বাংলাদেশি শহীদের দুবাইয়ে ফ্রন্টলাইন হিরো হবার গল্প
তারিক চয়ন || করোনাভাইরাসের আক্রমণে ধুকছে গোটা বিশ্ব। প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন অনেক মানুষ। এ থেকে মুক্ত নয় সংযুক্ত আরব আমিরাতও। প্রায় ৯৮ লক্ষ জনসংখ্যার দেশটিতে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় চার লক্ষ বিশ হাজার মানুষ। মারা গেছেন প্রায় চৌদ্দশো রোগী। অন্যদিকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ মানুষ যেখানে মারা গেছেন প্রায় সাড়ে ৮ হাজার রোগী। সুতরাং আক্রান্তের হিসেবে এশিয়ার দেশ আরব আমিরাতে তুলনামূলকভাবে অনেক কম মানুষই মারা গেছেন বলতে হবে।
সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কর্মসূত্রে পাড়ি জমিয়েছেন ২৩ লাখ ৭০ হাজার বাংলাদেশি, যা বাংলাদেশের মোট জনশক্তি রপ্তানির প্রায় ১৯ ভাগ। যদিও দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানি এখন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে তারপরও অগুণিত প্রবাসী বাংলাদেশি সেখানে দিনরাত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে অর্জিত অর্থ দেশে (রেমিট্যান্স) পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছেন।
তাদের মধ্যে এমনও অনেকে আছেন যারা অর্থের পাশাপাশি দেশের জন্য বয়ে আনছেন সম্মান, ঘোর বিপদের দিনে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সংশ্লিষ্ট দেশকে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে করছেন সাহায্য। তেমনি একজনের নাম মোশাররফ হোসেন শহীদ। গাল্ফ নিউজের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিদেশের বুকে গর্বিত বাংলাদেশি শহীদের গল্প।
গত বছরের ২৪ শে এপ্রিল ৩৮ বছর বয়সী শহীদ আরব আমিরাতের দুবাই পৌরসভার জুমেইরাহ জেলার রাস্তা জীবাণুনাশক করতে ফ্রন্টলাইনার হিসেবে প্রতিদিনের মতো একটানা ১৬ ঘন্টা কাজের মধ্যে ছিলেন। তখন দেশটিতে করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ঠিক ওই সময়ে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় শহীদের স্ত্রী তাদের তৃতীয় সন্তান প্রসব করছিলেন। শহীদ বলছিলেন, “আমি আগেই জানতাম যে গ্রামে আমার সন্তানের জন্মের সময়টা আমি মিস করব। কিন্তু এখানে জীবাণুমুক্ত করাটাও ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং আমার এখানে থাকা দরকার ছিল। আমার পরিচালকরা আমাকে করোনার প্রকোপ থেকে রক্ষার জন্য গঠিত টাস্কফোর্সে কাজ করতে বললে মার্চ মাস থেকেই কাজে নেমে পড়ি। কাজটা করতে অনেক সময় লাগতো এবং একটানা করতে হতো। কিন্তু আমি এই জীবাণুমুক্তকরণ টিমে ফ্রন্টলাইনার হিসেবে কাজ করে সম্মানিত বোধ করি। আমাকে দুবাইয়ের দরকার ছিল, আর আমিও কাজের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম। ”
সারাদিন কাজ আর সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর জন্য দোয়া
যেদিন শহীদের স্ত্রীর প্রসববেদনা উঠলো, সন্তানের জন্ম হলো, সেদিন তিনি সারাদিন তার জন্য দোয়া করছিলেন। রাতে নিজের থাকার জায়গায় ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি স্ত্রীর সাথে কথাও বলতে পারেননি। “আমি যখন ওর সাথে কথা বলতে পারলাম এবং জানলাম ও আর আমার নবজাতক কন্যা ভালো আছে, তখন কি যে শান্তি পেলাম! বাড়িতে আমার নতুন বাচ্চা এসেছে এবং সেই সময় আমি দুবাইতে মহামারীর সাথে লড়াই করছি ভাবতে ভাবতে সে রাতে আমি আনন্দে ঘুমিয়ে গেলাম।”
জানা গেছে, শহীদ সেইসব ফ্রন্টলাইনার স্বেচ্ছাসেবক এবং পেশাদারদের মধ্যে একজন, যারা মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার করার জন্য ‘ফ্রন্টলাইন হিরোস অফিস’ থেকে স্বীকৃটি এবং সমর্থন পেয়েছেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে তিনি দুবাই পৌরসভার জরুরী কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ বিভাগে কাজ করতেন। ২০০৬ সাল থেকে তিনি সেখানে কাজ করছেন।
শহীদের ফ্রন্টলাইন হিরো হওয়ার গল্প
করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়লে শহীদ দেশটির জাতীয় জীবানুমুক্তকরণ কর্মসূচিতে অংশ নেন। প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তিনি একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় নাম লেখান যেখানে ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত সুরক্ষার পাশাপাশি জীবাণুনাশক রাসায়নিক মিশ্রণ ও প্রয়োগের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
প্রতিটি শিফট মাস্ক, গ্লাভস, মুখের শিল্ড এবং অন্যান্য পিপিই সহ ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম ব্যবহার দিয়ে শুরু হতো। বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে তারা শহরের রাস্তা, দালানকোঠাকে জীবাণুমুক্ত করতে নেমে পড়তেন, যখন শহরের বাকি বাসিন্দারা কার্ফিউর সময় ঘর থেকে বের হতেন না। তারা (শহীদ ও অন্যরা) অলিগলিতে জীবাণুনাশক রাসায়নিক স্প্রে করতে যানবাহন বা বাইকে চলাচল করতেন। কখনও কখনও তারা ড্রোনও ব্যবহার করতেন। “কাজটা খুব কঠিন ছিল, তবে আমি নিজেকে মনে করিয়ে দিতাম যে কাজটা কতোটা জরুরি এবং এই দেশ আমাকে যে সুযোগ দিয়েছে তার জন্য আমি তার কাছে কতোটা ঋণী। তাই আমি দিনের পর দিন এবং রাতের পর রাত কাজটা চালিয়ে গেছি”, শহীদ বলছিলেন।
তীব্র গরমে প্রচন্ড পরিশ্রমের মাঝেই রোযা রাখা
এপ্রিল এবং মে মাসে মহামারীটি প্রথম খুব বেড়ে যায়। তখন রমজান মাসও শুরু হয়। শহীদ এ বিষয়ে বলেন, “দুবাইয়ের ক্রমবর্ধমান উত্তাপ আর আর্দ্রতাও ছিলই, সেই সাথে আমি রোযাও রাখছিলাম। সূর্যাস্তের সময় আমরা একসাথে বসে সামান্য কিছু খেয়ে রোযা ভাঙ্গতাম। ইফতার শেষে আমরা আবারো রাস্তা পরিষ্কারের কাযে নেমে পড়তাম। আমার দ্বারা যা করা সম্ভব তা করতে আমি দৃড়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। আমি এই দেশের কাছে অনেক ঋণী।”
শহীদ স্বীকার করেন যে, তিনি বাড়িতে ফিরে তার প্রিয়জন এবং নবজাতক কন্যাকে প্রথমবারের মতো দেখার জন্য ব্যকুল হয়ে আছেন, সেইসাথে তিনি এটাও বলেন যে আরব আমিরাতের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করতে এবং তার পরিবারের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে তিনি বদ্ধপরিকর, “বিশ্বের সবাই করোনায় আক্রান্ত। তাই এই লড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সবাইকে লড়ে যেতে হবে। আমি সেই দিনের স্বপ্ন দেখি যেদিন আমি আমার কন্যাকে নিজ হাতে ধরতে পারবো। কিন্তু সেই পর্যন্ত আমি আমার কাজও চালিয়ে যাবো।”
-সূত্রঃ মানবজমিন
এস এস/সিএ