মৎস মারিব খাইবো সুখে -৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার
জাপানের মাটিতে পা রেখে আমার এক অগ্রজের কাছে শিখেছিলেম জীবন ধারণের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় শব্দাবলী – হাই (হ্যাঁ), ইয়ে (না), আরিগাতো (ধন্যবাদ), সুমিমাছেন (দুঃখিত), সিরা নাই (জানি না), ওয়াকারানাই (বুঝি না)। এর মধ্যে শেষ দুটো শব্দ বড় মোক্ষম। আমার এক পরিচিত দেশী ভাই ( অবৈধ অভিবাসী ) এই ওয়াকারানাই ব্যবহার করে নিশ্চিত deportation এর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। ও ভাইয়ের সাথে রাগ করে রাতে টোকিওর সিনজুকু গার্ডেনে বসে ছিল। পুলিস এসে ওকে জিজ্ঞেসবাদ শুরু করে। ও সম্ভাব্য বিপদের আঁচ পেয়ে খুব ভালো জাপানী ভাষা জানা স্বত্বেও শুধু ঘাড় নাড়িয়ে বলে যায় ওয়াকারানাই। পুলিশ দীর্ঘক্ষণ পণ্ড শ্রম দিয়ে ক্লান্ত হয়ে ওকে ছেড়ে দেয়।
জাপানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগাড়ে অজস্র বাই সাইকেল পড়ে থাকে। আমরা অভাবী দেশের ছাত্ররা ওগুলো থেকে ভালো কিছু বেঁছে নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই। সাইকেলের ফুটো হলে ওটা ফেলে দিয়ে নতুন আরেকটা উঠিয়ে নিয়ে আসি। এমনি এক সাইকেল নিয়ে আমি একদিন চলেছি ইমিগ্রেসন অফিসে। পথে পুলিশ আমায় থামিয়ে দেয়। সাইকেল কোথা থেকে কিনেছি, কতো দামে কিনেছি এমনি অনেক প্রশ্ন। হুট করে মাথায় চলে আসে ওয়াকারানাই শব্দটা। আমি অকাতরে মাথা নাড়িয়ে বলে চলি ওয়াকারানাই, সিরা নাই। আমি জাপানী বুঝি না এই ভেবে ওরা পরস্পরে আমাদের সম্বন্ধে অনেক অপ্রিয় কথা বলে যায়। কোন সূত্র না পেয়ে আমায় অত্যন্ত ভদ্র ভাবে ছেড়ে দেয়। কিছু মানুষ আছে যাদের গায়ে কোন কাঁদা লাগে না। তারা অনায়াসে কাঁদা ঝেড়ে ফেলে ফুরফুরা হাওয়া গায়ে মেখে ঘুরে বেড়ায়। আবার কিছু মানুষ আছে যাদের গায়ে কাঁদা লাগলে খুব সহজে মুছে ফেলতে পারে না। আমি সেই দ্বিতীয় দলে। আমি না জানার মধ্যে, না বুঝার মধ্যে কোন মহিমা খুঁজে পাই না। জানি না কেন যেন এ শব্দগুলো আমার কাছে অপমানজনক মনে হয়। এ শব্দগুলো উচ্চারণ করতে যেয়ে কেন যেন আমার মাথাটা নুয়ে পড়ে।
কানাডাতে মাছ ধরা শিক্ষার দ্বিতীয়-বর্ষে পড়েছি। নদীতে রকের গা ঘেঁসে অজস্র মাছের আনাগোনা। গায়ে সবুজাভ ডোরা কাটা সান ফিস, চকচকে ক্রাপি, সান ফিসেরই আরেক জাত ভাই ভূতরে রক বাস। ওরা অনায়াসে টোপ গেলে। আমি প্রতিদিন বালতী ভর্তি করে বাসায় নিয়ে আসি সেই নাম জানা, অজানা মাছগুলো। একদিন এমনি করে মাছ ধরে যাচ্ছি। নদী তীরে চেয়ারে বসে একজন মহিলা বই পড়ছিলেন। মাঝে মাঝে সে আমার দিকে কেমন ভাবে যেন তাকায়। মনে হয় আমি যেন কি অন্যায় করে চলেছি। একসময় মহিলা উঠে আসে – আমায় অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বলে – hey guy, let them go. আমি বিনীত ভাবে বলি -কেন? মহিলা আমায় বুঝাতে চেষ্টা করে আমি রক বাস ভেবে বেশ কিছু ছোট মুখো বাস ধরেছি যা ধরা দণ্ডনীয় অপরাধ। আমি বুঝতে পারিনে কোনটা রক বাস আর কোনটা ছোট মুখো বাস। জাপানে দীর্ঘ দিন বাস করে জাপানিজ ও কোরিয়ানদেরকে যেমন আলাদা করে চিনতে পারিনি তেমনি কোনটা ছোট মুখো বাস আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনা। মহিলার কাছে মাথা নত করে বলি আমি জানি না ( সিরা নাই) । সিরানাইয়ের গ্লানি আমায় কুড়ে কুড়ে খায়। আস্তে আস্তে মাছ ধরার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। একটা ভয় তাড়া করে। মাছ ধরার চারণক্ষেত্রগুলো আস্তে আস্তে সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়। আমি নিভৃত অঞ্চল খুঁজে বেড় করি।
একদিন এক বিকেলে ব্রিজের নিচে এক সুনসান জায়গা। প্রচুর সান ফিস। কোথা থেকে ছুটে চলে আসে ছোট্ট একটা মেয়ে। আমায় একটার পর একটা প্রশ্ন করতে শুরু করে। why you catch fish? do you eat them? why? ওর প্রশ্নে আমার কান ঝালাপালা করে। আমি নিরুত্তর থাকি। কিছুক্ষণ নীরবে আমায় নিরীক্ষণ করে আবারো বলে ওঠে – you caught a lot, would you please show me? আমি কিছু বলতে না বলতেই মেয়েটা আমার ঢাকনা দেওয়া বালতিটা খুলে ফেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। you very bad. you killed them. you are cruel, you are cruel, dad see… মেয়েটার বাবা লজ্জিত হয়ে ওকে টেনে নিয়ে যায়। ওর কান্না থামে না। ও পিছু ফিরে বার বার আমার দিকে ঘৃণাভরে তাকায়। আমি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকি। ঐ ছোট্ট মেয়েটার কাছে নিজকে ভীষণ ছোট মনে হয়। আমি নিজের মধ্যে কুঁকড়ে যাই। মনের মাঝে অনেক প্রশ্ন – সত্যিই কি আমি নিষ্ঠুর, সত্যিই কি আমি মন্দ লোক ! অজস্র প্রশ্ন এক হোয়ে এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে বরশীর মতো আমার সামনে ঝুলে থাকে। আমার দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেড় হোয়ে আসে আবারো সেই অসহায় শব্দ – সিরা নাই, জানি না, জানি না…চলবে…
মৎস মারিব খাইবো সুখে -৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান