ইউরোপের বাজারে সবজি রপ্তানি বাড়ছে
নিজের জমিতে আবাদ করা সবজি কখনো সুইজারল্যান্ডে যাবে, তা যেন স্বপ্নেও ভাবেননি শরীয়তপুরের জাজিরার বিলাশপুর মুলাই ব্যাপারীকান্দি গ্রামের কৃষক বেলায়েত হোসেন। যা স্বপ্নেও ভাবেননি, তা এখন বাস্তব। সম্প্রতি তার আবাদ করা লাউ পাঠানো হয়েছে সুইজারল্যান্ডে। শুধু বেলায়েত নন, তার মতো অনেক কৃষকের আবাদকৃত ফল, সবজি এখন বিদেশে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ফল ও শাকসবজি রপ্তানি দিনে দিনে বাড়ছে। কৃষি অধিদপ্তর সূত্র বলছে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইউরোপে সবজি রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৩০৭ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ১ হাজার ৯১৩ টনে। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই ১ হাজার ২০৭ টন শাকসবজি রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ফল রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ২০৩ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা হয়েছে ৩ হাজার ১৯৯ টন। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১ হাজার ৬৫৯ টন ফল রপ্তানি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাজ্যে।
সূত্র জানিয়েছে, দেশে প্রতি বছর মৌসুমের সময় অনেকটা পানির দরে সবজি বিক্রি হয়। এতে কৃষকদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়। কিন্তু যদি ইউরোপে দেশের সবজির বড় বাজার গড়ে ওঠে, তাহলে আর এই সমস্যা থাকবে না। কৃষকেরা তার কষ্টার্জিত ফসলের নায্যমূল্য পাবেন। এছাড়া ফল ও সবজি রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। তবে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের দেশগুলোতে শাকসবজি রপ্তানি করতে হলে এই খাতের সঙ্গে জড়িত উৎপাদনকারী, বিপণনকারী ও রপ্তানিকারককে অবশ্যই ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) দ্বারা স্বীকৃত খাদ্যপণ্য (ফল ও শাকসবজি) নীতির মানদণ্ড পূরণ করতে হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর শর্তানুযায়ী গুড এগ্রিকালচার প্র্যাকটিস বা গ্যাপ অনুসরণ করে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে যে ফল ও শাকসবজি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়, তা সাধারণত সেখানে অবস্থানরত বাঙালি কমিউনিটির বাজারেই বিক্রি হয়। সেখানে চেইন শপগুলোতে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা ফল ও শাকসবজি দেখা যায় না বললেই চলে। কারণ সেখানে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কিত বিশেষ শর্ত পালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিশ্ববাজারে বিশেষ করে ইউরোপের বাজারে ফল ও শাকসবজি রপ্তানি বাড়ানোর বিষয়ে সরকার আন্তরিক। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ‘বাংলাদেশ ফাইটোসেনেটারি সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ২০১২-২০১৯ সময়ে প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর শ্যামপুরে সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজ নির্মাণ করেছে। ২০২১ সালে ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রীয় এই প্যাকিং হাউজেই স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, যাতে বিদেশে রপ্তানির জন্য ফল ও শাকসবজির মান এখানেই পরীক্ষা করা যায়।
সম্প্রতি রাজধানীর শ্যামপুরে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে গিয়ে দেখা যায়, প্যাকিং হাউজের নিচতলা ও দোতলায় সবজি ও ফলমূলের মান যাচাইবাছাই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ধোয়া ও শুকানো এবং মোড়কজাত করার জন্য আলাদা আলাদা অত্যাধুনিক কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রয়োজনে ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সবজি ও ফলমূল সংরক্ষণের জন্য কয়েকটি কুলিং কক্ষ ও ভবনের তৃতীয় তলায় রপ্তানিকারকদের প্রশিক্ষণের জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণকক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ফল ও সবজির মান পরীক্ষার জন্য ১০টি ল্যাব নির্মাণ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ইউরোপের যে কোনো দেশে সবজি ও ফলমূল রপ্তানির জন্য নিয়মিতই সালমোনেলাসহ যে কোনো ধরনের দূষণ, কীটনাশকের রেসিডিউ, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণ রয়েছে কি না, বিভিন্ন ধরনের এমআরএল পরীক্ষা করা যাবে এখানে।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির পরিচালক ড. জগত চাঁদ মালাকার বলেন, আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে স্থাপিত এই ল্যাবরেটরির অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রায় সিংহভাগই সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি, ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে প্যাকিং হাউজের কাজ শেষ হবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি নির্মাণের ফলে দেশের শাকসবজি ও ফল রপ্তানিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে। কারণ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) মান অনুযায়ী এখানে পরীক্ষা করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানের এই ল্যাবে কাজ করার জন্য ইতিমধ্যে কোয়ারেন্টাইন কর্মকর্তাসহ মোট ১৮০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আলাদা কোয়ারেন্টাইন কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে।