চিন্তার জাল ( মন কথন ) |||| | আলিফ আলম
মাঝে মাঝে মনে জমানো কথারা বেশ নড়েচড়ে বসে । জীবনের নানা স্মৃতি এসে কারণে অকারণে ভিড় জমায় । যে সময়টা খুব একা আর নিঃসঙ্গ কাটাতাম, তখন ঘড়ির কাঁটারাও পা টিপে টিপে চলত, সময় ফুরত না একদম। আপাত দৃষ্টিতে এ ছিল কেবলই সময়ের আপেক্ষিকতা । আর এখন সময়কে চড়া দামে কিনে নিতে হয়।
আজকাল আর জন্মভুমির প্রাণের শহরে ফিরে যেতে পারি না যখন তখন, বিনা নোটিশে যেখানে লোডশেডিং হয় । তবে শীতকালে লোডশেডিং তুলনামূলক আরামদায়ক । অন্ধকার বাইরে লাইটের আলোর আধিক্য না থাকায়, চাঁদের আলোর কোমলতা বেশ স্পষ্ট বুঝা যায় । বাড়ির সামনের দিকে গ্রিলে ঘেরাও দেয়া এক চিলতে বারান্দা । রোদ কিংবা চাঁদের আলো দুটোই প্রায়েই, স্বাধীনভাবে মেঝেতে শুয়ে গড়াগড়ি খায় । বারান্দার সামনে তিন প্রহরী হয়ে, নিরবে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা, তিনটি সুপারি গাছের আড়ালে, চাঁদ এসে মাঝে মাঝে উঁকি দেয়।
চেয়ারটা টেনে গায়ে গরম চাদর জড়িয়ে, দু’ হাতে চায়ের কাপ চেপে বসলেই, চায়ের কাপে চাঁদের আলো এসে দিব্যি সাঁতরে বেড়ায় । অন্ধকারে বারান্দা জুড়ে আলো-আঁধারির নকশায় এক ধরণের রোমহর্ষ অনুভূতি টের পাই। মেঝেতে চাঁদের আলোর আলপনা, চায়ের কাপ থেকে বাঁকা ধোঁয়া এঁকেবেঁকে যাবার সময় মনে হয়, দিনের কিছু সময় এমন করে নিজের সঙ্গে অন্তত বসা জরুরি। নিজেকে একা করতে না পারলে নিজেকে ঠিক চেনা যায় না। গ্রিলের ফাঁকে ফাঁকে তারাদের বিন্দু বিন্দু ঝুলে থাকা দেখে, মন এই বস্তু জগত ছাড়াতে চায়।
তখন মনে পড়ে যায় সৌর জগতের কোন এক বিরল দামি পৃথিবী নামক গ্রহের কোন এক দেশের ছোট শহরের বুকে, কোন এক অন্ধকার বারান্দায় আমার অদ্বিতীয় অস্তিত্বের কথা, যেখানে আমার ভাবনারা এসে আমাকে কাবু করে। চিন্তারা মস্তিষ্কে মাকড়সার জাল বুনে আর মনে হয়, এই চলমান প্রকৃতিকে কখনও কখনও আমার খুব নির্বিকার, নিরুত্তাপ আর আবেগহীন মনে হয়। তবে এই যে জীব -জন্ত কিংবা পোকা-মাকড় হয়ে না জন্মে, সৃষ্টিকর্তার বিশেষ বিবেচনায় মানুষ হয়ে জন্মেছি, আর বিনামূল্যে এই জীবন পেয়েছি, এতো বিশাল পাওয়া ! তাই এই দামি মহার্ঘ্য জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে, নিজেকে কখনও কখনও ভাবনার শেষ প্রান্তে হারিয়ে ফেলি ।
বিশাল সময়ের মাঝে আমার এই তথাকথিত সময় যেন হারিয়ে যায় । ঠিক যে সময়টায় বারান্দায় বসে আমি চায়ের কাপে চুমুক দেই, ঠিক সেই মুহূর্তে হয়ত দূরে কোথাও কোন এক নক্ষত্র খসে পড়ে অথবা হয়ত নতুন কোন বিগ ব্যাং তার বিস্ফোরণ ঘটায় ! আমার এই চেনা পৃথিবী ছাপিয়ে, কত বিশাল বড় চলমান প্রকৃতি আমাদের দৃষ্টি সীমার বাইরে রয়ে গেছে, তা আমাদের আজানা থাকত যদি বিজ্ঞান জানার আগ্রহ না দেখাত।
বাড়ির ঝকঝকে উঠোনে দাঁড়িয়ে, ধোঁয়াটে অন্ধকার রাতে একবার প্রথম ছায়াপথ দেখেছিলাম, ধূলারাশির মতো নক্ষত্রপুঞ্জ রংচটা শাড়ির মত মহাকাশে পড়ে ছিল । আপাত দৃষ্টিতে মহাকাশকে স্থির মনে হলেও, পৃথিবী কিংবা তার বাইরে কোথাও কোন নীরবতা নেই । আমাদের মত প্রকৃতির মাঝেও কোন অবসর নেই, মৃত্যু ছাড়া । শরীরে বিনামূল্যে পাওয়া দামি সব যন্ত্রপাতির মত প্রকৃতি ও বিরামহীন হয়ে কাজ করে যাচ্ছে । মৃত্যু ছাড়া তার থামবার উপায় নেই। মানুষের মতো নক্ষত্রের ও মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর অবসর প্রাপ্ত জীবন যেন সারা জীবনের বিরামহীন চলার অবসর !
একটি নক্ষত্র থেকে আর একটি নক্ষত্রের দূরত্ব ঠিক যত আলোক বর্ষ দূর, মনের গতি তার থেকেও হাজার আলোকবর্ষকে হার মানিয়ে যায়। পৃথিবীর বাইরে এই বিশাল সৃষ্টির আয়োজনই বোধ করি, মানুষকে গভীরভাবে মহাকাশকে জানার জন্য আগ্রহী করে তুলেছে। পৃথিবী থেকে চারপাশের মৃত গ্রহগুলো দেখলে মনে হয় কি দারণ পরিকল্পতি ভাবে এই পৃথিবীকে বানানো হয়েছিল । বায়ুমণ্ডলকে মোড়ানো হয়েছে বায়ুর স্তর দিয়ে । সূর্যের আলো ঠিক যতটুকু প্রয়োজন , ততটুকুই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকবে ,আর বাকিটুকু মহাকাশে ফিরে যাবে। অতি বেগুনি রশ্মি যেন কোন ক্ষতি করতে না পারে তাই ওজোন স্তর কে পৃথিবীর চারপাশে ঘিরে দেয়া হয়েছে । কিন্তু আমাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে ,ওজন স্তরকে আমরা নষ্ট করে ফেলেছি । এত কলকারখানা না থাকলে কি আমাদের চলতো না ? নগরায়ন গড়ে তুলে ,আমরা যতখানি লাভবান হয়েছি তার চেয়ে বরং অনেক কিছু হারিয়েছি ।
তথ্য প্রযুক্তি আমাদের জীবনের রঙ বদলে দিয়েছে । এই করোনা কালে প্রতিটি দিন যেন এক একটা নতুন জীবনের উপলব্ধি । প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের চিরকালেই এক দারুণ এবং রহস্যময় যোগাযোগ রয়েছে । মানুষ ,গাছ- পালা , পশুপাখি, নক্ষত্ররাজি সবকিছুই এক অভিকর্ষটার সুতোই বাঁধা ,অথচ আমরা নানা ভাবে এই পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করছি । প্রয়োজনের থেকেও টের বেশি উৎপাদন প্রবণতা, আমাদের একদিন অনেক বড় বিপদের দিকে নিয়ে যাবে হয়ত । সেদিন আমি এই পৃথিবীতে থাকব না । এমন চলতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম হয়ত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর মোকাবেলা করবে । বন্যা , ঝড় আর ভূমিকম্প বাড়বে ,আর তখন প্রিয় সন্তানদের জন্য রেখে যাওয়া বাড়ি-গাড়ি কিংবা ব্যাংকে টাকা হয়ত কোন কাজেই আসবে না ,যদি না সেখানে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয় । তার চেয়ে বরং তাদের জন্য একটা সবুজ অরণ্য রেখে যাই আর তার সাথে মাথার উপর শরতের একটা চকচকে নীল আকাশ ।
আলিফ আলম ,মন্ট্রিয়াল , কানাডা । কথা সাহিত্যিক ।। চিন্তার জাল ( মন কথন ) |||| | আলিফ আলম ।।
সি/এসএস
সর্বশেষ সংবাদ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন