নাগাসাকির আগ্নেয়গিরিতে হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ | ড. শোয়েব সাঈদ
“আমি চঞ্চলও হে, আমি সুদূরেরও পিয়াসী—ওগো সুদূর, বিপুলও সুদূর তুমি যে বাঁজাও ব্যাকুলও বাঁশরী”। সুদূরের তরে এই ব্যাকুলতা মিশে আছে কবিগুরুর প্রাচ্য-প্রতীচীর আবাহনে বিশ্বভ্রমণের ব্যাপক কর্মযজ্ঞে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য আর বাংগালীদের আন্তর্জাতিক পরিচিতির ক্ষেত্রে কবিগুরু সক্রিয় ছিলেন দুটো ফ্রন্টে সমান্তরালভাবে; একটি সাহিত্যকর্মে, অন্যটি প্রায় শতবর্ষ আগে পাঁচটি মহাদেশের তিরিশটি দেশের বিপুল আন্তমহাদেশীয় বন্ধুবান্ধব ও তৎসংশ্লিষ্ট বিশ্বভ্রমণের বিরল কর্মে।
ছবি নাকি কথা বলে। কবিগুরুর ভ্রমণ বিষয়ে একটি ছবি তুলেছিলাম জাপানের নাগাসাকিতে; অতএব, “এমন দিনে তারে বলা যায়” কিভাবে তুলেছিলাম বলেই ফেলি।বিদেশীদের প্রতি ঐতিহাসিক এবং প্রথাগতভাবেই উদাসীন জাপানীজ সংস্কৃতি। মজার ব্যাপার হল বহিঃবিশ্ব সম্পর্কে উদাসীন এই জাপানীদের জাপান ৬ বার ভ্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
নেতাজি সুভাষ বসু আর রবিঠাকুর-এই দুই বঙ্গ সন্তানকে ইতিহাসের প্রতি অনুরক্ত জাপানীরা ভালভাবেই চেনেন এবং জানেন।
শ্মশ্রুমণ্ডিত রবিঠাকুর এবং তার সাহিত্য জাপানী বালক ইয়াসুনারি কাওয়াবাতাকে মুগ্ধ করেছিল একজন প্রাচীন ওরিয়েন্টাল যাদুকরের মতই এবং ইনি সেই কাওয়াবাতা যিনি ১৯৬৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পান প্রথম জাপানীজ হিসেবে কবিগুরুর হেঁটে যাওয়া পথ ধরেই।
জাপানের চারটি বড় দ্বীপের মধ্যে একটি কিয়ুশু দ্বীপ। মূলত দক্ষিন-পশ্চিম জাপান বলে পরিচিত এই কিয়ুশু দ্বীপ সাতটি প্রিফেকচার নিয়ে গঠিত। পূর্ব চীন সাগরের পূর্বতীরে অবস্থিত বন্দর নগরী নাগাসাকি হচ্ছে কিয়ুশু দ্বীপের সর্ব পশ্চিমের প্রিফেকচার যার অপর প্রান্তে আছে চীনের মেগাসিটি সাংহাই। এই হচ্ছে সেই নাগাসাকি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনবিক বোমার দ্বিতীয় শিকার।
এক সামারে ভাবলাম ক্যাম্পিং করতে সপরিবারে নাগাসাকি যাব। সামার ক্যাম্পিং মানে গ্রীষ্মকালে পাহাড় জংগলে তাবু খাঁটিয়ে রাত্রিযাপন। সামার ক্যাম্পিং কে আমি দেখি “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে” কিংবা “জোনাকির আলো নেবে আর জ্বলে শাল মহুয়ার বনে” বাংগালীর ঐসব চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষার জনপ্রিয় পশ্চিমা সংস্করণ হিসেবে।
হোতারু মাতসুরি বা জোনাকি উৎসব অর্থাৎ রাত জেগে পাহাড়-জংগল সংলগ্ন ডোবা-নালায় জোনাকি দেখার জাপানী প্রথাটি আবার খাঁটি ওরিয়েন্টাল সংস্কৃতিকেই প্রতিনিধিত্ব করে। হোতারু বা জোনাকির ৫১৬-৬১০ তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যের মোলায়েম আলোটি মূলত এনজাইম এবং অক্সিজেনের উপস্থিতিতে জোনাকির তলপেটে সংঘটিত বায়োলুমিনেসসেন্স নামক রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তৈরি হয়।
নাগাসাকির ঐ সামার ক্যাম্পিং এ আমাদের সহযাত্রী হলেন ওইতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ সায়েন্টিস্ট ড. রব্বানী ও ড. ফারজানা মার্নি (আমার ভাগ্নী) দম্পতি (বর্তমানে উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের উইস্কন্সিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন)। ওইতা থেকে ফুকুওকা আর সাগা প্রিফেকচার হয়ে কয়েকশ কিলোমিটারের সড়ক পথে নাগাসাকি যেতে পাহাড়, সমুদ্র, টানেল আর এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণশৈলীর নান্দনিকতায় দেখতে দেখতে সময়টা পার হয়ে যায়।
ক্যাম্পিং শেষে আনবিক বোমার স্মৃতি জড়িত পিস মেমোরিয়াল পার্ক হয়ে ভিন্ন পথে নাগাসাকি থেকে রওয়ানা হলাম দুটো কারণে। প্রথমত মাউন্ট উনজেনের হটস্প্রিং বা উষ্ণ প্রস্রবণ উপভোগ করা, অপরটি গাড়ি নিয়ে ফেরীতে উঠে পূর্ব চীন সাগরের জাপানের ইনল্যান্ড অংশ “আরিয়াকে সী” বা “শিমাবারা বে” পার হয়ে শর্টকাট পথে ওইতা ফিরে আসা।
মাউন্ট উনজেন, ৪৯২১ ফুট উচ্চতার এই আগ্নেয়গিরিটি জাপানের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নুৎপাতের জন্যে কুখ্যাত হয়ে আছে। ১৭৯২ সালে লাভার মেগাস্যুনামীতে পনের হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে। আবার জেগে উঠে এটি ১৯৯০ সালের দিকে এবং ৯১ সালের অগ্নুৎপাতে ৪৩ জনের প্রাণহানি ঘটে।
মাউন্ট উনজেনের পাদদেশে জাপানের সবচেয়ে প্রাচীন ন্যাশনাল পার্কটি অবস্থিত। ১৯১০ সাল থেকেই এটি বিদেশী পর্যটকদের জন্যে একটি আকর্ষণীয় স্থান এবং অনেক অত্যাধুনিক হোটেল, মোটেল আছে এলাকাটি ঘিরে। এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে উনজেন জিগকু বা হেল অর্থাৎ উনজেন দোযক।
এখানে সেখানে উষ্ণ প্রস্রবণের বুদবুদ। কোথাও ক্যালসিয়ামের আধিক্যে সাদা গরম পানি, কোথাও আয়রনের আধিক্যে লাল গরম পানি। সালফারের গন্ধ চারিদিকে। জীবাণুনাশক এবং ত্বক-বান্ধব গুণাবলীর জন্যে বিখ্যাত এ পানি। এ পানিতে কিছুক্ষণ চুবিয়ে রাখলে ডিম সিদ্ধ হয়ে যায় এবং সালফারের গন্ধ বিশিষ্ট এই ডিম খুবই স্বাস্থ্যকর এবং উপাদেয়।
জিগকুর খুব কাছেই একটি হোটেল ছিল আমাদের বিশ্রামের স্থান। হোটেলটির বাহিরের অবয়ব ট্র্যাডিশনাল জাপানী ধাঁচের এবং ভেতরটি অত্যাধুনিক। হঠাৎ হোটেলের সামনের বাগানের কালো স্টোনের উপর চোখ পড়ল ইন্ডিয়ান শব্দটি দেখে। দেখলাম লেখা আছে রবিঠাকুরের এই হোটেলে রাত্রি যাপনের কথা।
খুবই আশ্চর্য হলাম। জাপানের ৭৫ শতাংশই পাহাড়ি এলাকা এবং ৮০ শতাংশ জনসংখ্যার বসবাস পাহাড়বিহীন ২৫ শতাংশ এলাকায়। কবিগুরুর জাপান সফরের কথা বিশেষ করে নোবেল প্রাপ্তির পর ১৯১৬-১৭ এর দিকের সফরের কথা আমার জানা ছিল যার অধিকাংশই বড় বড় শহর কেন্দ্রিক। এই দুর্গম ভল্কানিক অঞ্চলে রবিঠাকুরের উপস্থিতি তাও আবার বিংশ শতাব্দির প্রথমাংশের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায়, আশ্চর্য হবারই কথা।
পরে জানলাম ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে রবিঠাকুর সাংহাই গিয়েছিলেন সিরিজ লেকচারে অংশ নিতে। লেকচার শেষে পূর্ব চীন সাগর পাড়ি দিয়ে জাপান আসা এবং মে মাসে নাগাসাকির এই দুর্গম অঞ্চল দিয়ে শর্টকাটে মূল ভূখণ্ডে যাবার সময় উনজেনের পাদদেশে এই হোটেলে ছিল কবিগুরুর রাত্রিযাপন।
নাগাসাকির দুর্গম এলাকায় হঠাৎ করে রবিঠাকুরের পরশে চমকিত হলেও অনুভূতিটা ছিল ভীষণ আবেগময়; এক বাংগালী সেলিব্রেটির পদধূলিটা ঐতিহাসিকভাবে বিদেশীদের প্রতি শীতল জাপানীরাও ভুলতে দেয়নি, বরং শ্রদ্ধা আর অহংকারে আগলে রেখেছে
লেখকঃ কলামিস্ট, অনুজীব বিজ্ঞানী, কানাডার একটি বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত।
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান