তৈলমর্দন করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রক্ষা সম্ভব নয়
তেল এমন এক জিনিস, যা অল্পবিস্তর সবাই পছন্দ করেন। কেউ একটু বেশি, কেউ একটু কম। তবে তেল পছন্দ করেন না- এমন ব্যক্তি পাওয়া কঠিন। আমরা প্রতিনিয়ত গ্যালন গ্যালন তেল ঢেলে যাচ্ছি প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে। মানুষের শরীর থেকে শুরু করে রান্না পর্যন্ত, সব জায়গায় তেলের ব্যবহার ভয়াবহ। ইদানীং কাজ উদ্ধারের জন্য তেলের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজ উদ্ধারের ক্ষেত্রে তেলের ব্যবহার বাঙালির এক উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। কাজ উদ্ধারের ক্ষেত্রে বাঙালি যে পরিমাণ তেল ব্যবহার করে, তা অন্য কোনো জাতি করে কি না-সন্দেহ। তেলের এই অপরিসীম ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের বাজারে আজ তেলের দাম ঊর্ধ্বগতির দিকে!
বাঙালির তৈলমর্দন প্রসঙ্গে হরিপ্রসাদ শাস্ত্রীর বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, ‘তৈল যে কী পদার্থ তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন, তাহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ, বাস্তবিক স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর, অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কী? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠাণ্ডা করে তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠাণ্ডা করিতে আর কিসে পারে! সংস্কৃত কবিরা ঠিকই বুঝিয়াছিলেন। যেহেতু তাহারা সকল মনুষ্যকেই সমানরূপে স্নেহ করিতে বা তৈল প্রদান করিতে উপদেশ দিয়াছেন। বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে। যে সর্বশক্তিময় তৈল ব্যবহার করিতে জানে, সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতের সব কাজই সোজা। তেলে তেলে তেলময় হয়ে যাচ্ছে চারদিক।’
তেল নিয়ে এতকিছু লেখার কারণ হলো আমরা প্রতিনিয়ত মুখে মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলে বলে জাতিকে উদ্ধার করে দিচ্ছি। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যাকে নিয়ে শত শত গ্রন্থ রচনা করছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বস্তুনিষ্ট গবেষণা হয়েছে কয়টি? বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে যতগুলো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে কয়টি সঠিক সে খবর কী কেউ নিয়েছেন? বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অডিও এবং প্রকাশিত গ্রন্থ একসঙ্গে করে দেখবেন। দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক, যা ভাবতেই অবাক লাগে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে খুশি করার জন্য কতকিছুই না করা হচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায় না। ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু কিছু কাজ হচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। রাষ্ট্র পরিচালনা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নের একক দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুকন্যার। তিনি যা বলবেন বা যা করবেন তাই একমাত্র কাজ। বাকিরা হাত কচলাবেন। তাদেরও যে কিছু দায়িত্ব আছে, পেছনে একটা মেরুদণ্ড আছে তা ভুলতে বসেছেন। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।
গত ১৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর নামে স্থাপিত ভাস্কর্য অপসারণের দাবি তুলেছে একটি দল। বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর এইসব ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গার পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হবে। তা তো হবেই। কারণ স্বাধীনতা লাভের সাড়ে চার বছরের মাথায় যদি জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা সম্ভব হয়, তবে ভাস্কর্য ভাঙা তো তেমন বড় কোনো বিষয় না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়ার পর সুশীল সমাজ কী ভূমিকা পালন করেছে? যারা প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধুকন্যাকে খুশি করার জন্য হাত কচলাচ্ছেন, তারা কী করেছেন? উত্তর হবে কিছুই করেননি। যিনি প্রথম জোরালো প্রতিবাদ করেছেন তিনি তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। প্রতিবাদ করার জন্য তাকেও ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে। আর হুমকি তো আছেই।
এরপর শাহরিয়ার কবির ও মুনতাসীর মামুনের নেতৃত্বে গত ১৫ নভেম্বর ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ প্রথম সংগঠন, যারা কঠোর ভাষায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার হুমকির প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে- ‘আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছি রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে মুজিববর্ষ উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনে বাধা প্রদান এবং স্থাপিত ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার ভয়ংকর হুমকি দিয়েছে চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। গত ১৩ নভেম্বর করোনাকালীন যাবতীয় বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে তারা যেভাবে গেন্ডারিয়ার ধূপখোলার মাঠে সমাবেশ করেছে এবং যে ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি বিষোদগার করেছে, তা রাষ্ট্রদ্রোহিতাতুল্য অপরাধ হলেও এখন পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে সরকারি কিংবা সরকারদলীয় কোনো প্রতিবাদ আমাদের নজরে পড়েনি।…যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনে বাধা দিচ্ছে এবং ইতিমধ্যে স্থাপিত ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছে, এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে আমরা দেশ ও জাতির জন্য সমূহ বিপর্যয় আশঙ্কা করছি, যা আমাদের জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে। করোনা মহামারিকালে যেকোনো অজুহাতে আমরা সব রকম প্রকাশ্য জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছি।’
ব্যক্তি পর্যায়ে এবং কয়েকটি ছোট ছোট সংগঠন কিছু কিছু প্রতিবাদ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া টেলিভিশন টক শোতে এই বিষয় নিয়ে কিছুটা আলোচনা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতার ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির যেমন প্রতিবাদ করা উচিত ছিল, তা হয়নি। কোনো এক অজানা কারণে সকলেই নীরবতা পালন করছেন। হয়তো প্রতিবাদ করলে প্রাপ্তির চেয়ে ক্ষতি বেশি; এই চিন্তায় নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
এরপর আমরা দেখাতে পাই গত ২৫ নভেম্বর অসাম্প্রদায়িক ও গণমুখী ইতিহাস চর্চার জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী ও সারাক্ষণ মিডিয়া আয়োজিত ‘ভাস্কর্য, ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা সভায় বক্তারা কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার যে দুঃসাহস মৌলবাদীরা দেখিয়েছে, তা এ দেশের প্রগতিশীল নাগরিকের জন্য জেগে ওঠার ডাক। মৌলবাদীদের আস্ফালনের বিরুদ্ধে কঠিন প্রত্যয়ে জেগে উঠতে হবে। যদি তা না করা যায় তাহলে প্রগতিশীল মানুষের জন্য এ দেশে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। প্রতিবাদের ভাষা বোঝার সুবিধার জন্য বক্তাদের বক্তব্যের কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো। আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। এর সঙ্গে দীর্ঘ ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে তারা মুজিববর্ষকে বেছে নিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা পুরো জাতিকে অপমান করেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা, ১৪ দল- কেউ এই ইস্যুতে মাঠে নেই। এই দেশটা আমাদের। আমাদেরই মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নীরব থাকার কোনো সুযোগ নেই। নীরব যে থাকে সেও অপরাধী। বিভন্ন সংকটে আমরাই রুখে দাঁড়িয়েছি। এবারও আমরাই রুখে দাঁড়াব।’
নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমরা অবশ্যই মাঠে নামব। পহেলা ডিসেম্বর আমরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সব শক্তিকে নিয়ে মাঠে নামব। ডিসেম্বর মাসজুড়ে আমাদের এই আন্দোলন চলবে। যেভাবে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের দমনে আমরা তরুণদের নিয়ে মাঠে নেমেছিলাম, এবারও সেভাবেই মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে আমরা গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলব।’ সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ফেলে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে, তারা তো কোনো বড় শক্তি নয়। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ছুড়ে ফেলে দেয়ার হুমকি দেয় তাদের সঙ্গে কোনো আপস হতে পারে না। তারা হয় পাকিস্তানে চলে যাবে না হয় তাদের বিতাড়িত হতে হবে। আমরা যদি এখনো জেগে উঠতে না পারি, তাহলে আমাদের সামনে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। আমাদের অবশ্যই কঠিন প্রত্যয়ে জেগে উঠতে হবে।’
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সারাক্ষণ-এর সম্পাদক স্বদেশ রায় বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, বিভিন্ন অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর করেছে, তাদের সঙ্গে এখনকার ভাস্কর্য-বিরোধিতাকারীদের কোনো পার্থক্য নেই। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, তাই তারা বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙার সাহস পাচ্ছে না। এ কারণে তারা এই ইস্যুর সঙ্গে ধর্মীয় মোড়ক লাগিয়ে মাঠে নেমেছে।’
সাহস করে প্রতিবাদ করলে যে কাজ হয় তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ জাতি দেখেছে। ইতিহাস সম্মিলনীর এই অনুষ্ঠানের পরদিন ২৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে। এই সমাবেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার যে হুমকি দেয়া হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে ছাত্রলীগের সভাপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙতে এলে বুড়িগঙ্গার পানিতে তাদের ভাসিয়ে দেয়া হবে। এই হুঁশিয়ারি যে শুধু দেয়ার জন্য দেয়া হয়নি, তা আমরা ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করি।
এখন সময় এসেছে সম্মিলিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের ঘরে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করা হলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ব্যর্থ হবে। এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের মানুষদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে- মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সামনে নিয়ে? নাকি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের উল্টোদিকে পথচলা শুরু করবে? হাত কচলানো ও তৈলমর্দন বাদ দিয়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে মাঠে নামার সময় এসেছে। এখন যদি যথাযথ প্রতিবাদ না হয় তবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে একসঙ্গে মাঠে নেমে যেকোনো উগ্র সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর একটি উক্তি দিয়ে শেষ করতে চাই। তিনি বলেছিলেন-‘আমি ধর্মনিরপেক্ষতার একটি চারাগাছ রোপণ করেছি। এই চারাগাছ যদি কেউ ছিঁড়ে ফেলতে চায়, উপড়ে ফেলতে চায়, তবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।’ এখন অস্তিত্ব সংকটাপন্ন, রুখে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
-সূত্রঃ সারাক্ষণ
-এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন