শেষ প্রেসক্রিপশন | পুলক বড়ুয়া
প্রিয়তমা, এই করোনায় আমাকে আর প্রেম করতে বলো না । পিরিতি নয়, পীড়ায় এখন আমরা উদ্বিগ্ন । তোমার চারপাশে তাকিয়ে দেখ । কী পীড়ন । নিপীড়ন ।
করোনায় প্রণয় নয়, জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তায়, অস্থিরতায়, টানাপড়েন-দোদুল্যমানতায় সময় এখন জবুথবু, হিমশিম । একসময়, এর আগে, সবাই যার যার মতো ভালোই ছিলাম । এখন আমরা অসুখী । একবিংশ শতাব্দীতে মহামারীর আয়ু এত বেশী কেন ? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শনৈঃশনৈঃ এই মহাবিস্ময়ের কালে ? কেন মহামারীতে বিধ্বস্ত প্রেম ! জানি না, কোন বৈধব্যের শিকার হতে চলেছে, আমাদের আক্রান্ত প্রণয় । ভারাক্রান্ত ভালোবাসা ।
প্রিয়তমা, তুমি আমাকে কথা দাও, তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না । এই যে, লকডাউনের আগমুহূর্তে সহস্র প্রান্তজনেরা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে ; যেহেতু, তাদের কেউ বেচাবিক্রির জন্যে ফুটপাতে বসতে পারবে না ; কোনো রিকশাচালক রাস্তায় নামতে পারবে না ; কোনো দিনমজুর কোনো কাজ পাবে না, কর্মহীন দিন গুজরান করতে হবে; নির্মাণ-শ্রমিককে ঠায় ঘরে বসে দিন গুনতে হবে ; গৃহকর্মী মানেই এই সময়ে ভদ্র- লোকদের গৃহ থেকে বিতাড়িত ; এক অর্থে, গরীবগুর্বো মানুষগুলো বেশুমার কাজ-কামহীন । আয়রোজগার- হীন শহরে তাদের ঘর ভাড়া কেউ ছাড় দেবে না । কাজে কাজেই, এই অবস্থায় মহানগরে থাকার অর্থ না-খেয়ে মরা । সুতরাং, শাটডাউনে যদি প্রেমহীন থাকি—শুধুমাত্র প্রেম আমাদের ছেড়ে যায়, ক্ষতি কী । কার কী । শোন, একালে, আপনি বাঁচলে প্রেমের দাম ! প্রেমের নাম ! তাহলে, কথাটা কী দাঁড়াল ? বুঝহ সুজন যে জান সন্ধান । তথাস্তু !
প্রিয়তমা, আমি দেখেছি, শাটডাউনের আগে, দলে দলে
গরীব মানুষেরা বাস, ট্রেন, লঞ্চে করে গ্রামে চলে যাচ্ছেন । ট্রেন বা লঞ্চ না-থাকলে মানুষেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দূরের পথ পাড়ি দিচ্ছেন—হেঁটে, ভ্যানে বা রিকশায় চড়ে; ইজিবাইকে, ট্রাকে । সেখানে প্রেমের জায়গা খুঁজে পাই না … ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ( আইএলও ) বলছে, ২০১৯ সালে যত মানুষ বিশ্বে চাকরি হারিয়েছেন, ২০২০ সালে তার চেয়ে ৩৩ মিলিয়ন বেশি কর্মী কর্ম খুইয়েছেন করোনা মহামারির প্রভাবে । এক বছরে একটি প্রেম হারিয়ে গেলে, নস্যি মনে হয় না কী ! আমার একটি প্রেমে কত শ্রম, ঘাম—অপচয় হয়েছে বলে মনে হবে ?
দেখ, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বেশিরভাগ মানুষের উপার্জন ও রুটিরুজি আজ ক্ষতিগ্রস্থ । প্রান্তিক মানুষের পায়ের নিচে মাটি নেই । তাদের বাসস্থান, খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা হতাশাগ্রস্থ : দিনের পর দিন অব্যাহত ঝুঁকি সাধ ও সাধ্যের তলানিতে গিয়ে ঝিমিয়ে পড়েছে, ঠেকেছে । বাস্তবতার পানপাত্রে শেষচুমুকে শেষবিন্দু উঠে আসার অপেক্ষায় । অন্যদিকে, বহু ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা অথবা নিয়োগদাতা বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। এরকম জরুরি ও মানবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রও কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না।
কত নারী-পুরুষ পেশা হারিয়েছেন অথবা জীবিকা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন, তার হিসাব নেই । করোনা কেড়ে নিয়েছে । কোভিড ছারখার করে দিয়েছে । উল্টে দিয়েছে । তুমি কি হারিয়েছ ? তোমার প্রেমিক ? সে কথা শুনে, আমার মুখে হাসির রেখা আলতো চুমু খেয়ে গেল, খেলে গেল; একটু আঁচড়-চিমটিও কাটল ! পেটে ভাত নেই, তার আবার মনের ক্ষুধা! হায়রে, বসুধা, জৈবিক প্রেম আগে, না, আত্মিক প্রেম ? চালচুলো উড়ে যাচ্ছে, কোথায় প্রেমিক-প্রেমিকা ! মহানায়িকা ! আমি মহানায়ক হতে চাই না : এই মহামারিতে। এই অতিমারিতে—আমি কোনো সতীর পতি হতে চাই না, প্রেমে পড়তে চাই না । আর আশিক হতে চাই না। নিউ নরমাল লাইফে নব্য প্রেমিক হওয়ার শর্তে আমার প্রেমের নবায়ন চাই। আমিও চাই, অন্ধকারে তোমার প্রেম রুপালি রেখা হয়ে উঠুক।
মহামারীতে গ্রামগুলোতে ধর্মীয় ভাবাধারাপুষ্ট মদদ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মাফিয়াতন্ত্রের পাঁয়তারা মওকা পায় । বল, এখানে তাকে ছাপিয়ে উঠবে প্রেম ? রুখবে কোন প্রণয় ? প্রেমের সেই আত্মজয়ী অবাধ অধিকার, দাপট, ভাবাবেগ কই ? মহামারিতে রূপান্তরের অভিঘাত আসে অনিচ্ছুক সমাজেও। তাতে, অনিচ্ছুক হলেও আমিও যদি বদলে যাই, তার ধাক্কায়, তুমি অবাক হবে ! এ সময়ে ফাটকা ব্যবসায়ী, ঋণখেলাপি আর লুম্পেন তথা মাফিয়া অর্থনীতি আরও সবল হয়ে উঠেছে । বল, কোথায় প্রবল প্রেম ? অতিমারি বিশ্বজুড়ে নিঃস্ব করে চলেছে যাবতীয় প্রেমের সুকুমার শিল্পচর্চা—নন্দনবিশ্ব।
মহামারী যেন এক বুলডোজার । বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে।
মানুষের প্রেমের প্লাবনের পলি, মহামিলনের ঢেউ কেন তাকে ঢেকে দিতে পারছে না, ভাসিয়ে নিতে পারছে না ।
নিউ নরমাল কী, আমি বুঝি না ! আমাকে হতে হবে বেশ্যার দালাল । সে তো তথাকথিত প্রেমের চেয়ে এই সময়ে অনেক উপকারী ! অনেক ভালো । ভন্ডামীর চেয়ে বহুগুণে সোজাসাপ্টা, সহজ সরল । আগে তো নিজের এবং অন্যের জান বাঁচাতে হবে । এই দুঃসময়ে সেটা দিলের কারবারি, হকদারির চেয়ে, দিওয়ানা হওয়ার চেয়ে, বহুত ফরজ । এই মহাপীড়া ও মহানিপীড়ন থেকে মুক্তিই সবার কাম্য । সর্বাগ্রে আপন। জীবন অনেক বড়। তারপর এসো । ভালোবেসো । পাশাপাশি বসি । মাখামাখি করি । ফস্টিনস্টি । প্রেম । কত অজানারে ! আমাদের প্রেমের ফাটলে হবে নতুন সেতুবন্ধন । এক নয়া যুগলবন্দী ।
নারী, আজ আমার সামনে তোমার অন্তহীন প্রেম, অর্থহীন । নারী, আজ আমার কাছে তোমার অব্যর্থ প্রেম, ব্যর্থ । এ মুহূর্তে আমি কোনো সুবর্ণরেখা অতিক্রম করতে গিয়ে হোঁচট নয়, হতোদ্যম । আমি তথাকথিত রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে চাই । আমি বলে দিতে চাই—আমি এসব বুঝি না, আমি এসব জানি না, কিছুই মানি না । আমাকে ক্ষমা কর। তার আগে আমাকে একটি মহামারী বিমুক্ত বিশ্ব দাও । এই ডুবুডুবু দুনিয়াকে বাঁচাও । তারপর আমি তোমার সাথে হাবুডুবু খাব ।
আমি কারো সাফল্যের রোমাঞ্চকর গল্প শুনতে প্রস্তুত নই। আমার চোখের সামনে, হাসপাতালে বেড নেই । আই সি ইউ নেই । অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই। অপেক্ষমানদের পরীক্ষার যথেষ্ট কেন্দ্র নেই । আক্রান্তদের নিয়ে স্বজনেরা হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছেন । এখানে সেখানে ঘুরছেন । অসহায়-দিশেহারা ফিরছেন ! আর যারা এই রণাঙ্গনে ঈশ্বরের পরে অদ্বিতীয় প্রথম সারির একমাত্র সম্মুখ যোদ্ধা—সেই ডাক্তার কিংবা চিকিৎসাকর্মীরা কী সকরুণ মায়াহীন মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে আছেন—তারপর— পরম মমতায় টুপ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন । কুছ পরোয়া নেহি ! মানুষ ঈশ্বরের সেরা জীব হয়েও কত সমান্য একটি অণুজীবের কাছে পরাস্ত একের পর এক ধরাশায়ী ! এই অণুজীবের ভয়াবহতার কাছে আমার প্রেমের ধারণা কুপোকাত।
প্রিয়তমা, তুমি আমাকে ভাবাবেগের কবল থেকে মুক্তি দাও । তুমি আমাকে তোমার বুকের বাঁধন থেকে বন্ধনহীন কর। তুমি আমাকে হৃদয়ের দন্ড দিও না আর।
তুমি আমাকে অথবা একে ভাবতে পার, অতিমারির অতিচাপে প্রেমের প্রলাপ ।
করোনার দম্ভ—লম্ফঝম্ফের সাথে পাল্লা দিয়ে আমি আর পারছি না । আমার নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে অমূর্ত অসুখ, বিমূর্ত বিষ । আমার কাছে এসো না । বরং আমার জন্যে চিতা সাজাও । একটি কবর খুঁড়ে রাখ । তোমার হৃদয়ে নয় । সেখানে তোমার প্রেমের সমাধি কর । আর আমার প্রেমের গোর দিও । আমি আর কোনো হার্দিক চরণে দাঁড়াতে চাই না । আমার সটান স্থান, সমাপ্তি-ঠিকানা : শশ্মান-গোরস্থান—প্রেমহীন অপাঙ্ক্তেয় সারিতে, শেষদীর্ঘতম পঙ্ক্তিতে, অতিমারির মড়ক ও মোড়কে ।
প্রিয়তমা, শেষপর্যন্ত তুমি আমাকে মার্জনা কর । ফিরে যাও । এখানে কোনো সঙ্গী হয় না, বিনিময় হয় না, সখ্যতা নেই । করোনায় মুখ দেখাও বারণ । আমরা এখন কেউ কারো নই। দূরে যাও। তফাৎ যাও । সরো ।
নারী, গোটা দুনিয়া এখন রোম । বোম । পুড়ছে । এ সাম্রাজ্যের আমি নই কোনো সম্রাট । আমি নই কোনো নিরো । আমি নই তোমারও । আমি আর বাঁশিতে ফুঁ দেব না । আমি আর কোনো আড় বাঁশি নেব না । প্রেমের বাঁশি ছোঁব না । ধরব না । ত্রিভঙ্গ মুরারী হয়ে বাজাব না । সে ডাকে তোমাকে কেউ আর ঘরছাড়া করবে না । এখন ঘরে থাকাই তো নিরাপদ । ঘরে থাক । যেহেতু, বাতাসে ভাইরাস । মুখে মুখোশ । আমিও বাঁশিতে ফুঁ দেব কী করে । রন্ধ্রপথে ঢুকবে জীবাণু, জীবন-সংহারী । আর সম্ভব নয় মোটে । মুখে শখের নয়, সত্যকার মুখোশ। নব্য মুখশ্রী ! আমরা এখন নিউ নরমাল ! যাও হে, দূরত্ব রচনা কর ! সুদূরিকা হও ! সুদূরতমা হও !
এমন বিচ্ছেদ-লগন ! এখন কালো মুখোশপরা কালো মহাকালোকাল বিরহকাল দহনকাল!
এখন ভালো থাকার এই একমাত্র ঔষধ : সেপারেশন ! ফারাক !