ফিচার্ড লেখালেখি

বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও ! ।।।  দিলীপ কর্মকার

বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও ! ।।।  দিলীপ কর্মকার

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ আমার জীবনের এক অবিস্মরনীয় স্মৃতি বিজড়িত দিন। রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ারদী উদ্যান) সেদিনের উত্তাল জনসমুদ্রে আমার উপস্থিতি এবং বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক অবিনশ্বর ভাষণ শুনার এক জীবন্ত স্বাক্ষী হিসেবে আজও আমার হৃদয় আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠে। সেদিনের ঘটনা আমার হৃদয়ে জাগরূক হয়ে আছে। স্মৃতি বিভ্রম না হলে তা’ হৃদয়ের প্রেক্ষাপটে চীর ভাস্বর হয়ে থাকবে। আমি তখন শ্রেনী সংগ্রামের মাধ্যমে সাম্যবাদ তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আদর্শে বিশ্বাসী এক তরুণ। আমি সর্বহারা শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত ও শ্রেনী সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার এক মহান ব্রত নিয়ে তখন ইস্ট পাকিস্তান লঞ্চ লেবার এসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম। সেদিন, আমার সহকর্মী লঞ্চ ইউনিয়নের সহ-সাধারন সম্পাদক সন্দ্বীপের জনাব জোবায়রুল ইসলাম (ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সন্দ্বীপের কমরেড মোজাফফর আহমেদ এর আত্মীয়), শ্রমিক নেতা সন্দ্বীপের অধিবাসী এম, ভি, মাসুদ খান জাহাজের মাস্টার নুরুল হুদা এবং চট্টগ্রাম নিবাসী লঞ্চ ইউনিয়নের কালেক্টর জনাব ইসাহাক মিয়া সহ আমরা চারজন একসঙ্গে আমাদের ইউনিয়ন অফিস (৩১/৩২ পি, কে, রায় রোড, সদরঘাট জিপিও সংলগ্ন ইস্পাহানী ভবন) থেকে অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে নিয়ে মিছিল সহকারে রওয়ানা দিয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তায় জনস্রোতের কারনে হাইকোর্টের সামনে পৌঁছার আগেই থেমে যেতে হল। হাঁটতে হাঁটতে জনতার ভীরে আমরা একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছিলাম। আমি আমার সঙ্গীদের খুঁজে বের করার জন্য বেশ খানিকটা সময় খরচ করলাম। কিন্তু, জনতার ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগুনোও একটা দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। অবশেষে শুধুমাত্র জোবায়ের ভাইকে খুঁজে পেলাম।

বঙ্গবন্ধু সেদিন স্বপ্নদ্রষ্টা ঋষি পুরুষের ন্যায় অন্তর থেকে উৎসারিত বজ্রকন্ঠে অনর্গল ছন্দময় ধ্বনিতে পাকিস্তানীদের ২৩ বছর শাসনের ইতিহাস সম্বলিত অন্যায় অত্যাচার, নির্যাতন, বৈষম্যের ও বঞ্চনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরলেন। ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ আমরা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনেছিলাম। সাবলিল ও সাধারণের বোধগম্য ভাষায় এমন এক ভাষণ দিলেন যা পৃথিবীর অন্য কোন দেশের কোন নেতার মুখে কোনদিন কেউ শুনেছে কিনা তা আমার জানা নেই। নিজ যোগ্যতাবলে তিনি বাঙ্গালী জাতির সকল আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে একচ্ছত্র নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি ইতিহাসে বাঙ্গালী জাতির মহানায়কের ভূমিকায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে গোটা জাতিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেছিলেন, “… … আমি যদি তোমাদের হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে”… “… মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ” … “… … … মরতে যখন শিখেছি, কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবেনা”…” …এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” … বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উপস্থিত জনতার হৃদয়ে স্পন্দন তুলেছিল।

জোবায়ের ভাইয়ের দেয়া বাদাম পকেটে রেখে নিজের অজান্তেই আমিও সেদিন উদ্বেলিত হয়ে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে জনতার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চস্বরে শ্লোগানের ধ্বনি তুলেছিলাম। “জয় বাংলা”, “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা”, “দুনিয়ার মজদুর এক হও”, “বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”, “কৃষক রাজ, শ্রমিক রাজ – কায়েম কর, কায়েম কর”। জোবায়ের ভাই, নুরুল হুদা মাস্টারসহ আমরা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর ত্রাণ তহবিলে দানের জন্য শ্রমিকদের কাছে সাহায্যের হাত পেতেছিলাম। যে নেতার নির্দেশে সমগ্র জাতি সেদিন অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হয়েছিল, পাকবাহিনীর আক্রমনের মুখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং যার অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধান বানিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাঁর অবদানকে যারা অস্বীকার করে – আর যা কিছুই হোক না কেন নি:সন্দেহে তাঁরা “বেঈমান”, “ইতিহাস বিকৃতিকারী”।

আমি মনে করি, আমরা ভৌগলিক স্বাধীনতা পেলেও আজও আমরা মুক্তি পাইনি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তার সফল বাস্তবায়নের মধ্যেই আমাদের মুক্তি অনেকাংশ নির্ভর করে বলে আমার বিশ্বাস। যারা আজও বাংলাদেশের সংবিধান, পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, শহীদ মিনার নিয়ে কটাক্ষ করে এগুলো মানতে চায় না বা স্বীকার করেন না, তাঁরা বাংলাদেশের চিরশত্রু। “জয় বাংলা” ধ্বনি তুললে যাদের গাঁয়ে জ্বালা ধরে তাঁরা তাঁদের নেতার ছবি চাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে কিছু লোককে বিভ্রান্ত করে নাশকতা সৃষ্টিতে প্রলুব্ধ করতে পারলেও ইহলোকে শান্তি বা মানুষের মুক্তি দিতে পারবেন না। দেশে আজ নতুন করে মৌলবাদী শক্তির যেভাবে উত্থান হয়েছে এবং ওয়াজের নামে কাদিয়ানী, আহমেদিয়া, হিন্দু, বৌদ্ধ, আদিবাসী, খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও রাজনৈতিক সহিংসতা সৃষ্টি করছে, তরুণ প্রজন্মের নতুন মুক্তিযোদ্ধারা ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের নির্দেশিত পথে তা মোকাবেলায় সক্ষম হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

আজ সশ্রদ্ধ চিত্তে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করছি তাঁর অপ্রত্যাশিত বিয়োগ ব্যাথা অনুভব করছি। সত্যের জয় হোক।

জয় বঙ্গবন্ধু। জয় বাংলা। জয় বাংলাদেশ। জয় বাংলার মেহনতি মানুষ।


-দিলীপ কর্মকার- মানুষের জন্য উৎসর্গকৃত মানবাধিকার কর্মী,  উপদেষ্টা সিবিএনএ।




 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন