আমার ভুটান দেখার শেষ দু দিন |||| আবুল জাকের
পুনাখা থেকে রওনা হলাম পারোর দিকে নাস্তার পর। সেই পাহাড়ি রাস্তা। আঁকা বাঁকা। একবার উঠছে। একবার নামছে। ভুটানের একমাত্র আন্তর্জাতিক এয়ার পোর্ট এখানে। সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ২২০০ মিটার উপরে। পুরানো শহর। আমার গাইড পরিবর্তন হবে পারোতে। সুমন শেষ পর্যন্ত থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু ট্রাভেল কোম্পানি রাজী হয় নি। কেন হয় নি পরে বলবো। তাতে তার মনটা খারাপ ছিল। প্রায় ঘন্টা খানিক যাবার পর গাড়ী থামল এক জায়গায়। সুমনের বদলা। গাড়ী বুঝে নেবার জন্য। কেমন যেন একটু ছন্দ পতন হোল। আমার মন টাও খারাপ হয়ে গেলো। সুমনের সাথে কেমন জানি একটা ভালো লাগা ভাব জন্মেছিল। যা হোক । আমার ত আর কিছু করার নেই। পথের মাঝে এয়ার পোর্ট ভিউ পয়েন্টে নামলাম। ওরা এটাকে বার্ডস ভিউ বলে। বেশ উপর থেকে পুরো এয়ার পোর্টটাকে দেখা যায়। ছবির মতো। সবাই থামে এখানে ছবি তুলতে।
দুপুর নাগাত রিসোর্ট এ পৌঁছলাম। নতুন রিসোর্ট। কিন্তু পুনাখার মতো নয়। শহরে কাছে। সমতল ভুমিতে। নাম এয়াঙ্কি রিসোর্ট। রুমে যাবার আগে সুমনকে ধন্যবাদ জানালাম। বললাম তুমি থাকলে ভালো হতো। খুশী হয়ে তার হাঁতে তুলে দিলাম ১৫০ ডলার। বললাম আবার আসলে দেখা হবে। চাবি নিয়ে রুমে যেতে হবে। দুপুরের খাবার সেরে বেরবো আবার।
রুমটা তিন তালায়। লিফট নেই। সুমনই রুমে পৌঁছে দিলো।দু রুমের সুট। লাগেজ নিয়ে আসলো। তাকিয়ে দেখি তার চোখেও জল চিক চিক করছে। সুমন যাবার পর বিছানায় এলিয়ে দিলাম নিজেকে। কিছুক্ষন বিশ্রাম নেবার পর শরীরটা একটু ভালো বোধ হোলও। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বেশ ঠাণ্ডা। তাকিয়ে দেখি রুমে হিটার আছে। ওটা অন করে বাথ রুমে গেলাম ফ্রেস হতে। বাথরুম টা পছন্দ হোল না। বেশ বড়। কিন্তু সাদা মাটা। মনে হয় এখনো শেষ করতে পারেনি।
লাঞ্চ সেরে লবিতে নেমে আসলাম। বেরুতে হবে। বেশ অনেকক্ষণ পর গাইড এলো। নেপাল থেকে এসেছে। বিয়ে করেছে এখানে। ওর কাছ থেকেই জানলাম এখানে বিয়ের পর বর কনের বাড়ীতে আসে। তাদের অর্থনৈতিক দায়িত্ব নেয়। একটু অবাক লাগলো। এতো পুরানো প্রথা এখনো চালু আছে। ছেলেদের ও কোণ আপত্তি নেই। রাস্তায় একফাকে সে তার বাড়ী ও বউকে দেখাল। এখানে বলে রাখি কেন গাড়ী ও গাইড বদলাল। গাড়িটা রিসোর্ট মালিকের। এটা করাতে ওর একটু বাড়তি আয় হবে। আর ট্রেভেল কোম্পানি তার গাড়িটাকে অন্য ট্রিপ এ লাগাবে। দুই পক্ষেরই লাভ।
ফ্রিজিং রেইন ও ঠাণ্ডার জন্য প্লেনটা বদলে নিলাম। বললাম আজ শহরে যাবো আর আগামীকাল যাবো বিশেষ জায়গা গুলু দেখতে। প্রথমে বললাম শপিং মলে যেতে। ওখানে মল বলতে কিছু নেই। রাস্তার ধারে সারি সারি দোকান। নেমে কয়েকটা দোকান দেখলাম। বিশেষ কিছু কেনার নেই। দুই নাতির জন্য দুটো ভুটানিজ ড্রেস কিনলাম। তার পর বেরিয়ে গেলাম শহর দেখতে। প্রথমে নিয়ে গেলো ফারমারস মার্কেটে। এখানে চাষিরা তাদের জিনিস পত্র এনে বিক্রি করে সাপ্তাহে দু দিন। সরকারই করে দিয়েছে। সামনে তাকিয়ে দেখি দুজন মহিলা কাঁচা মরিচ বিক্রি করছে। ছবি তুলতে গিয়ে আটকে গেলাম। এখানে অনুমতি ছাড়া মহিলাদের ছবি তোলা বারন। মরিচগুলো খুব তাজা। গাড় সবুজ। টুকরি ভর্তি অনেক মরিচ। পাশে একটা গ্রসারি শপে ঢুকলাম দেখতে। বেশ টাঁসা জিনিষে। ভুটানিজ আপেল আছে কিনা জানতে চাইলাম। দেখানো আপেল কিন্তু বলল ভুটানের নয়। দেখলাম আমেরিকান আপেল। ভারত থেকে এসেছে।
বাজার থেকে বেরিয়ে এসে দেখি সূর্য উঠেছে। ঝক ঝক করছে চতুর্দিক। একটু সামনে এসে তাকিয়ে দেখি দূরে পাহাড়ের চুড়া আর সেটা ঢাকা সাদা বরফে। সুন্দর একটা মন মাতানো দৃশ্য। চালক কে বললাম, চল ওটার ছবি তুলবো। একটা জায়গায় সে নিয়ে আসলো। মনে হোল লোকজন এখানে আসে এ দৃশ্য দেখতে। সূর্য তখন অস্ত যাবার পথে। কিছুক্ষন থেকে রওনা হলাম রিসোর্ট এর দিকে। যেতে যেতে চালক জানালো আমি তোমার রাতের খাবার তৈরি করবো। কি খেতে চাই জেনে নিলো। রিসোর্টে পৌঁছে স্নান সেরে নিলাম। বেশ ঝরঝরা লাগছে। সেরে আসলাম জম্পেশ রাতের খাবার। আমার পছন্দ মতো রেঁধেছে গাইড। টেবিলে সারভ করে দিয়ে গেলো। রুমে যেয়ে হিটারটা ছেড়ে দিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে উঠতে হবে।
সকাল দশটায় বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে “টাইগার নেস্ট”। প্রথম দুর্গ এখানকার। পাইন সারির মাঝখান দিয়ে রাস্তা। দুর্গটা অনেক উপরে। গাইডকে জানালাম আমার অপারগতা উপরে উঠতে। দূর থেকে ছবি নিলাম ওটার। পর্বতের পাদদেশে কুঠির শিল্পের পশরা বসিয়েছে ভুটানের মেয়েরা। পর্যটকরা দেখলাম দামাদামি করছে। ফিরতি পথে দেখলাম দু পাশে আপেল বাগান। ফুল এসেছে। এই প্রথম দেখলাম আপেলের ফুল। সাদা। খুব সুন্দর। গাইড আখ্রটের গাছ দেখাল। আগে কখনো দেখিনি। বেরোবার পথে দেখলাম স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা রাস্তা পরিষ্কার করছে। অবাক লাগলো। গাইড জানালো ছুটির দিনে তারা এটা করে পরিবেশ ভালো রাখতে। বেশ মজা লাগলো দেখতে। গাড়ী থেকে নেমে কথা বললাম। খুব ভালো লাগলো তাদের ইচ্ছা ও মনোবল দেখে। খুব হাসি খুশী তারা।
ওখান থেকে বেরিয়ে “ছেলেলা পাস” যাবো। ওটাকে ওরা হিমালয় দেখার পয়েন্ট হিসাবে দেখে। অনেক উঁচুতে। যাবার পথে আরেকটা পুরানো দুর্গ দেখাল চালক। সুন্দর জায়গাটা। তারপর শুরু হোল আকাবাকা পাহাড়ি পথ দিয়ে “ছেলেলা পাস” যাত্রা। উপরে উঠছি তো উঠছি। ছবির মতো ছোট হয়ে আসছে নীচের সবকিছু। এক জায়গায় এসে চালক থামল। সামনে তাকিয়ে দেখি হিমালায়ান ইয়াক। বিশাল শিং। গা ভর্তি পশম। এই পশম দিয়ে ওরা পোশাক বানায়। চালককে নামতে দেখে আমিও নামলাম। বলল ছবি তুলতে। দু পাশে দুটো দাড়িয়ে। একটি সাদা ও একটি কালো। তখনি ঘটল বিপদ। তেড়ে এগিয়ে এলো হিমালয়ের সাদা ষাঁড়। চালক ও আমি পরে গেলাম পাহাড়ি মাটিতে। দেখলাম চালক আমাকে কাভার দিয়ে রেখেছে। তাড়াতাড়ি গাড়ীতে উঠে বসলাম। ভাগ্য নেহাত ভালো। নইয়ে সেদিন ই হতো আমার সলিল সমাধি। ৩০০০ মিটার উপর থেকে পতন। খুজে পাওয়া যেত না। দেখি সাদাটা আর নেই। কালো ইয়াক এর ছবি তুলে নিলাম।বুঝে নিলাম সাদাটা নিশ্চয় পুরুষ।তার মহিলা বন্ধুকে বাচাতে তার এই আক্রমণ।আমরা মানুষ জাতি এরকম হই না কেন? তাহলে বাংলার মাটিতে বর্তমান অবস্থা আসত না। ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসলাম। দেখি আর একটা পর্যটনের বাস। অনেক লোক। চালক ব্যান্ডেজ নিয়ে আসলো ওদের কাছ থেকে। আঙ্গুল বেশ কেটে গিয়েছিলো আমার। ভালো করে বেধে দিলো। অনেকক্ষণ ছিলাম ওখানে। আশা হিমালয় উকি দিবে। ভাগ্য নেহাত মন্দ। আকাশ আর পরিষ্কার হোল না। হিমালয় ও ধরা দিলো না চোখের সামনে। বেশ দূরে দেখা গেলো গাড় কুয়াশার মতো মেঘের মেলা।
নামার সময় ভীষণ ভালো লেগেছিল পর্বতের সাজানো ফুলের বাগান। প্রকৃতি আপন মনে সাজিয়েছে সবুজ আর হরেক রকম ফুল দিয়ে। পাহাড়ি ফুল। প্রকতিই এর মালি। মাঝে মাঝে নেমে ছবি তুললাম। অত উপর থেকে নীচের দৃশ্য অপূর্ব লাগছিল। সবুজ আর সবুজ। সন্ধ্যে নাগাত ফিরে এলাম ডেরায়। আগামী কাল ভোরে ফ্লাইট। দেশে ফিরার পালা। তাড়াতাড়ি শুতে হবে। বিদায় ভুটান।
আমার ভুটান দেখার শেষ দু দিন |||| আবুল জাকের লেখকঃ পাস্ট ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ।
-এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন