চীন-ভারত উওেজনা এবং হংকংয়ে চীন প্রণীত নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন | বিদ্যুৎ ভৌমিক || ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে Eesha Kheny ||ডিজাইন: সিবিএনএ
গত কয়েক দিনে গোটা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত স্তরে চিন-বিরোধিতার যে হাওয়া উঠেছে, তা স্বতঃস্ফূর্ত বলেই মনে করা হচ্ছে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা, জাপান, কোরিয়া, বৃটেন সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং আসিয়ানভুক্ত দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজেদের মতো করে বিশ্ব ব্যবস্থায় চিনের চরম আগ্রাসী ও অগনতান্ত্রিক মনোভাবের নিন্দা করছে গত দুই সপ্তাহে । আর এই সমালোচনার প্রসঙ্গে উঠে আসছে ভারত-চীন সীমান্ত পরিস্থিতি এবং হংকং । কিন্তু এ বার চীন-বিরোধী একটি অদৃশ্য ব্লক, নিজে থেকেই তৈরি হয়ে রয়েছে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস নিয়ে প্রথম থেকেই চীনের ছলচাতুরী ও অস্বচ্ছতা নিয়ে । করোনাভাইরাস চীন থেকে ছড়ানো এবং এই ভাইরাস মোকাবিলায় চীনের তৎপরতা নিয়ে চীনের ভেতরে ও বাইরে আন্তর্জাতিকভাবে চীনের সমালোচনা হয়েছে । বর্তমানে গলওয়ান উপত্যকা নিয়ে উত্তেজনা চলছে ভারত ও চীনের মধ্যে । এরই মধ্যে গত ১৫ জনু সেখানে দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে অন্তত ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে। এ নিয়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিল দুই দেশের মধ্যে । অন্য দিকে ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল জানিয়েছেন, চিন আদৌ নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক অংশীদার হওয়ার যোগ্য কি না, এ বার তা ভাবার সময় এসেছে । হংকংয়ের স্বায়ত্তশাাসন লংঘন করে হংকংয়ে চীন প্রণীত নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাশ করে ১৯৯৭ সালের ‘এক দেশ, দুই নীতি’র চুক্তির আওতায় ৫০ বছরের রুপান্তরকালে হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও চীন সেই প্রতিশ্রুতি পুরোপুরিই লঙ্ঘন করেছে । হংকং এর স্বাধীকার আন্দোলন দমনের লক্ষ্যেই আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটির জন্য জাতীয় নিরাপত্তা আইনটি তৈরি করেছে বেইজিং । হংকংয়ের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন কার্যকর করার মাধ্যমে—যে আইনটি ৩০ জুন থেকে কার্যকর হয়েছে—চীন যদি ভেবে থাকে যে, তারা তাদের সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়েছে, তাহলে তারা ভুল করেছে। কেননা নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন আইন এবং ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই ব্রিটিশদের হাত থেকে হংকংকে চীনের কাছে হস্তান্তর বার্ষিকী উপলক্ষে সমাবেশের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই হংকং এর বাসিন্দারা চীন বিরোধী বিক্ষোভ করেছিল ১ জুলাই।
অনেক পশ্চিমা গনতান্ত্রিক দেশ আইনটি নিয়ে নিন্দা জানিয়েছে; ১ জুলাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন পার্লামেন্টে বলেছেন, আইনটি কার্যকর করা সেই চুক্তির ১৯৯৭ সালের ‘এক দেশ, দুই নীতি’র চুক্তির ‘স্পষ্ট ও গুরুতর লঙ্ঘন’। চীন আইনটি প্রণয়নের ঘোষণা দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় হংকংয়ের নাগরিকদের ব্রিটেনে বসবাসের সুযোগ সংক্রান্ত ব্রিটিশ ন্যাশনাল অভারসিজ (বিএনও) পাসপোর্ট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী । এর মাধ্যমে তাদের বিট্রেনের পুর্ণ নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ তৈরি হবে । এই পাসপোর্ট পাবেন হংকংয়ের ৩০ লাখ বাসিন্দা। হংকং ইস্যুতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে। হস্তক্ষেপ না করতে ব্রিটেনকে পাল্টা সতর্ক করে দিয়েছে বেইজিং। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হংকংয়ের যেসব বাসিন্দার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব (ওভারসিস) রয়েছে; তারা ব্রিটেনে চলে আসতে চাইলে চীনের বাধা দেয়া উচিত হবে না। প্রয়োজনে নাগরিকত্বের কথাও বলা হয়। এ ঘোষণার পরই চীন তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ।
এক টুইট বার্তায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, বিশ্বে করোনাভাইরাসের ভয়ংকর রূপ তিনি যত দেখছেন, চিনের উপর আরও বেশি করে রাগছেন । যুক্তরাষ্ট্রও হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে, তারা হংকংকে দেওয়া বিশেষ বাণিজ্য মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেবে এবং অঞ্চলটিকে চীনের মূল ভূখণ্ডের অবিভেদ্য অংশ হিসেবেই বিবেচনা করবে । আমেরিকার আগামী প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনও চীনের হংকং নীতির বিরোধিতা করে চিনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি তুলেছেন ।হংকংয়ে চীনের আগ্রাসন আরও ক্ষেপিয়ে দিয়েছে আমেরিকাকে। তাই ভারতের মতো চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে হোয়াইট হাউস। জাপানের পক্ষ থেকেও কড়া বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, হংকং নিয়ে চীনের নীতি আন্তর্জাতিক বিশ্বাসের ভিতকে দুর্বল করবে । হংকংয়ে বিক্ষোভ ঠেকাতে চিন যে জাতীয় নিরাপত্তা আইন চাপিয়েছে— তার তীব্র নিন্দা করেছে জাপান । তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ভারত মহাসাগরে ভারতের সঙ্গে যৌথ নৌ-মহড়া করে চীনকে সতর্ক বার্তা দিয়েছে জাপান । চীনকে উদ্দেশ্য করে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেছেন, ভূখণ্ড আগ্রাসন, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একাধিপত্যের চেষ্টার কারণেই এই প্রথম স্থল, জলপথ এবং আকাশে দূরপাল্লার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করেছে অস্ট্রেলিয়া ।
চীনে রয়েছে একদলীয় শাসন । গনতন্ত্রহীন চীনে সরকারকে গঠনমূলক ভাবে সমালোচনা করার জন্য কোনও বিরোধী দল নেই চীনে । চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি দেশটির মূল ভূখণ্ডেও ভিন্নমত পোষণকারীদের বিরুদ্ধে একইভাবে দমনাভিযান চালায় । তবে তথ্য-প্রমাণাদিতে দেখা যাচ্ছে, হংকংয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ এই অঞ্চলটিকে নিজেদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়ার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে নতুন আইনের কঠোর পরিণতির ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত রয়েছে । উল্লিখত অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। অথচ এই সময়ে হংকংয়ের বাসিন্দাদের রাজনৈতিক ও জীবনযাপনের স্বাধীনতা সংরক্ষিত থাকার কথা ছিল ।
এদিকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত শুক্রবার ঘোষণা করেন যে “কানাডা হংকংয়ের সাথে তার প্রত্যাবর্তণ চুক্তি স্থগিত করছে এবং চীনের নতুন জাতীয় নিরাপওা আইনের জন্য হংকংয়ের সাথে মূল ভূখণ্ডের মতো আচরণ করার জন্য অন্যান্য পদক্ষেপ কানাডা গ্রহণ করবে ।“ তিনি আরও বলেন যে সরকার হংকংএ সংবেদনশীল সামরিক আইটেম রফতানির অনুমতি দেবে না। জাস্টিন ট্রুডো আরও বলেন” হংকং এর ব্যাপারে কানাডা এক দেশ, দুটি সিস্টেম কাঠামোতে বিশ্বাসী । আমরা কানাডা এবং হংকংয়ের জনগণের মধ্যে বহু সংযোগকে সমর্থন করব, পাশাপাশি জনগণের পক্ষে থাকবো । কানাডা অন্যান্য পদক্ষেপও নেওয়ার কথা বিবেচনা করছে। “এদিকে চীনের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করতে কানাডাকে পাল্টা সতর্ক করে দিয়েছে বেইজিং।কানাডায় চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, কানাডার সংসদ সদস্যদের চীনা কর্মকর্তাদের কানাডায় ভিসা দেওয়ার ব্যাপারে মার্কিন কংগ্রেসের নেতৃত্ব অনুসরণ না করার জন্য কানাডাকে সতর্ক করলেন ।
শুধু ভারতই নয়, রাশিয়া, জাপান, তাইওয়ান, মঙ্গোলিয়া, সিঙ্গাপুর, কিরগিজিস্তান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভূটান, ব্রূনেই, সহ আরও ২০টি দেশের বিভিন্ন অংশকে অবৈধভাবে নিজেদের বলে দাবি করে আসছে চীন. কোথাও সমুদ্র, কোথাও নদী, কোথাও বা জমি। চীন বারংবার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে । চল্লিশের দশকে প্রতিবেশী পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করে শিনজিয়াং প্রদেশ বানিয়েছিল চিন । ১৯৫০ সালে চীন দখল করেছিল তিব্বত । ১৯৬২ সালে বিনা প্ররোচনায় চীন ভারতের সাথে শান্তিচুক্তি পদদলিত করে ভারত আক্রমণ করে লাদাখ অঞ্চলে ভারতের জায়গা দখল করে নেয় । দক্ষিণ চিন সাগরের পাঁচটি দ্বীপ মালয়েশিয়ার নিয়ন্ত্রণে এবং এগুলির অধিকার নিয়ে বেজিংয়ের সঙ্গে মতভেদ রয়েছে কুয়ালালামপুরের । আশির দশকেই ভুটানের সর্বোচ্চ শিখর কুলা কাংরি ও সন্নিহত এলাকা দখন নিয়েছিল চীন । চীনের দাবি, ঐতিহাসিকভাবে সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অন্তর্গত এই মুসলিম প্রজাতন্ত্র কিরগিজিস্তান পুরোটাই তাদের অংশ । পূর্ব চীন সাগরে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে দক্ষিন কোরিয়ার সাথে চীনের টানাপড়েন চলছে এখনও । রাশিয়া এবং চীনের মধ্যবর্তী ‘বাফার দেশ’ মঙ্গোলিয়াকে বেজিং তারই অংশ বলে মনে করে । এক্ষেত্রে তাদের উদাহরণ, ত্রয়োদশ শতকের ইয়ান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি । আন্তর্জাতিক আইন (ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অব দ্য ল’জ অব দ্য সি) না মেনে দক্ষিণ চীন সাগরের একাধিক ছোট-বড় দ্বীপ দখল এবং সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অভিযোগ রয়েছে চিনের বিরুদ্ধে ।
চীনের ১৩০ কোটি মানুষের বৃহওম স্বার্থেই চীনের গনতন্ত্রের পথই অনুসরণ করা উচিত হবে । চীন যদি দুনিয়ার নেতা হতে চায়, তবে তাদের টাকা ও ভীতি প্রদর্শণ ছাড়া আরও ভালো কিছুর প্রস্তাব আনতে হবে। বাক্ স্বাধীনতা, মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও গনতন্ত্র এখনো গুরুত্ববহ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আগে এই বিশ্বাসে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছিল যে দেশটি আন্তর্জাতিক স্তরে সম্পর্ক বাড়ালে ধীরে ধীরে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে। কিন্তু ঠিক উল্টোটা ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট সি জিন পিংয়ের অধীনে চীন যেন আরও বেশী অগনতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে। ১৯৮৯ সালে, তিয়েন আনমেন চত্বরে (Tiananman Square Protest) বিক্ষুব্ধ চীনা ছাত্ররা জীবন দিয়ে প্রায় ৩০ ফুট লম্বা গণতন্ত্রের প্রতিমা খাড়া করেছিল? যে কারণে তারা গণতন্ত্রের প্রতিমা খাড়া করেছিল, নিজ দেশে সেই গণতন্ত্রের মহিমা ছাড়া চীন বিশ্বে তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করতে পারবে না ।
সূত্র: বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও টিভি সংবাদ
বিদ্যুৎ ভৌমিক । কলামিষ্ট, লেখক ও সিবিএনএ’এর উপদেষ্টা
মন্ট্রিয়ল, ক্যানাডা ৮ জুলাই ২০২০
সিএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন