পূর্ব প্রকাশের পর…
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার
৭৪ এর মন্বন্তর একটা গভীর ক্ষত রেখে যায় সাধারণ মানুষের মনে। দেশে বিদেশের স্বাধীনতা বিরোধী চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। মাঠে ঘাটে অনেক কথা ঘুরে বেড়ায়। প্রতিদিন দুপুরের দিকে একটা লোকাল ট্রেন বাজার স্টেশনে থামে। ঐ ট্রেনে আসে গ্রাম গঞ্জ থেকে অভাবী মানুষ ছোটখাটো সোনার গহনা নিয়ে। সোনার দোকানীরা সাড়া দিন ঐ ট্রেনটার জন্য অপেক্ষা করে থাকে।
আমি মাঝে মাঝে স্কুল ফাঁকি দিয়ে বাবার সাথে দোকানে বসি। গ্রাম থেকে আসা সরল সহজ মানুষগুলো অকাতরে বলে যায় বিভিন্ন সমস্যার কথা, চুরি ডাকাতি, নিরাপত্তা হীনতাসহ সরকারের ব্যর্থতার কথা উঠে আসে। স্বাধীনতার মুক্ত বাতাস আর আগের মতো অনেককেই স্পর্শ করে না, ভগ্ন স্তূপের উপর দাড়িয়ে থাকা একটা দেশকে বিনির্মাণের কর্মযজ্ঞ অনেকের চোখে ম্লান হয়ে ধরা দেয় । সরকারের ব্যর্থতা, জাতীর পিতাকে নিয়ে অনেকের সন্দেহ ও কটূক্তি আমায় দারুণ ভাবে ব্যথিত করে। রাজনীতি বুঝি না, দেশী বিদেশী চক্রান্তের মর্মার্থ বুঝি না। তবে একটাই বুঝি তা হোল আমরা বদলে যাচ্ছি।
বিকেল হোলে বয়োজ্যেষ্ঠরা বড় বাড়ীর উঁচু সান বাধানো পৈঁঠায় দল বেঁধে বসে থাকে। একটা খবরের কাগজকে ঘিরে ওদের আড্ডা জমে ওঠে। সে আড্ডার মুখ্য বিষয় হল রাজনীতি। আমরা ছোটরা দূর থেকে দেখি। কাছে যেতে মানা, কারণ রাজনীতি হোল বড়দের বিষয়। তখনকার দিনে আমরা সমস্ত অঞ্চল জুড়ে একটা একক পরিবারের মত বাস করতাম। আমাদের প্রতিবেশীদের মাঝে কোন সীমানা রেখা ছিল না। কারোকে দাদা, কারোকে বোন, কারোকে চাচা, কারোকে চাচী বলে নিকট আত্মীয়ের মতো জড়িয়ে থাকতাম। বয়োজ্যেষ্ঠদের ছিল আমাদের উপর নিরঙ্কুশ অধিকার। শাসনে, আদরে, ভালবাসায় কক্ষনো এখনকার মতো একা হয়ে যাইনি। ঘর থেকে অবেলায় বেড় হতে গেলেই ভাইবোনদের সম্মুখীন হতে হতো ঐ পৈঠায় বসে থাকা অভিভাবকদের অজস্র প্রশ্নের। কোথায় যাও, কেন যাও, কখন ফিরবে, এ সব উত্তর দিতে দিতে মাঝে মাঝে এ অধিকারকে ভালবাসার অত্যাচার বলে মনে হতো।
সেদিন বিকেলে বেড় হয়েছি। যেন অনাকাঙ্খীত প্রশ্নের উত্তর দিতে না হয় তার জন্য মাথা নিচু করে হেটে চলেছি। আজও সেই একই জটলা তবে আগের চেয়ে অধিক। আজ কেউ কোন প্রশ্ন করে না। আমি এগিয়ে যাই জটলার দিকে। সবাই ফিস ফিস করে কথা বলে। অকস্মাৎ বড় বাড়ীর ভেতর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। আমরা যাকে কাকীমা বলে ডাকি, যিনি পরম স্নেহে আমাদের জড়িয়ে রাখেন, তার কান্না আমায় বিচলিত করে। পরে বুঝতে পারি বাড়ীর জমিদার কর্তাকে রক্ষী বাহিনী চরম নির্যাতন করে ছেড়ে দিয়েছে। সাড়া গায়ে সিগারেটের ক্ষত। অপমানে অভিমানে মানুষটা একদিনে অনেকটা বুড়িয়ে গেছেন। শুনেছিলাম স্থানীয় পাওয়ার হাউজে রক্ষীবাহিনী ক্যাম্প গেড়েছে। অনেক জায়গায় অভিযোগ বাক্স রাখা আছে। সেখানে অভিযোগ পত্র পেলেই তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এক পারিবারিক কোন্দলের শিকার হয়ে জমিদার কর্তাকে এ অপরিসীম নির্যাতনের শিকার হতে দেখে রক্ষীবাহিনী আমার কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ধরা দেয়। জমিদার কর্তা এ অপমানের গ্লানি বেশীদিন সহ্য করতে পারলেন না। একদিন তিনি চলে গেলেন সবাইকে ছেড়ে পরপারে। রক্ষী বাহিনীর সীমাহীন বর্বরতা, নিপীড়ন, নির্যাতনে অনেকেই ক্ষুব্ধ, কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলে না। আমাদের মধ্যে কেউ বেশী দুষ্টুমি করলে রক্ষী বাহিনীকে দিয়ে সায়েস্তা করা হবে – এ কথাটা সেসময় খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে।
আমরা আস্তে আস্তে এক কঠিন সময়ের দিকে এগিয়ে চলি। মাঝে মাঝে আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে আনন্দের ঢেউ আসে। সেদিন আমাদের স্কুল নতুন সাজে সেজেছে। রঙ্গিন তোরণ, ফেস্টুনে ফেস্টুনে একাকার। আমাদের স্থানীয় একজন জন প্রতিনিধি মোতাহার হোসেন তালুকদার ( যিনি পরবর্তীতে গভর্নর মনোনীত) সদ্য রাষ্ট্রীয় সফরে রাশিয়া থেকে ফিরেছেন। উনি আসছেন স্কুল পরিদর্শন করতে। আমরা সেদিন সবাই ভাল জামা কাপড়, জুতো পড়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছি। আমার পরনে সেদিন সেই সবুজ জামা। প্রতি ক্লাস থেকে যারা প্রথম তাদের নিয়ে একটা দল গঠন করা হয়েছে। আমাদের বিশেষ দায়িত্ব উনাকে ফুলের স্তবক দিয়ে অভিবাদন করা। উনাকে ফুল দিতেই উনি আমার মাথায় হাত রাখলেন। স্নেহ ভরে বললেন তুমি কার ছেলে? বাবার নাম বলতেই তিনি আপন জনের মতো বললেন তুমি ফনীবাবুর ছেলে! আমার বাড়ী প্রতিদিন যাবে, লাবুর সাথে খেলবে, পড়ালেখা করবে। এতোবড় একজন ব্যক্তিত্বের এমন কথা শুনে আমি এক মুহূর্তে অনেক বড় হয়ে গেলাম। যারা আমায় চেনে না, তারা আমায় বিশেষ করে চিনলো। সেদিন সেই বিশেষ পরিচয়ের কল্যাণে সকলের চেয়ে অনেকটা বেশী বিলেতী দুধ পেয়েছি (তখন স্কুলে প্রায় প্রায়ই কাগজের ঠোঙ্গায় মেয়াদ উত্তীর্ণ মিল্ক পাউডার বিতরণ করা হতো। স্থানীয় ভাষায় আমরা বিলেতী দুধ বলতাম )। পকেটের আনাচে কানাচে সেই গুড়ো দুধ কিছু পুরে কিছু মুখে পুরে বাড়ী ফিরে আসি বিজয়ী হয়ে…
চ ল বে ….
লেখকের স্মৃতিচারণের অন্যান্য পর্বগুলি দেখতে হলে
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ১ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৫ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৬ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৭ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৮ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৯ | সুশীল কুমার পোদ্দার
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ১ | সুশীল কুমার পোদ্দার
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
এস এস/সিএ
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন