সূর্যের মুখটি গত কদিন ধরে গোমড়া হয়ে থাকলেও, আড়াল করে রাখলেও গতকাল সেসব ভুলে গিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, হেসেছে উজ্জ্বল সোনালি রোদ ছড়িয়ে। বাংলাদেশ ঘটন-অঘটন ২০১৯ সালের শেষ দিনটিতে যেন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি।
বিদায়ী বছরটিও ছিল সূর্যের মতোই, কখনো দারুণ দারুণ খবরে আমাদের আন্দোলিত করেছে, হাসিয়েছে সাফল্যের উজ্জ্বল হাসি। আবার কখনোবা এমন অঘটন ঘটিয়েছে যে, বাকরুদ্ধ বিষাদে ডুবে গেছে দেশ। সব মিলিয়ে ঘটনা আর অঘটনে পটীয়সী একটি বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে আজ।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় বিদায়ী বছরের প্রথম থেকেই। মাত্র ৭ আসন পেয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম এবং বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের রাজনৈতিক সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গিয়েছিল। ‘অবিশ্বাস্য’ বিজয়ের পর বিদায়ী বছরের ৭ জানুয়ারি টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনে নতুন নতুন মুখ নিয়ে আসেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চমক উপহার দেন দেশবাসীকে। বছরজুড়ে রাজনীতিতে ক্ষণে ক্ষণে কিছুটা উত্তাপ থাকলেও হরতাল-অবরোধ ছিল না। নতুনেরকেতন উড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্র্যের হার কমিয়ে ২১.৮ শতাংশে এনেছেন। গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২.৩-এ। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। বৈদেশির মুদ্রার রিজার্ভে রেকর্ড গড়েছে। বাম্পার খাদ্য ফলন, বিদ্যুতের উৎপাদনে রেকর্ড হয়েছে। আলোচিত পদ্মা সেতুর ৩ কিলোমিটার পথ দৃশ্যমান হয়েছে। রাজধানীতে স্বপ্নের মেট্রোরেলের কাজও এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। শেখ হাসিনার ভারত সফরও ছিল এ বছরই। রাজনীতিতে গুণগত মান পরিবর্তনে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর দলে শুদ্ধি অভিযানের ঘটনায় বেশ প্রশসিংত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াসহ বেশ কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তারের ঘটনা অভাবনীয় ছিল। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ-সহযোগী ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠন থেকে বাদ পড়েছেন বিতর্কিত নেতারা। নানা জটিলতার মধ্যেও সড়ক পরিবহন আইন চালু হয়েছে।
তবে এটিই চূড়ান্ত ছবি নয়। ব্যর্থতা, বিতর্ক, সমালোচনার ছড়াছড়ি ছিল। নানা অঘটন সরকারকে বিব্রত করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর বিজয় দিবস উদযাপনের আগে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকার-আলবদরসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা প্রকাশ করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান আইনজীবীসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও দেশজুড়ে খ্যাত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের নাম সেই তালিকায় যুক্ত হওয়ায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত তালিকা স্থগিত করা হয়। কেজিপ্রতি আড়াইশ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়া পেঁয়াজের অসহনীয় ঝাঁজে কাবু হয়ে গেছে সাধারণ মানুষ। বিদেশ থেকে আদমানি করেও এ ঊর্ধ্বমূল্যের লাগাম টানা কঠিন হয়ে যায়। রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়িয়ে পুরো দেশের মানুষকে বিস্ময়াভিভূত করে তোলে ক্যাসিনো কারবারের মাধ্যমে প্রভাবশালীদের কাড়ি কাড়ি টাকা কামানোর গল্প। নতুন এ কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুবলীগ নেতাদের তো বটেই, আওয়ামী লীগেরও প্রভাবশালী কিছু নেতার সম্পৃক্ততার খবর আসে গণমাধ্যমে। পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় এবং বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকা-ে শতাধিক মানুষের মর্মান্তিক প্রাণহানি দেশবাসীর হৃদয়কে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। বিমান ছিনতাইয়ের মতো কা-ও এ বছরই ঘটে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। যদিও সেই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার খবর স্বস্তি ফিরিয়ে আনে। প্রাণঘাতী ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ এবার রাজধানীতেই শুধু নয়, দেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে; এতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন জেলায় মানুষের মৃত্যুর খবরে কয়েকটি মাস খুবই আতঙ্কে কাটিয়েছে দেশবাসী। বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়ার জামিন পাওয়া, না পাওয়া নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে খানিক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে; এ ইস্যুতে গা-ঝাড়া দেওয়ার চেষ্টা করে বিএনপি। যদিও শেষ বিচারে রায় তাদের দাবির বিপক্ষেই গেছে, উচ্চ আদালতের রায়ে বন্দিই থাকতে হচ্ছে খালেদা জিয়ার। বছরের একেবারে শেষ সময়ে এসে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী হাওয়া রাজনীতির মাঠকে সরগরম করে তুলছে।
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মম পৈশাচিকতায় পিটিয়ে হত্যার কা-ে অভিযোগের তীরে বিদ্ধ হয় ছাত্রলীগ; প্রশ্ন ওঠে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে। দেশের অন্যতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা ফাহাদ হত্যার বিচার দাবিতে ক্লাস ছেড়ে পথে নেমে আসেন; প্রায় এক মাস বন্ধ থাকে বুয়েট, নিষিদ্ধ করা হয় ছাত্ররাজনীতি। ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা জাতির বিবেককে ক্ষত-বিক্ষত করে; সেই ক্ষতে সান্ত¦নার প্রলেপ বুলিয়ে দেয় দ্রুততম সময়ে এর বিচার এবং নিম্ন আদালতে ১৬ আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায়। বরগুনায় রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার বর্বরতা দেশবাসীর মনে নতুন উৎকণ্ঠা ছড়ায়।
আরও পড়ুনঃ এক বছরে সরকার । শুদ্ধি অভিযান উন্নয়নে সাফল্য, সুশাসনে প্রশ্ন
২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হয় বহু আকাক্সিক্ষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচন। এর মাধ্যমে প্রাচ্যের বাতিঘর খ্যাত প্রতিষ্ঠানটি আলোকিত হবে, এমন প্রত্যাশা থাকলেও ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের ছাত্রলীগের হাতে বেশ কয়েকবার মারধরের শিকার হওয়া এক ধরনের উদ্বেগ ছড়িয়ে দেয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ বছর উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন চলেছে; প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার পরিবেশ হয়েছে বিঘ্নিত। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও চাঁদাবাজি ইত্যাদি সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। অমোচনীয় ইতিহাসসমৃদ্ধ ছাত্রলীগের শীর্ষপদের দুই নেতাকে চাঁদাবাজিসহ বেশকিছু অভিযোগে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনাও সংগঠনটির নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিজ দেশে প্রত্যাবাসন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঢাকার কূটনৈতিক তৎপরতা চলেছে বছরজুড়েই। এতে অবশ্য কার্যকর সুফল আসেনি। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সবচেয়ে আলোচনা ছাড়িয়ে যায় নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানি ছিল শীর্ষ আলোচনার বিষয়।
প্রথমবারের মতো দেশের বাইরের কোনো টুর্নামেন্টে জয়ী হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। এ সুসংবাদের পাশাপাশি দুঃসংবাদ ছিল, বাজিকরের প্রস্তুাব গোপন করে শাস্তির মুখোমুখি হওয়া বিশ্বসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিষয়টি। আর ফুটবল এ বছর স্বপ্ন দেখেছে সোনালি অতীত ফিরে পাওয়ার।
মৃত্যু অমোঘ নিয়মে ২০১৯ সালে দেশ হারিয়েছে অনেক কৃতী সন্তানকে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আধুনিক কবিখ্যাত কবি আল মাহমুদ, নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ, সংগীতশিল্পী শাহনাজ রতমতুল্লাহ ও সুবীর নন্দী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, অধ্যাপক অজয় রায়, সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহসহ অনেক রত্নই এ বছর চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছেন।
২০১৯ সাল সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, এ বছরটি আমাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। এমন কিছু ঘটেছে যা অভাবনীয়, অকল্পনীয়, অচিন্তনীয়। মৌলিক অধিকার আরও সংকুচিত হয়েছে; মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ভোটাধিকার খর্ব হয়েছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা প্রকট হয়েছে। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের একেবারে শেষদিকে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন ২০১৯ সালজুড়েই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ; নিজস্ব ভঙ্গিতে ও নীতিতে চলেছে সরকার, চলছে। যেহেতু বিরোধী দলগুলোর জোরালো কোনো চ্যালেঞ্জ নেই, সে কারণে সরকার সমর্থকরা বিভিন্ন অপকর্মও ঘটাচ্ছে।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন অবশ্য বিদায়ী বছরে সরকারের সাফল্যই দেখছেন। তিনি বলেন, সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করে চলেছে। পদ্মাসেতু ও মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রজেক্টগুলোর কাজ দ্রুত চলছে। দারিদ্র বিমোচনে অভূতপূর্ব সাফল্য রয়েছে সরকারের। তিনি বলেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সফল। সফলভাবে দলীয় কাউন্সিল করেছে। শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে দুর্বৃত্তায়ন দূর করেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- রাজনৈতিক পরিস্থিতিও শান্ত। দেশে রাজনৈতিক কোনো সংকট নেই।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, পুরনোর আবর্তন যখন মানুষের জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতিতে অচলায়নের দেয়াল তুলে দেয়, তখন তা থেকে মুক্তির পথ দেখায় নতুন। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মধ্যে ভালো কিছুর স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়েই এগিয়ে চলে মানুষ। তাদের প্রত্যাশা, নতুন বছরে নতুনের আহ্বানে নতুন নতুন স্বপ্ন নিয়ে জেগে উঠবে দেশ; পথ চলবে আপন আলোয়।
বাংলাদেশ ঘটন-অঘটন ২০১৯ মনের ভেতর বিদায় গীতি বাজলেও প্রতিকারহীন অগ্নিকান্ড ও সড়ক দুর্ঘটনা, জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলার রাজনীতি; হত্যা, গুম-খুন, দুর্নীতি ও দুর্বত্তায়নে সীমিত জীবনের মূল্যবান সময়, অমিত প্রাণশক্তি ও সম্ভাবনা ক্ষয়ে যাচ্ছে। এ সব থেকে বের হয়ে নবজাগরণে সোনার বাংলা গড়ে উঠবে- দেশপ্রেমিক মাত্রই এমন প্রত্যাশা।
কানাডা প্রবাসীদের অনুষ্ঠানের ভিডিও দেখতে হলে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেল