গেম রুমে চলে নির্যাতন সাগরযাত্রায় দেনদরবার অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা
একটু ভালো করে বাঁচব বলে আর একটু বেশি রোজগার- অঞ্জন দত্তের গানের এই লাইনের মতো যেন ইউরোপের দেশগুলো চুম্বকের মতো টানে অনুন্নত, যুদ্ধপীড়িত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর তরুণদের। তাই তো এসব দেশে পৌঁছাতে তাদের মরিয়া চেষ্টায় গত এক দশকে কত যে প্রাণ ঝরে গেছে তার ঠিক নেই। তবু থামছে না এই প্রবণতা। আর এতে উসকানি বা প্ররোচণা যোগাচ্ছে দেশি-বিদেশি দালালচক্র।
ইউরোপের দেশগুলোয় নেওয়ার কথা বলে তারা তরুণদের কখনো স্বেচ্ছায় বা কখনো জোর করে ঠেলে দিচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিতে। তাই তো প্রায়ই সামান্য কাঠের বা রাবারের নৌকায় গাদাগাদি করে উত্তাল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় দুর্ঘটনায় প্রাণহানির খবর আসছে। এ যেন ইউরোপের উন্নত জীবনের স্বপ্নের কাছে বিলীন মৃত্যুর ভয়। গত ৮ জুলাই লিবিয়া হয়ে ইউরোপ যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে দুর্ঘটনায় পড়া ৪৯ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। এর আগে গত জুনের শেষদিকে কয়েক দফায় ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করা হয় তিন শতাধিক বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীদের।
টাঙ্গাইলের ৩৩ বছরের যুবক হাবীবুর রহমান। দালালচক্রের ফাঁদে পা দিয়ে ভূমধ্যসাগরের বিশাল জলরাশি কিংবা দালালচক্রের নির্যাতন ডিঙিয়ে তৈরি করতে চেয়েছিলেন এক নতুন ইতিহাস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। একই রকম ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে শরীয়তপুরের ২৫ বছরের যুবক কৌশিককেও। অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হয়ে তাদের ফিরে আসতে হয়েছে দেশে। কথা হয় তাদের সঙ্গে।
হাবিব ও কৌশিক জানান, তারা ইউরোপে যেতে চেয়েছিলেন মূলত ভালো আয়, উন্নত জীবন, ব্যবসা বা চাকরির সুবিধার জন্য। দালালরাও তাদের বলেছিল, সহজে ইউরোপ পৌঁছে দেবে। আর সে প্রলোভনে পা দিয়েই তারা ফেঁসে যান। অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াকে দালালরা বলে ‘গেম’। এই ‘গেম’-এর অংশ হওয়ার পর প্রতারকদের হাতে জিম্মি হয়ে ইউরোপে যাওয়ার ঘোর কাটে তাদের। দালাল-প্রতারকদের হাতে জিম্মি হয়ে পথে পথে দফায় দফায় লাখ লাখ টাকা গুনতে হয়। ততদিনে পরিবার হারায় শেষ সম্বলটুকুও।
হাবিব জানান, চাচাতো ভাইয়ের মাধ্যমে লিবিয়ায় থাকা এক দালালের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল তার। ওই দালাল তাকে ইউরোপে পৌঁছে দেবে বলে ৭ লাখ টাকায় রফা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশ থেকে তিনি প্রথমে দুবাই, এরপর বাহরাইন হয়ে ভূমধ্যসাগরপাড়ের দেশ লিবিয়ায় পৌঁছান। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে টাঙ্গাইলে থাকা পরিবারের সঙ্গে কথাও হয় হাবিবের। চুক্তিমতো দালালচক্রকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় নানা খরচসহ প্রায় আট লাখ টাকা। এর পর ত্রিপোলিতে হাবিবের ঠাঁই হয় ‘গেম ট্রাপ’ নামে ঘরে। কিন্তু সেখানে গিয়েই ঘোর ভাঙে তার। ওই ঘরে তার মতো আটক আরও অনেকের পরিবারের কাছ থেকে টাকা বুঝে নিতে চলত নির্যাতন। তবু হাবিব হাল ছাড়েননি। কারণ তখন স্বপ্নের ইউরোপ যে সমুদ্রপথে মাত্র আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে। ‘গেম’ ঘর থেকে ত্রিপোলি উপকূলে দালালদের হাত বদলে হাবিবের ঠাঁই হয় একটি ছোট্ট নৌকায়। যেখানে গাদাগাদি করে আছে আরও ১১৫ জন যাত্রী। জাহাজে করে ইতালির উদ্দেশে যাত্রার কথা বললেও তাকে ওই নৌকায় তুলে দেয় দালালরা। শুরু হয় হাবিবের ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার দুঃস্বপ্নময় যাত্রা।
হাবিব বলেন, ত্রিপোলি উপকূল থেকে যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে নৌকার যাত্রীরা শুধু ক্ষণ গুনছিলেন কখন ইতালি পৌঁছাবেন। ত্রিপোলি থেকে ইতালি সাগরপথে পাড়ি দিতে সময় লাগে সময়ভেদে ৩০ ঘণ্টারও বেশি। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু তিউনিসিয়া উপকূলে এসে হঠাৎই বিকল হয়ে যায় নৌকার ইঞ্জিন। পরে তাদের উদ্ধার করে দেশটির কোস্টগার্ড। সেখানে কিছুদিন থেকে গত ১ জুলাই তিনি আইওএমের মাধ্যমে দেশে ফিরে আসেন।
মোবাইল ফোনে যখন হাবিব ভূমধ্যসাগর এবং ‘গেম’ ঘরে থাকার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, সেই ছবি দেখা না গেলেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল চোখে পানি জমেছে তার। বলে চলেছিলেন সেই লোকহর্ষক ঘটনার কথা। যা কোনো সিনেমাকেও হার মানায়। হাবিব বলেন, লিবিয়ায় থাকা দালালের সঙ্গে কথামতো সবকিছু চূড়ান্তের পর ঢাকা থেকে পাসপোর্ট করান। এর পর গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর তিনি দুবাইয়ের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। সেখানে ছয়দিন থাকার পর তাদের লিবিয়া নেওয়া হয় বাহরাইন হয়ে। লিবিয়া পৌঁছানোর পর তাদের দেশটির সেনাবাহিনী রিসিভ করে। দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর তাকে তুলে দেওয়া হয় দালালের হাতে। সেখান থেকে ত্রিপোলির আরেকটি শহর বেনগাজিতে নেওয়া হয়। সেখানে দুই থেকে তিন মাস ছিলেন হাবিব। এরপর তাদের আবার ত্রিপোলি হয়ে আনা হয় জোয়ারায়। সেখানে থাকতে হয় আরও দেড় মাস। এর পরই তাদের ঠাঁই হয় ‘গেম’ ঘরে। দোতলা নৌকায় ১১৩ জন নিয়ে দেওয়া হয় তাদের গেম। সেখানে তিনিসহ ৫৬ জন বাংলাদেশি ছিল। এ ছাড়া সুদান, চাদ ও মিসরের লোকও ছিল। হাবিব বলেন, আমরা যখন তিউনিসিয়ার উপকূলে, তখন ঝড় ওঠে। ১০ মিনিটের এই ঝড়ে আমাদের নৌকার ইঞ্জিন বিকল ও তলা ফেটে ডুবে যায়। আমরা যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছি, তখন হঠাৎ নৌকা পানিতে ভেসে ওঠে। মনে হলো একমাত্র আল্লাহর রহমে এমনটা সম্ভব হয়েছে। কারণ ওই অবস্থায় বেঁচে ফেরা সম্ভব নয়। এর পর আমাদের কাছে থাকা ওয়াকিটকির মাধ্যমে জাতিসংঘের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সে সময় তুরস্কের কোস্টগার্ডের একটি জাহাজ আমাদের কিছু খাবার দিয়ে যায়। জাতিসংঘ তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সাগরে ১৯ ঘণ্টা ভাসার পর তারা এসে আমাদের উদ্ধার করে। এর পর আমাদের আইওএমের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে আমরা দেড় মাস থাকার পর আইওএম তাদের খরচে আমাদের দেশে পাঠিয়েছে।
‘গেম’ ঘরে থাকার দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা করে হাবিব বলেন, লিবিয়ার দালালদের নৌকাগুলোই মূলত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়। নৌকায় ওঠার জন্য গেম ঘরে চলে নানা দেনদরবার। গেম ঘরে ঢোকে না দিনের আলো, নেই বাতাস চলাচল। গরমে সেদ্ধ হওয়ার দশা হয়। দু-তিনদিন পর পর একবার খাওয়া পেতাম, তাও পর্যাপ্ত নয়। একবার ‘গেম’ ঘরে ঢুকলে আর বেরিয়ে আসার উপায় নেই। বাধ্য হয়ে তাকে ‘গেম’ দিতেই হবে। নির্যাতন করে দেশে থাকা পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। একটু ওলটপালট করলেই গুলি করে মেরে ফেলা হয়। চোখের সামনে গুলিতে মেরে ফেলার ঘটনা দেখেছি। তাই মিথ্যা স্বপ্ন নিয়ে কেউ যেন এভাবে ইউরোপ যাওয়ার চিন্তা না করে।
শরীয়তপুরের কৌশিকের গল্পও অনেকটা একই রকম। তিনিও নিজ গ্রামের দালাল শফিক শেখের মাধ্যমে ৭ লাখ টাকায় ইউরোপ যাওয়ার চুক্তি করেন। গত ৫ এপ্রিল প্রথমে ঢাকা থেকে তাকে বাহরাইন নিয়ে যাওয়া হয়। বাহরাইন থেকে দুবাই হয়ে নেওয়া হয় লিবিয়া। ত্রিপোলি বিমানবন্দরে দালাল তাকে রিসিভ করে। সেখান থেকে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে দালালকে চুক্তিমতো টাকা দেওয়া হয়। এর পর তার ঠাঁই হয় সেই ‘গেম’ ঘরে। এক দিক দিয়ে কৌশিক সৌভাগ্যবান। কারণ অনেকের লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর ‘গেম’ দিতে প্রায় ৩ মাস থেকে বছর লেগে গেলেও তিনি এক মাসের মধ্যেই তা দিতে পেরেছিলেন। কৌশিক বলেন, নৌকায় আমরা ১০৫ জন ছিলাম। বিশাল সাগরে ছোট নৌকায় খুব ভয়াবহ অবস্থা। আমরা যখন তিউনিসিয়ার জলসীমায় পৌঁছালাম, তখন সে দেশের কোস্টগার্ড আমাদের উদ্ধার করে। কৌশিকও সবাইকে সাবধান করে বলেন, মোহে পড়ে কেউ যেন এভাবে অবৈধপথে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা না করেন।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত অবৈধভাবে ইউরোপ যাত্রার সময় ভূমধ্যসাগরে অন্তত ৮১০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী প্রাণ হারিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যানুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে ৮১৩ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালে ইতালি রুটে ভূমধ্যসাগরে ৯৮৩ অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়। সব থেকে বেশি মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছিল ২০১৬ সালে। ওই বছর ৪ হাজার ৬০০ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নিবন্ধিত হয়েছিল। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী ভূমধ্যসাগরে ২৩ শতাধিক অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যুর ঘটনা রিপোর্ট হয়।
‘মিসিং মাইগ্রেটস’ গবেষণাপত্র অনুযায়ী ওই বছর ভূমধ্যসাগরে এর দ্বিগুণসংখ্যক অভিবাসী নিখোঁজ হয়েছেন। মানবপাচারকারীদের কবল থেকে উদ্ধার হওয়া ১৬০ বাংলাদেশি গত মে মাসে আইওএমের সহায়তায় দেশে ফেরেন। ২০১৫ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত সংস্থাটির সহায়তায় ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ২ হাজার ৯৫০ বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন। আগে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে এখন তিউনিসিয়ায় সাত শতাধিক বাংলাদেশি রয়েছেন।
#আরিফুজ্জামান মামুন, আমাদেরসময়
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান