গল্প: ধ্বস্ত মানবিকতা || দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
মনখারাপের বিকেলে আমি ফিরছি দিদির শ্বশুরবাড়ি থেকে। ওর শ্বশুরমশাই খুব অসুস্থ। মাল্টিঅর্গ্যান ফেলিওর ! সাথে বেড সোর। বাঁচবেন না বেশি দিন মনে হলো।দিদির বাড়ির সামনে থেকে ট্রেকার ধরলাম। ট্রেকারের পিছনে বসার জায়গা পেলাম। আমার পাশে মোটাসোটা চেহারার এক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা বসে আছেন। স্বামী স্ত্রী বলেই মনে হলো।কোন একটা বিষয়ে চাপা কথা কাটাকাটি চলছে দুজনের। উল্টোদিকের সিটে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, সঙ্গে একটি অল্প বয়সী মেয়ে বসে। মনে হলো নাতনি ভদ্রলোকের।নাতনির কথাবার্তা শুনে মনে হলো বৃদ্ধ অসুস্থবোধ করছেন। গায়ের জামা কাপড় দেখে মনে হলো কোন অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে ফিরছেন।যা গরম পড়েছে !এই অবস্থায় অনুষ্ঠান বাড়ির খাওয়া দাওয়া মানেই তো শরীর যন্ত্রণা ! মেয়েটির পাশে একটা বাচ্ছা ছেলে বসে। আপনমনে বাইরের চলমান জগৎ দেখছে আর উল্টোদিকে বসা মা বাবাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। ওরা বিরক্ত হচ্ছেন ছেলের প্রশ্নে। ওরা বেশি আগ্রহী নিজেদের মধ্যে ঝগড়াটা চালিয়ে নিয়ে যেতে। মুচকি হেসে বাইরে তাকালাম। ট্রেকারটা খুব দুলছে নৌকার মতো। রাস্তায় বড়ো বড়ো গর্ত বোঝা গেল। জরুরী ভিত্তিতে মেরামত না করলে বড়ো কোন দূর্ঘটনা ঘটে যাবার সম্ভাবনা।
হঠাৎ ট্রেকারের দুলুনিতে বৃদ্ধ বমি করে বসলেন। বমি গিয়ে পড়লো সামনে বসা ভদ্রমহিলার গায়ে। খুব গন্ধ ! দুপুরের খাবার সব উঠে এসেছে বোঝা গেল। বৃদ্ধ ভদ্রলোক অসুস্থ বোধ করছেন খুব। আরো বমি হবে মনে হলো। তাড়াতাড়ি ওনাকে বাইরের দিকে সরিয়ে বসাতে বললাম। মেয়েটির মুখে চোখে অসহায়তা। বৃদ্ধ আরো দুবার বমি করলেন। মনে হলো হালকা হলেন কিছুটা। আমার জলের বোতলটা থেকে ওনার মুখে চোখে ঘাড়ে জল দিলাম। ট্রেকারের হাওয়ায় একটু সুস্থ বোধ করতে লাগলেন বৃদ্ধ।
এবার শুরু হলো ভদ্রমহিলার বিস্ফোরণ। বৃদ্ধকে রীতিমত বাক্যবাণে বিদ্ধস্ত করতে চাইছেন ওনার দামী শাড়িতে বমি করার জন্য। চোখ মুখ থেকে আগুন বেড়োচ্ছে যেন। স্থান কাল পাত্র ভুলে গালিগালাজ করে চলেছেন। সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ওনার স্বামীও। বুঝলাম, এতোক্ষণ চলতে থাকা রাগের স্থানান্তর হচ্ছে। উপস্থিত সকলে বৃদ্ধের অসুস্থতার কথা বললেও থামছেন না ওনারা। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ চলছে বৃদ্ধের উদ্দেশ্যে। এরকম প্রতিক্রিয়ায় বৃদ্ধ আরো যেন অসুস্থ বোধ করছেন। সঙ্গের নাতনিও বাক্যহারা। অসহায় করুণ মুখে সকলের মতো সেও বসে। সকলে বিরক্ত ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার ব্যবহারে। মানবিকতা বলে কিছু থাকবে না? মনে পড়ে গেল বাবার কথাটা। মানুষ সেই যার মান ও হুঁশ দুটোই আছে। বৃদ্ধের জন্য একরাশ খারাপ লাগা তখন আমার বুকের পাঁজরে।
ট্রেকার অবশেষে ষ্টেশনে পৌঁছাল। বৃদ্ধের বাড়ি কাছাকাছি। তাই একটা দোকানের বেঞ্চে ওনাকে বসিয়ে দিলাম। ওনার নাতনি বাড়িতে খবর দিয়েছে। বাড়ির লোক আসছে ওনাকে নিয়ে যেতে। আশ্বস্ত হয়ে ওনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেলাম উল্টোদিকের কলে মুখ হাত ধুতে। ঠান্ডা জলে একটু সতেজ হওয়া গেল। হঠাৎ দেখি পাশে ট্রেকারের সেই যুগল। জল দিয়ে কাপড় ধুতে ধুতে আমাকে উদ্দেশ্য করে ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন :” দেখলেন বুড়ো ভামের কান্ডটা।
লোভী বুড়ো। ঘাটের মড়া। ভালো ভালো খাবে বলে এই গরমেও গেছে অনুষ্ঠান বাড়িতে।হজম করতে পারবে না,বমি করবে লোকের গায়ে'। সঙ্গে আগে শোনা গালাগালের রিপ্লে ! বাচ্ছা ছেলেটা পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে।
ভেতরে যেন আগুন জ্বলে উঠলো।রাগত গলায় বলে উঠলাম
`শাড়ির নোংরা তো জল দিয়ে ধুয়ে নিলেন। কিন্তু এতোক্ষণ যে এই ছোট্ট বাচ্চাটার কানে আপনি শব্দ বমি করে গেলেন তা পরিস্কার করবেন কিভাবে?’ ট্রেন আসার আওয়াজে এগিয়ে গেলাম ট্রেনের দিকে একটা অমানবিক ঘটনার ছায়া বুকে নিয়ে।
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান