টরা সরকার ঘটন করে। কমিউনিস্ট যোদ্ধারা জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিল যুদ্ধের সময়। হো চিঁ মিন শহরের কাছে। যার নাম ছিল সায়গন। মাটির নিচে কয়েক লেয়ার তৈরি করে তারা থাকতো। “চু চু টানেল”। আগের বার ভিয়েতনাম যখন আসি, তখন দেখেছিলাম। একটা বিশাল শহর মাটির নীচে। তাদের জাতির জনক হো চি মিন। অবাক কান্ড ফারাসি ভাষার লেশ মাত্র কোথাও নেই দীর্ঘ দিন ফারাসি কলোনি হওয়া সত্ত্বেও। তবে আমেরিকান ডলার দিয়ে সবজায়গায় কেনাকাটা করা যায়।
এয়ারপোর্ট থেকে আস্তে আস্তে কথা হচ্ছিল। আগে যখন এসেছিলাম ( ২০০৪), তখন পুরানো বিমান বন্দর ছিল। এখন সবই নতুন। অবাক করা সুন্দর হাইওয়ে। রেড রিভার এর উপর চেয়ে থাকার মত সেতু। “নাট টান” সেতু। রেড রিভার পেসেফিক এর সাথে যুক্ত। রাস্তা নাম্বার করা । রাস্তা বেশ চওড়া ও বেশ সবুজ। মাইলের পর মাইল রাস্তার মাঝখানে ফুলের গাছ। ফুল ফুটে আছে। পুরো হাইওয়ে টাই একটা বাগান। রাস্তার নাম্বার দূরত্ব অনুসারে। নতুন নতুন রাস্তা হচ্ছে। এখন নির্মাণ কাজ চলছে ১৮০০ কিলোমিটার । চীন সীমান্ত থেকে হো চিঁ মিন সিটি। “হেলং বে” তে ২০০ কিলোমিটার বর্ডার আছে চীনের সাথে। বর্ডার ক্রস করতে কিছু দেখাতে হয় না। কয়লা ব্যবসা প্রধান। তাকে ওরা “ব্লেক গোল্ড” বলে। তাই রেডস্টার একটা বড় শহর হয়ে উঠেছে। হেনয় থেকে ২০০ কিলোমিটার ।
রাস্তার পাশে পাশে কবর স্থান দেখে জানতে চাইলাম কি করে ওরা। ওরা তো প্রধানত বুদ্ধিস্ট। প্রথমে তারা কফিনে কবর দেয়। কয়েক বছর পর হাড্ডি বের করে আবার কবর দেয় । ওটাই তাদের শেষ কবর। তবে বার্ন করার সিস্টেম ও আছে। রাস্তার ধারের একই রকম দালান দেখে জানতে চাইলাম এর কারন। জানালো সরকার থেকে এই ভাবে জমি দেয়া হয় শহরে। সাবালক সবাই পায়। দালান হবে ৫ মিটার প্রস্থ ও খুব সম্ভব ২০ মিটার লম্বা। তিন বা চার তালা হবে। নিজ তলা পারিবারিক ব্যাবসার জন্য। উপর তলাগুলো বাস করার। প্রত্যেক পরিবারকে কৃষি জমি দেয়া হয়। কোপারেটিভ পরিচালনা করে।
হোটেলে ফিরে আসি পাপেট শো এর পর। বেশ ক্লান্তি লাগছিল। গরম জল দিয়ে স্নান করে নিলাম। তার পর বিছানা ও ঘুম। সকালে উঠতে হবে। যাবার কথা “হেলং বে” তে।
ঘুম ভাঙল ৮ টায়। মুখহাত ধুয়ে নাস্তার টেবিলে। ডাইনিং হল একদম উপরে। দেখি হল ভর্তি লোকজন। প্রচুর খাবার। ডিমের সাদা অংশ দিয়ে অমলেট করতে বলে টেবিলে বসলাম এক কাপ কফি ও পানি নিয়ে। প্লেটে তখন দু টুকরো পাওয়ারুটি, মাখন ও একটি পেন কেক। খেতে খেতে ডিম এসে গেলো। রুটি ও ক্রসা দিয়ে ডিম সাবাড় করলাম। সাথে ফল। আমাদের দেশের চাপা কলার মত কলা পাওয়া যায়। পাকা পেপে ও আছে। আর এক কাপ কফি খেয়ে উঠে আসলাম রুমে। ১০ টায় গাইড আসবে। কাপড় পড়ে নেমে গেলাম নিচে। দেখি গাইড বসে আছে। রওনা হলাম “হেলং বে” এর দিকে।
ইউনেস্কো ১৯৯৪ এর দিকে এটাকে হেরিটেজ সাইট হিসাবে নিয়েছে। ভিয়েতনামের উত্তরপূর্বে। প্রায় ৬০০ স্কোয়ার মাইল। ইতিহাস বলে ১০০০০- ৫০০০ বি সি থেকে এখানে বসতি ছিল। এ রকম একটা হতে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বছর লাগে। আর লাইম স্টোনের যে শত শত টিলা রয়েছে এমনটি হতে লাগে ২০ মিলিয়ন বছর। সবই লাইম স্টোনের। বর্তমানে এই টিলাগুলোতে প্রায় ১৬০০ লোক বাস করে। থাকে ভাসন্ত বাড়ীতে। এরা সবাই ওখানকার মানুষ। একটা আলাদা গোত্র বলা যায়। দেখতে চীনাদের মত। বেশ হাসি খুশী। সরকার এখন তাদের পুনর্বাসন করছে ধীরে ধীরে উপসাগরের পাড়ে। “হেলং বে” কে রক্ষা করার জন্য। কিছু ভাসমান জেলেদের রেখে দিয়েছে পর্যটন শিল্পকে মাথায় রেখে। তবে এটা দেখতে গেলে দল বেধে গেলে হবে না। আমরা যেমন ৬ জন গিয়েছিলাম একটি জাহাজে। তাতে সময় নিয়ে দেখা যায়। তাড়াহুড়া থাকে না। কমপক্ষে এক রাত থাকতে হবে আধুনিক বজরায়।
যাবার পথে গাইড একটা শামুক থেকে পার্ল তৈরির কারখানায় নিয়ে যায়। জাপান ও ভিয়েতনাম সরকারের যৌথ প্রোজেক্ট। ওরা পার্ল তৈরি করে শামুককে ব্যবহার করে। সুন্দর করে দেখাল কেমন করে তারা এই কাজ করে। জীবন্ত শামুক নিয়ে কাজ। শামুককে কেটে ভিতরে সীড বসানো হয়। তার পর এন্টিসেপ্টিক দিয়ে আবার বন্ধ করে দেয়। পুরো কাজটা শেষ করতে হয় আধ ঘণ্টার মাঝে। নইলে শামুক মরে যাবে। । তারপর একটা বড় মেষের কয়েক লেয়ার ট্রেতে করে হ্রদের জলে চুবিয়ে রাখে। দু থেকে পাঁচ বছর লাগে পার্ল তৈরি হতে। দু বছরে যে গুলো তুলে সে গুলো সাদা, আর ৫ বছরে যে গুলো তুলে সে গুলু “ব্লেক পার্ল”। মাঝের গুলি মিক্স কালার বা পিংক। সবচেয়ে দামী হচ্ছে কালো পার্ল। একটি সাদা পার্লের নেকলেস ৬০০ থেকে ১০০০ ইউ এস ডলার। কালোগুলোর দ্বিগুণ দাম। আমি একটি হাল্কা পিংক কালারের নেকলেস কিনলাম ৭৫০ ডলার দিয়ে। আমার জীবন সাথীর জন্য। কোথায় বেড়াতে গেলে ওর জন্য কিছু কেনা এটা আমার পুরানো সখ। পার্ল গুলী বেশ বড় ও সুন্দর।
বাথরুম সেরে সেখান থেকে যাত্রা এখন “হেলং বে” এর দিকে। দুপুর ১২ তার দিকে পৌছাই সেখানে। একটু দেরী হোল জাহাজ পেতে। ছোট জাহাজ। কিন্তু সুন্দর। পুরো শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। যাত্রী বেশী নয়। আমি, ভারত থেকে একজন, মায়ানমার থেকে ৩ জনের এক পরিবার (ন মিলার) ও একজন সাধু। আমার ও ভারতের যাত্রীর মাঝে মজা হোল রুমের চাবি নিয়ে। আমাকে বলল আপনি আগে নিন। আমি ভারতীয়কে বললাম আপনি আগে নিন। পরে মুচকি হেসে গাইড ঠিক করে দিলো। প্রথমে ভারতীয়কে নিতে বললাম। আমি নিলাম পরে । গাইড হেসে বলল আপনার টা বেস্ট রুম। ভারতীয় সে ভদ্রলোকের নাম রহমতুল্লাহ। প্রফেসার, টুরিস্ম। মায়েনমার থেকে আসা ভদ্রলোকের নাম “ন মিলার”। ইয়উং কাপল। সাথে ১৪-১৫ বছরের ফুটফুটে মেয়ে। এরা এখন আমার ফেইচ বুক ফ্রেন্ড।
বোটে উঠার ১ ঘণ্টার মাঝে দুপরের খাবারের ঘণ্টা বাজল। মুখ হাত ধুয়ে তিন তলার খাবারের ডেক এ গেলাম। সুন্দর ডাইনিং হল। শীততাপনিয়ন্ত্রিত সবটাই। খাবার বেশ ভালই ছিল। ফুল কোর্স লাঞ্চ। শাক সবজি, সাগরের মাছ ছিল। সালাদ ছিল। খেতে অসুবিধা হয় নি। খাবারের পর বিশ্রাম। বিকেলে আবার বেরোতে হবে। জাহাজ কিন্তু চলছে তখন উপসাগরের এর বুক চিরে। বেশ কিছু জাহাজকে দেখলাম “বে” তে। মাছ ধরার নৌকো ছিল অনেক। পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেরিয়েছে তারা। লোকাল লোক। অপূর্ব লাগছিল লাইম স্টোনের ছোট ছোঁট টিলা। মনে হচ্ছিল কেউ সুন্দর করে ছবি একেছে পানির ভিতর। জোয়ার ভাটা আছে। পানির দাগ দেখে বুঝা যায়। আমরা যাচ্ছিলাম ফিশিং ভিলেজের দিকে। “বুং ভু” ফিশিং ভিলেজ। একটি স্টেসানে যেয়ে আমরা থামলাম। “বাই তু লং” বে তে। এখান থেকে সাম্পান বা নৌকা নিতে হবে। আমরা কয়জন নৌকা নিলাম। আমাদের দেশী নৌকার মত। ঘণ্টা খানিক ভেসে বেরালাম উপসাগরে। দেখলাম কেমন করে ওরা কাজ করে। ভাসমান বাজার। মনে রাখার মত দুটো জিনিস। কোথাও কোনও ময়লা নেই পানির উপর। পলিথিন ব্যাগ বা ঠোংগা একটাও চোখে পড়েনি। পরিষ্কার গভীর নীল জল। আর একটা জিনিস শেখার মত। ভাসমান ডাস্ট বিন। জেলেরা ওখানে ময়লা রেখে যায়। সরকার সময় মত ক্লিয়ার করে। আমি আগে কখনো পানিতে ডাস্টবিন দেখিনি। আমাদের দেশে কবে আসবে এই সব। হয়তো কোন দিন নয়। লাইম স্টোনের টিলা গুলো দেখে মনে হয় হাজার হাজার বছর ধরে তারা নিজেকে সাজিয়েছে এ ভাবে। জেলি ফিস দেখলাম বেশ কয়টা। বেশ বড়। সাদা। ছবি তুলেছি। কিন্তু খুব ভালো হয় নি। এই প্রথম বিষাক্ত জেলি ফিস দেখলাম। আমরা ফিরে আসলাম এক ঘণ্টা পর।
বিকেল ৬ টায় ডেক এ আসতে হবে । টপ ফ্লোর। চার তালায়। কুকিং ক্লাস। দেখাবে কেমন করে ভেজিটেবেল স্প্রিং রোল বানাতে হয়। একদম স্ক্রাচ থেকে। গরম গরম রোল, ডেক এর উপর, সূর্য অস্ত যাচ্ছে, যদিও কিছু মেঘ ছিল আকাশে। সব মিলে এক চমৎকার অনুভূতি। এই পরিবেশ আর কখনো পাবো কিনা জানিনা। বয়স তো বাড়ছে। জেসমিন সাথে থাকলে আরও ভালো লাগতো। কিন্তু জীবন তো যা চায় তা দেয় না। এ এক অদ্ভুত চলার পথ। সবটুকু পথই তো অচেনা, অজানা। অচিন পথের আরশি নগরের মত।
চলবে…
আমার দেখা ভিয়েতনাম |||| আবুল জাকের | দ্বিতীয় পর্ব লেখকঃ পাস্ট ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ। মন্ট্রিয়ল, কানাডা।
লেখকের অন্যান্য ভ্রমণ কাহিনী….
আমার দেখা ভিয়েতনাম ১ |
আমার ভূটান দেখা |||| আবুল জাকের || পর্ব ১ আমার ভূটান দেখা |||| আবুল জাকের || পর্ব ২ আমার ভূটান দেখা |||| আবুল জাকের || পর্ব ৩
এস এস/সিএ