ভ্রমণ

শিমুলের লাল আভায় একদিন |||| সুমন্ত গুপ্ত

শিমুলের লাল আভায় একদিন |||| সুমন্ত গুপ্ত

সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়ার মাধ্যম হলো মোটরবাইক। তবে হিউম্যান হলারে করে যেতে পারবেন তাহিরপুরের শিমুল বনে। আমি, মাফুজ আর নাম না জানা মোটরসাইকেলচালক রওনা দিলাম। চারপাশের সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ। আমাদের পাইলট মহোদয় দ্রুতগতিতে ছুটে চললেন। আর আমি মোটরসাইকেলে বসেই ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। লাউরের গড় বিজিবি কাম্পের কাছে আসতেই দূরে দেখা গেল লাল টকটকে শিমুল বন, সঙ্গে অপরূপ জাদুকাটা। যেন আগুন লেগেছে সে বনে।

আজকাল অনেকেই এক দিনের ভ্রমণ-গন্তব্য খুঁজে ফেরেন। যাদের কাজের ব্যস্ততার মাঝেই হঠাৎ পাওয়া ছোট ছোট অবসর উপভোগ করে নিতে চান। এমন ভ্রমণপিপাসুদের জন্য প্রিয় গন্তব্য হতে পারে তাহিরপুরের শিমুল বন। ফেসবুকের কল্যাণে গন্তব্যটি এখন জনপ্রিয়ও বটে। আমাদেরও এবারের গন্তব্য এই শিমুল বন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমরা এসে পৌঁছলাম সুনামগঞ্জ শহরে। নতুন ব্রিজের কাছে এসে দেখতে পেলাম মোটরসাইকেলের লাইন। বলে রাখা ভালো, সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়ার মাধ্যম হলো মোটরবাইক। তবে হিউম্যান হলারে করে যেতে পারবেন তাহিরপুরের শিমুল বনে। আমি, মাফুজ আর নাম না জানা মোটরসাইকেলচালক রওনা দিলাম। চারপাশের সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ। আমাদের পাইলট মহোদয় দ্রুতগতিতে ছুটে চললেন। আর আমি মোটরসাইকেলে বসেই ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। লাউরের গড় বিজিবি কাম্পের কাছে আসতেই দূরে দেখা গেল লাল টকটকে শিমুল বন, সঙ্গে অপরূপ জাদুকাটা। যেন আগুন লেগেছে সে বনে। তবে তখনো পথ বেশ দূরের। আমাদের পাড়ি দিতে হবে জাদুকাটা নদী। নদীতে পানি কম, যত দূর চোখ যায় ধু-ধু বালুচর। প্রখর রোদ। আমরা মোটরসাইকেল থেকে নেমে জাদুকাটা নদীর শীতল পরশ বুলিয়ে নিলাম। নদীর ওপাশেই সবুজ বারিক টিলা। তারপর কুয়াশায় মোড়ানো মেঘালয় পাহাড়। বর্ষার দিনে সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে এই নীল নদীটি বয়ে যায়। জাদুময় জাদুকাটা নদী দেখতে পর্যটকরা তখন ভিড় করেন। তবে ফাল্গুন মাসে নদীর তল ঘেঁষে প্রায় এক মাইল হেঁটে আমরা পৌঁছলাম শিমুল বনে। টকটকে লাল শিমুল ফুলে ছেয়ে গেছে পুরো বাগান। এক ডাল থেকে অন্য ডালে খুনসুটিতে ব্যস্ত পাখিরা। বাসন্তী হাওয়ায় নতুন প্রাণের স্পন্দনে প্রকৃতি। ১৪ বছর আগে ২ হাজার ৪০০ শতক জমিতে এই শিমুল বাগান গড়ে তোলেন জয়নাল আবেদীন। মাত্র ১২ বছর বয়সে জয়নাল আবেদীন তার পরিবারের সবার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভৈরব থেকে সুনামগঞ্জের বিচ্ছিন্ন জনপদ বাদাঘাট ইউনিয়নের সোহালা গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি ছিলেন উদ্যমী। সংগ্রামমুখর জীবনে অল্প বয়সেই ইতি টানেন পড়ালেখার। নানা পেশা বদলে একসময় জড়িয়ে পড়েন মৎস্য ব্যবসায়। নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ইনল্যান্ড ফিশারিজের মাধ্যমে ইজারা নেন টাঙ্গুয়ার হাওর। আবার বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। কিন্তু শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যে মন ভরল না তার, ইচ্ছা আরো কিছু করার। যা মানুষের কল্যাণে আসবে। গাছপালার প্রতি তার অপরিসীম মমতা। গাছ লাগাতেই তিনি বেশি পছন্দ করেন। তার এই পছন্দের সঙ্গে একাত্ম হলো তাহিরপুরের সাধারণ মানুষের ভাবনা।

সারাক্ষণ

হাওরাঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন কয়েকটি গুরুতর সমস্যায়। বর্ষা এলেই আমূল বদলে যায় এখানকার দৃশ্যপট। ঢেউয়ের তোড়ে প্রতিনিয়ত ভাঙতে থাকে পাড়। হাওরের আশপাশে যে কটি বাড়িঘর আছে সেগুলোও ঢেউয়ের তোড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন গুরুতর সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী! শেষ পর্যন্ত গ্রামের মানুষরাই ঠিক করে নিলেন তাদের করণীয়। শক্ত শিকড়-বাকড়ের জলসহিষ্ণু গাছপালাই এর একমাত্র সমাধান। সংখ্যায় কম হলেও এমন দু-একটি প্রজাতি সেখানে আগে থেকেই ছিল। যার অন্যতম হিজল এবং করচ। গলা সমান পানিতেও এরা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। কিছুদিন পর স্থানীয়দের এই ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হলো আরেকটি নতুন মাত্রা। এসব গাছের একাধিক উপযোগিতার মধ্যে তারা জ্বালানি সংগ্রহের গুরুত্বও উপলব্ধি করতে পারলেন। শুধু হিজল ও করচ লাগালেই একসঙ্গে অনেক সমস্যার সমাধান মিলবে। কিন্তু এই বিশাল কর্মযজ্ঞের শুরুটা কীভাবে, আর করবেইবা কে, স্থানীয় মানুষ যখন এসব নিয়ে ভাবছিলেন, তখন অনেকটা পরিত্রাতা হিসেবেই আবির্ভূত হলেন বাদাঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন। তিনি ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মোট ১৩ বছর টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায় ৯০ হাজার করচগাছ লাগিয়েছেন। পাশাপাশি হিজলগাছও লাগিয়েছিলেন বেশ কিছু। চারাগুলো সংগ্রহ করেছিলেন স্থানীয়ভাবেই। শুধু গাছ লাগিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। গাছের পুরো যত্নআত্তির দায়িত্বও নিজের কাঁধে নেন। শুকনো মৌসুমে নিজেই গাছে পানি দিতেন। একটানা ১৩ বছর তিনি সত্যিকার অর্থেই অসাধ্য সাধন করেছেন। টাঙ্গুয়ার হাওর যেতে দুই পাশে চোখ রাখলে যে কারোই মনে প্রশ্ন জাগবে, এমন বিচ্ছিন্ন জনপদে কোথা থেকে এল এত গাছ। কিন্তু তিনি আজ নেই। পৃথিবীর মোহমায়া ছেড়ে অনেক আগেই চলে গেছেন জয়নাল আবেদীন। কিন্তু রয়ে গেছে তার অনন্য কীর্তি। সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ টাঙ্গুয়ার হাওরজুড়ে তার সন্তানসম বৃক্ষগুলো এখন একদিকে যেমন প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়িয়েছে হাওরের সৌন্দর্য। আবার হাওরের মাটি সুরক্ষায়ও রাখছে বিরাট ভূমিকা। বলছিলেন ওই এলাকার প্রবীণ শেখর দাস। আমি আর মাফুজ পুরো এলাকা ঘুরে বেড়ালাম পদব্রজে। অসাধারণ পরিবেশ। এ যেন কল্পনার রঙে সাজানো এক শিমুলের প্রান্তর। ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, মাঝে জাদুকাটা নদী আর এপারে শিমুল বন। সব মিলেমিশে গড়ে তুলেছে প্রকৃতির এক অনবদ্য কাব্য। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। শিমুল বন তার সৌন্দর্যের ডালি মেলে ধরে তখন। সোনালি আলোতে লাল টকটকে ফুল এক মোহনীয় আবেশ তৈরি করে।

সারাক্ষণ

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে বাস অথবা ট্রেনে চলে যান সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জের নতুন ব্রিজের গোড়া থেকে বাইক অথবা লেগুনায় সরাসরি লাউড়ের গড় যেতে পারবেন। বাইকে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২০০ টাকা ও লেগুনায় ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা রিজার্ভ। চাইলে প্রাইভেট গাড়ি নিয়েও চলে যেতে পারেন লাউড়ের গড়। তারপর বালুচর দিয়ে হেঁটে চলে যান শিমুল বন।

ছবি: লেখক

সংবাদটি শেয়ার করুন