লেখালেখি

প্রতিটি কর্মক্ষেত্র হোক স্বাচ্ছন্দ্যময় |||| অঞ্জন কুমার রায়


প্রতিটি কর্মক্ষেত্র হোক স্বাচ্ছন্দ্যময় |||| অঞ্জন কুমার রায়

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সব সময় সীমাবদ্ধতার দ্বারকে দূরে ঠেলে রাখার চেষ্টা করি, পছন্দের ব্যক্তি বা অন্য কোন লেখক, শিল্পী কিংবা সাংবাদিককে ফলো করার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে মনের অনুভূতিটুকু প্রকাশ করার নিমিত্তে দু’একবার কমেন্ট করি। শত ব্যস্ততায় এক চাকরির মাঝেও দৈনন্দিন খবরটুকু রাখার চেষ্টা করি। অন্যের অনুভূতিটুকুও শেয়ার করার অনুভব করি। তাতেই মিলে প্রতিদিনের খবর। প্রতিদিনের মতো ফেইসবুকে চোখ বুলাতে দেখতে পাই একজন সরকারী কর্মকর্তার উপর হামলার চিত্র। গত ৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা সরকারী বাসভবনে ঢুকে নির্বাহী অফিসারের উপর হামলা করা হয়। হামলা থেকে রক্ষা পায়নি ইউএনওর পিতাও! এ বর্বরতার শেষ কোথায়? দেশের দুর্যোগকালীন মুহূর্তে কিংবা সঙ্কটকালীন সময়ে যারা জীবন বাজি রেখে দেশের তরে কাজ করে থাকেন তাদের উপর হামলা হলে কথা থেকেই যায়।

মাঝে মাঝে হতাশা আমার মনকে বেশি বিদ্ধ করে। যদি এই কাজটুকু আরও আগেই সামলানো যেতো তবে বর্তমান ঘটনাটি নাও ঘটতে পারতো।

বর্বরতা কিংবা নৃশংস কাজ সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে, দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়ে জাতির বিবেক। স্তম্ভিত হয়ে আসে সমাজের প্রতিটি মানুষের হাহাকারে। ধ্বনিত হয় টিকে থাকার লড়াই। জীবনযুদ্ধে টিকে থেকে যেখানে বাঁচতে শিখি সেই পরিবেশটুকুও আজ পেছনে টেনে ধরে। সেই স্থানটুকু যদি নিরাপদ না হয় তবে নিরাপত্তার ঢাল কিভাবে তৈরি হবে মনে ভাবান্তর সৃষ্টি হয়। নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রস্তুত থাকতে হয় কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকার লড়াইয়ে।

মাঝে মাঝে নির্যাতনের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হলে আমরা সেটার প্রতিবাদ জানাই। দু’একদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। আমরাও সেটা চাই, বিচারের আশায় দিন গুনি। হয়তো বিচার হবে, কোন একদিন ঘটনাটি মন থেকে হারিয়ে যাবে। নতুন করে আরও একটি ঘটনার জন্ম হবে। এভাবে প্রতিনিয়ত চলতে থাকবে। ভাবি; অন্য একটি ঘটনা আমাদের মনকে আর বিচলিত করবে না।

তবে, যারা দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থেকে কিংবা সেবামূলক কাজের মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়নে অংশীদারিত্ব হিসেবে এগিয়ে আসে তাদের উপর হামলা হলে সমাজে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড রহিত হবে। মুখ থুবড়ে পড়বে সুশাসন ব্যবস্থা। পদাধিকার বলে একজন ইউএনও উপজেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি। ইউএনও’র উপরেই যদি এমন বর্বর হামলা চালনো হয় তবে অন্যান্য কর্মক্ষেত্র কতটুকু নিরাপদ হবে তা সহজেই অনুমেয়।

আমরা জানি, চাকরির ইতিবাচক দিক অনেকটা কর্মপরিবেশের উপর নিহিত থাকে। যদি সঠিক কর্মপরিবেশে সঠিকভাবে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায় তবে সেটা অবশ্যই ভাল কর্ম পরিবেশের নামান্তর হবে। সেক্ষেত্রে শুধু অভ্যন্তরীণ পরিবেশ চিহ্নিত করলেই হবে না। বাহ্যিক পরিবেশটুকুও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালণ করে।

কর্মক্ষেত্র অবশ্যই কতগুলো সুনির্দিষ্টি কাঠামোর উপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। হোক সেটা সরকারী কিংবা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারণ, কাজের সমন্বয় সাধন কিংবা বাস্তবায়নের জন্যই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কাজ করে থাকে। আবার সেটি প্রাতিষ্ঠানিক রকমফের অনুযায়ী বিভিন্ন ধরণের উন্নয়নমুলক কর্মকাণ্ডের সাথেও সম্পৃক্ত হতে পারে কিংবা সেবামূলক কর্মকাণ্ডও হতে পারে। প্রতিষ্ঠানের সার্বিক নীতি অনুযায়ী কাজ করতে হয়। তাতে প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারণ সহ বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কর্মকাণ্ড তারই আবহে সকল প্রাতিষ্ঠানিক কাজ দক্ষতার মিশেলে চালিয়ে যেতে হয়। সেই কাজগুলো সুসমন্বয় করার জন্য যদি বাহ্যিক কোন চাপ প্রয়োগ করা হয় তবে তাতে প্রকৃত কাজে স্থবিরতা চলে আসে। যদি চাপে নতি স্বীকার করা না হয় তখনি দ্বন্দ্ব চরমে উঠতে পারে। ফলশ্রুতিতে, প্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্ব ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে চলে আসে। সীমাবদ্ধতার অসীম দেয়ালে আটকা পড়ে থাকে আসল কাজটুকু। ব্যক্তিস্বার্থকে উপেক্ষা করে যখন প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ কিংবা দেশের স্বার্থ অনুসরণ করা হয় তখনি দেখা যায় তথাকথিত মানুষদের নির্যাতন কিংবা হামলার চিত্র। তখনি চাকরি কিংবা কর্মক্ষেত্রে ঈপ্সিত হয়ে দাঁড়ায় নিরাপত্তা নামক বিষয়টি। পেশাদারিত্বে দেখা দেয় শৃঙ্খলাবোধের অভাব। নেমে আসে চরম অসহনীয় পর্যায় যা রাষ্ট্রের জন্য কখনো কল্যাণকর হতে পারে না। কর্মক্ষেত্রে হামলা অন্ত:ত সেটুকুই প্রমাণ করে। যেটা আমরা দেখতে পাই কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত থেকে অনিশ্চিত নিরাপত্তায় দিন যাপন।

সম্প্রতি ইউএনওর উপর হামলার ঘটনায় ব্যাটালিয়ন আনসার নিয়োগের দাবি জানানো হয়। হয়তো আশা করবো সমস্যা থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। কিন্তু, তাতেই কি সমস্যার সকল সমাধান পাওয়া যাবে? আবার যারা অন্যান্য দপ্তরে চাকরি করে হামলার শিকারে পরিণত হয়েছে তারা কিভাবে নিজেকে রক্ষা করবে? পেশাগত দায়িত্ব পালণ করতে গিয়ে গত আগস্ট মাসের ১৭ তারিখে একজন উপ-সহকারী প্রকৌশলী হামলার শিকার হন। রাজশাহীর পুটিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের নির্মাণকাজে প্রাক্কলিত ব্যয় এক কোটি টাকার বেশি। অভিযোগ, ঠিকাদার নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করেন। উপ-সহকারী প্রকৌশলীর  সাথে এ নিয়ে বিতর্কের এক পর্যায়ে তারা তার উপর হামলা করেন! (প্রথম আলো: ১৭ আগস্ট, ২০২০)

যে লোকগুলো দেশের সার্বিক স্বার্থে কাজ করে থাকে তাদের নিরাপত্তায় বাঁধা সৃষ্টি মানেই রাষ্ট্রের কল্যাণ বিঘ্নিত হওয়া।

সঙ্গত কারণেই বলতে হয়, মেকয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার ভাষা। মেকিয়াভেলির ভাষায়, “If men were entirely good this precept would not hold, but because they are bad and will not keep faith you, you too are not bound to observe it with them”.

অর্থাৎ “জনগণ যদি সত্যিই উত্তম হতো তাহলে এই উপদেশের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তারা অসৎ এবং আপনার উপর তারা আস্থাহীন। সুতরাং তাদের ওপর আপনারও বিশ্বাস রাখার দরকার নেই”।

একটি রাষ্ট্রের জনগণ সম্পর্কে এমন অবমূল্যায়ন আমাদের মনুষ্যত্বকে সংকোচিত করে রাখে। নেতিবাচক কিংবা বিরুপ ভাবাবেগ ফেলবে প্রতিটি পদক্ষেপে। ভ্রষ্ট নীতির সঠিক দিক নিরুপন করা আরও কঠিন হয়ে আসবে।

এক্ষেত্রে অবশ্যই জর্জ কেলিং এবং জেমস কিউ. উইলসন’র ‘Broken Windows Theory’ কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র ক্ষদ্র অপরাধ ও অবহেলা থেকেই গুরুতর অপরাধের সৃষ্টি হয়। তাদের মতে, কোন অপরাধ অনেক গুরুতর হবে যদি ঘটনাটি তার তীব্রতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালণ করে এবং সংঘটনের পর জনমনে বেশি ভীতির সঞ্চার করে সমাজকে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে।

তাই, কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ জীবনধারণের জন্য অপরাধীদের প্রকৃত অপরাধের নিশানা নিরুপন করে লাগাম টেনে ধরতে হবে। তা না হলে এ জাতীয় বর্বরতা সমাজে বাড়তেই থাকবে।

অঞ্জন কুমার রায় / ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক



সিএ/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন