১৯৯৫ এ, দেশ ছেড়ে কানাডা চলে আসার পর প্রথম দেশে যাই ১৯৯৯ এর জানুয়ারী মাসে। ৪ মাস দেশে থেকে আবার ফিরে আসি কানাডাতে, কিন্তু মন বসাতে না পেরে আবার ঐ বছরই নভেম্বর মাসে একা চলে যাই। প্রথম বার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যাই। এভাবে চলে যাওয়ার কারণ ছিল পরোলোকযাত্রা বড় মেয়ের সন্তানটির জন্যে কিছুতেই সুস্থির থাকতে পারছিলাম না, ওকে নিয়ে আরো কিছুদিন থাকবো বলেই চলে যাই এবং এবারেই সেই ৪ মাস, চলে আসার সপ্তাহ দুয়েক আগে ঢাকাতে চলে আসি ভাবির বাসায় (আমি সব সময় এখানেই থাকি) একদিন সকালে খালা (ভাবির খালা) এসে বললেন জাবেদের (ওনার ছোট ছেলে) বিয়েতে তুমি ছিলেনা ও শ্বশুর বাড়ী দেখ নাই, আগামী কাল ওরা যাবে বেড়াতে, তুমি আর রোশনা ওদের (ভাবীর নাম) সঙ্গে গিয়ে বেড়িয়ে আস। প্রথমে না করে দেই পরে জাবেদের বউ লূনার পীড়া- পিড়ীতে রাজী হয়ে গেলাম ।
ওয়ারী থেকে রিকশা করে গুলিস্তান, সেখান থেকে বাসে করে কালীগঞ্জ, কালীগঞ্জের জাঙ্গালীয়া ওদের বাড়ী। কালীগঞ্জ শুধু কুখ্যাত খুনী ইমদুর দেশই নয়। এই কালীগঞ্জের ছলাদী মিয়া বাড়ীর ছেলে মরহুম হুমায়ূন খাঁন সাহেব ছিলেন একজন ভালো, নামী লেখক এক জন গেজেটেড অফিসার, ওনারই ছোট ভাই আশরাফ খাঁন পেপারে চাকুরীরত ছিলেন সেই সময়। হুমায়ূন সাহেব অনেক বার আমন্ত্রন জানিয়েছেন তাঁর বাড়ীতে বেড়াতে যাওয়ার কিন্তু আমাদের আর সময় হয়ে উঠেনি।
এত বছর পরে সেই কালীগঞ্জে আসার সুযোগ হলো । বাস থেকে নেমে বেবী ট্যাক্সি নিয়ে আমরা চলে আসি জাঙ্গালীয়া হাইস্কুলের মাঠে এখানে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে আমরা পায়ে হেঁটে চললাম স্কুলের পেছন দিকে, এখানে বলে নেই এই স্কুলটার বয়স তখনই একশত বছর পার হয়ে গিয়েছিলো। স্কুলের পেছন দিকে অনেক নীচুতে ধান ক্ষেত, মাত্র চারা লাগানো হয়েছে। দু পাশে ক্ষেত মাঝ বরাবর কাঁচা রাস্তা সোজা চলে গ্রামে, দশ মিনিট হেটে রাস্তা থেকে বাড়ীর সীমানায় পা দিয়েই আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ছোট বেলায় মুখস্থ করা কবিতার লাইন আপনা আপনি মুখে এসে গেল। ‘আমগাছ, জামগাছ বাঁশঝাড়, যেন মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন’ ।
কবিতার এই লাইন গুলোকে বাস্তবে রূপ দিয়ে সত্যিই দুটা বিশাল আম ও জামের গাছ দাড়িয়ে আছে পাশাপাশি। আমি জামের শুরুটা দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম । বাড়ীর সীমানা থেকে মূল বসত বাড়ীতে যেতে কয়েক মিনিট লেগে যায় চারিদিকে ফলের গাছ আর গাছ। পুরানো গুলোতে মৌসুমী ফল ধরে আছে, বাকি সব নতুন, বড় হচ্ছে দু-চার বছর পরেই ফলে ফলে ভরে উঠবে বাড়ীর চারি দিকে গাছপালা।
মনে মনে ভাবলাম যদি না আসতাম তাহলে এত মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত থাকতাম। বাড়ীর সামনে বড় পুকুর, বাড়ীর দুপাশে বড় বড় মাটির ঘর, একখানা দোতালা সেও মাটিরই- কিন্তু কি মজবুত। এর আগে আমি এমন নীরেট মাটির তৈরী ঘর দেখিনি, আমাদের সিলেট অঞ্চলে বেড়ার উপর মাটির প্রলেপ লাগিয়ে মাটির ঘর তৈরী হয়। উঠানের আগে, বরই, আম, পেয়ারা গাছ ছাড়াও লাউ শিম এই জাতীয় তরকারীর ক্ষেত আছে। পরিচ্ছন্ন উঠান, কল ঘর, সব কিছু এত পরিস্কার তকতকে আমি যে দিকে তাকাই মুগ্ধ হয়ে যাই। বিকালে যাওয়ার পরে লুনা আমাদেরকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো ওরা চাচাদের বাড়ীতে। সব বাড়ীতেই গাছপালা আছে দেখে মনে হলো একমাত্র লুনাদের বাড়ীটাই বিশাল সীমানা নিয়ে দাড়িয়ে আছে আর সকলের ভাগ ছোট ছোট। ওদের গ্রামের চারিদিকে ধান ক্ষেত, ওদের গ্রামটা টিলামত জায়গায় ঠিক আমাদের সিলেটের মত উচু নীচু টিলা, লাল মাটি, ঝোপ, ঝাড় কিন্তু বেশীই বিভিন্ন ফলের বাগান ।
সবকিছু ঘুরে দেখে এবং লুনার চাচাতো ভাইদের বাড়ীতে টুক টাক খেয়ে ওদের বাড়ীতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল ।
সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম এক পাল হাঁস মুরগী এসে আশ্রয় নিল খোয়াড়ে । ত্রিসন্ধ্যার শান্ত পরিবেশে বারান্দায় বসে লুনার আম্মার জীবনের ঘটনা শুনতে শুনতে বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
এখন আমি এই বিধবা ভদ্র মহিলার কথা লিখছি পাশের গ্রামে মহিলার বাবার বাড়ী, বড় বড় কয়েক জন ভাই বোন মারা যাওয়াতে ওনার মা স্তব্ধ হয়ে যান, সংসার থেকে সম্পূর্ন রুপে নিজেকে গুটিয়ে নেন, তখন তাঁর বাবাই একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আবার ধৈর্য্যে বুক বেধে দাড়ান ।
মেয়েটির বিয়ের বয়স হলে পরে পাশের গ্রামের সিরাজ চৌধুরীর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেন যাহাতে সব সময় মেয়েকে দেখতে পারেন। সিরাজ সাহেব সরকারি চাকুরী করতেন। বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতেন, কিন্তু স্ত্রীকে বেশী দিন কাছে রাখতে পারতেননা, স্ত্রী ব্যাস্ত হয়ে পড়তেন মা বাবার জন্য । সিরাজ সাহেব স্ত্রীর কষ্ট বুঝতেন তাই বেশী সময় তিনি একা থাকতেন স্ত্রী সন্তানকে শ্বশুর বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়ে। এক ছেলের পরে পরপর তিন মেয়ে হলো ওদের, তখন অনেক আশায় সিরাজ সাহেব এই নতুন বাড়ী তৈরীতে হাত দিলেন, একটা ঘর তৈরী হয়েছে মাত্র, ঐ সময় ভদ্রলোক কি একটা অসুখে মারা গেলেন, মারা যাওয়ার খবর বাড়ীতে জানানো হল না। বাড়ীতে খবর পাঠানো হলো ওনার শরীর বেশী খারাপ তাই বাড়ীতে নিয়ে আসতেছে। লুনার আম্মা বল্লেন আমার বুকের মধ্যে শুধু কেমন করতে ছিল আমি এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারছিলাম না, এক ছুটে যাই মার কাছে, আবার অস্থিররতার জন্য সেখান থেকে চলে আসি নিজের বাড়ীতে আমার যে কেন এমন করতেছে আমি কিছুই বুঝতে পাতে ছিলাম না। এক সময় ইঞ্জিন চালিত নৌকার আওয়াজ শুনে সবাই ছুটে যান নৌকা ঘাটের দিকে, সিরাজ সাহেবের বোন সবাই কে বলেন খুব সাবধানে ধরে ওকে নাও থেকে নামাও যেন ব্যাথা না পায় ।
তার পরে যখন কাঠের বাকসো নামানো হলো নৌকা থেকে তখন তিনি আর কিছু বলতে পারবেননা। বৃদ্ধ পিতার জর্জরিত কাধে এসে পড়ল আবার যুবতী মেয়ে সহ চারটি শিশুর ভার। বৃদ্ধ দিশেহারা হলেন না। শক্তহাতেই হাল ধরলেন মেয়ের সংসারের। কটা মাস কেটে যেতেই তিনি হিসাব করে দেখলেন, তাঁর জামাইয়ের যত জমি জমা আছে তত তার ভাইদের নয়, কাজেই সবাই চাইবে ভাগ বসাতে । ক্ষেত যখন ভাগে করা হয়, যদি জামাইয়ের ভাইয়ের ছেলেরা বলে আমরা ভাগে চাষ করবো আমাদের কাছে জমি দেন, তাহলে তিনি নিষেধ ও করতে পারবেননা, আর এ জীবনে তার নাতী ও সমস্ত জমি ওদের হাত থেকে উদ্ধারও করতে পারবেনা । বৃদ্ধ মানুষটি তখন ভাগী দারদেরকে ডেকে বল্লেন এখন থেকে এদের সমস্ত জমি আমি চাষ করবো এবং আমার জমি আমি বর্গা দেব। (বৃদ্ধের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাই করে গেছেন) শুধু জমি চাষ করেই ক্ষান্ত হননি বাড়ীর চারদিকে ফলের গাছ লাগালেন, বিকাল হলেই মেয়েকে নিয়ে গাছ গাছালিতে সার পানি দিতেলেগে যেতেন, গ্রামের কোন মেয়ের সঙ্গে বসে গল্প করতে দিতেন, যদি গল্প করার ওসিলায় কোন বদ পরামর্শ দিয়ে দেয় মেয়েকে তা হলে, তার নাতী নাতনীগুলো ভেসে যাবে। এ ভাবেই তিনি তার মেয়ের সংসার রক্ষা করেছেন। নাতী উপযুক্ত হয়েছে নিজের জমি জমা বুঝে নিয়েছে, দুটো নাতনির বিয়ে দিয়েছেন আর একটা বিয়ের বাকি আছে, বৃদ্ধের কাধের ভার প্রায় নেমে গেছে ৷
লূনার আম্মার গল্প শুনতে শুনতে বেশ রাত হয়ে গেলো, চারিদিকে স্বলা নেভা দেখছি আর লুনার নামার কথা ভাবছিলাম, ঠিক তখনই এক হাতে হারিকেন অন্য হাতে লাঠি ঠুক ঠুক করতে করতে মানুষটি এস হাজির হলেন আমাদের দেখতে । অনেক অনেক গল্প করলেন, যৌবনে বহু জায়গায় গিয়েছেন গয়না নৌকা করে, এক সময় সিলেটও গিয়েছেন। অনেকক্ষন আমাদের সঙ্গে গল্প করে তিনি ফিরে গেলেন তার বাড়ীতে।
লূনার আম্মার আতিথিয়েতার কথা ভুলবার নয় রাতে এবং পরদিন দুপুরে দুবেলাই রোজ পোলাও খাওয়ালেন, ভোর রাতে ঢেঁকিতে চালগুড়া করার শব্দে আমাদের ঘুম ভাংলো । সেই শীতের ভোরে পিঠা তৈরী করে আমাদের নাস্তা খাওয়ালেন, আসার আগে ভাবিকেও আমাকে দুখানা চমৎকার শাড়ী প্রেজেন্ট করলেন। শাড়ী গুলো বেলা একটু বাড়তেই ওনার বড় জামাইয়ের বন্ধু নিয়ে আসলেন, দারুন পছন্দ ভদ্রলোকেরা সকালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার আমরা বেবী টেক্সিতে চড়ে বসলাম । রাস্তার দুপাশে বাড়ী ঘর, গাছপালা সরিষার ক্ষেত হলুদ হয়ে আছে ফুলে ফুলে, আমরা টেক্সি থেকে নেমে ক্ষেতের মাঝখানে দাড়িয়ে ছবি উঠালাম । কালীগঞ্জে খুব সম্ভব কোন গোরস্তান নেই। গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়ীতেই ১টা দুটা কবর দেখলাম । কারোর ঘরের পেছনে কারোর বা বাড়ীর উঠানের আগে এমনি সব কটাবাড়ীতেই দেখলাম। অথচ আমরা জানি গোরস্তান পবিত্র স্থান। যেখানে সেখানে মাজারের কাছাকাছি দেওয়া হয় তাহলে সেই মৃত ব্যক্তি নাকি কবরের আজাব থেকে রেহাই পেয়ে যান সেই আউলিয়ার ওসিলাতে। যাকগে এসব কথা।
চলার মধ্যে ভাবি হঠাৎ টেক্সিয়ালাকে বলেন চলেনত ফুলদীতে, ওদিকটাও একটু দেখে যাই। ফুলদী গ্রামে লুনার ফুফাত ভাইর শ্বশুর বাড়ী। ভাবীর সঙ্গে সকলেই খুব খাতির। সেই গ্রামটিও বড় সুন্দর একেকটা বাড়ী অনেক জায়গা নিয়ে সীমানা। চারিদিকে গাছ গাছালিত পূর্ন। বেশী গাছই ফলের। এদেশের আঙ্গুর আপেলের চেয়ে আমার দেশের আতাফল, সফেদা, বরই এগুলোই আমার কাছে বেশী লোভনীয় লাগে। যাই হউক এ বাড়ীতেও চা, পান, খেয়ে একটু খানি গল্প করে আবার রওয়ানা হলাম বাস স্টেশনের দিকে। এত সুন্দর একটি এলাকা এত অল্প সময়ে দেখে কি মন তৃপ্ত হয়ত আমার অন্তত হয়নি। যদি দেশে আবার যাই মনে মনে আশা আমি আবার জাঙ্গালিয়া যাবো। হুমায়ূন খান সাহেবের কথা লিখার ইচ্ছা থাকলো, যদি সুযোগ আসে কখনো।
– রাবেয়া রহিম, মনট্রিল, কানাডা।