দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা
পীযূষ সিকদার ।। আমাদের দুর্গতি যায় না! যাবে কেমনে, আমি তো আমাকে চিনি না! নিজেকে যে জানে সে অতীতচারী হয়েও বর্তমানকে ভালোবেসে সামনের দিকে এগোয়। এগোনোর পথ মসৃণ নয়; অসংখ্য কাঁটা। যে কাঁটা মাড়িয়ে রক্তাক্ত হতে হতে সত্যে পৌঁছায় প্রকৃতি ও সর্বজীব। সে তো হাঁটার মধ্যে নিজেকে চিনে নেয়। এ কর্ম সহজ নয়! যে পারে সেই পারে। ক্ষত-বিক্ষত হয়ে সামনে এগোনোর সঠিক পথ এত সহজ নয়। যেমন সহজ নয় মানুষ হওয়া। ‘মান’ আর ‘হুশ’ যুক্ত হয়ে মানুষ হয়। সেই মানুষ হওয়ার দীক্ষা যে নেয় অথবা একসঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষা যে নেয় পরম গুরুর কাছ থেকে— সে মানুষ হয়। মানুষ হতে হতে সে মনুষ্যত্বে পৌঁছায়। এ কাজ খুবই কঠিন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মনুষ্যত্ব সবার ঘরে জন্মে না’। কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতে ঈশ্বরের সীমাহীন করুণায় মনুষ্যত্ব জন্মে। যাই হোক, বলছিলাম দুর্গতির কথা। দুর্গতিনাশিনীর কথা।
অসুরদের অত্যাচারে দেবতারা যখন কেঁপে উঠে ভয়ে, তখন সব দেবতার তেজরশ্মি থেকে মা দুর্গা আবির্ভূতা হন। দশভুজা হয়ে দেবী দুর্গা অসুরদের বিনাশ ঘটালেন। এই বিনাশকালে রাম-রাবণের যুদ্ধে স্বয়ং ব্রহ্মা রামের পক্ষ নিলেন। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে ব্রহ্মার বোধনে রাম দুর্গা পূজা দিলেন। একে সনাতন ধর্মে দুর্গার অকাল বোধন বলে। চৈত্রের শুক্লপক্ষে পূজা পায় বাসন্তী হয়ে। স্ব-কালে দাঁড়িয়ে দশভুজা হয়ে দেশকে সাজায়। দু’হাত হয়েও তিনি দশরূপা হোন। সে তো ‘মা’ দুর্গাসম। সেই দুর্গার ছায়াসম হয়ে আমরা বারবার বেঁচে উঠি। প্রখর রৌদ্রে হঠাত্ আকাশ অন্ধকার। সে অন্ধকার ঘরকে আলো জ্বেলে দেয়। দুই হাত তখন দশ হাত হতে হতে হাজার হাত ছায়াসম হয়ে—নাচি বাদ্যের তালে তালে; দুর্গার আগমণী বার্তায়।
আমরা মা দুর্গার ছায়া হয়ে বাঁচি। অথবা আমরা বারবার মরে মরে বেঁচে যাই ঈশ্বরের ইচ্ছায়। ‘দ’ অর্থে দৈত্য বিনাশ করে, ‘উ’-কার অর্থে বিঘ্ন নাশ করে, ‘রেফ’ অর্থে রোগ নাশ করে, ‘গ’-অর্থটি পাপ নাশ করে এবং ‘আ’-কার অর্থে— শত্রু নাশ করে। মা ‘দুর্গা’ নামের অর্থ এমন দাঁড়ায় যে— দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই মা দুর্গা। সকল দেবতা মিলে মিলিত রশ্মি বা মিলিত শক্তিই দেবী দুর্গা।
মহালয়ার দিন পিতৃপক্ষ অবসান হয়। মাতৃপক্ষের সূচনালগ্নে সত্য হয়ে ‘পদ্ম’ ফোটে। ঠিক এ সময়ে আক্ষরিক অর্থে দুর্গা পূজা চর্চিত হয়ে আসছে আমাদের মনের গহীন অতলে। জ্ঞানমত্ কথ্যমতে, মহালয়ার দিন অসুর ও দেবতাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। দেবী দুর্গা মা-সম হয়ে মহিষাসুর বধ করেছিলেন। এ লড়াই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। লড়াইটা চলতে থাকে শুভ ও অশুভ হয়ে।
আজ সুর তাল ছন্দে কথা ও বাণীর দ্যোতনা রূপে মহালয়া। ১১ অক্টোবর বোধন শেষে ষষ্ঠী। একটু থেমে বলে নিচ্ছি, এই পূজাকে শারদোত্সব, দুর্গোত্সব বা দেবী পক্ষও বলে। আশ্বিন মাসের শুক্লা পক্ষের অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাদ্র কৃষ্ণ নবমীতে পূজিত হয় দেবী দুর্গা। দেবী দুর্গা পূজিত হতে হতে উত্সব হয়ে উঠে। চারদিকে শরতের সাদা কাশফুল জেগে ওঠে। দুর্গা আসে তাঁর পুরো পরিবার নিয়ে বাপের বাড়ি। পৌরাণিক কাহিনিতে অনুমতে অথবা বিশ্বাসমতে, দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন মহাঅষ্টমীতে।
দেবী দুর্গার ১০ হাতে দশভুজা হয়। দুর্গাসম দুর্গার দশ হাত ৩৩ কোটি দেবতার সমান হয়। বাঁধে যুদ্ধ সুরে আর অসুরে। শুভ আর অশুভ দ্বন্দ্ব বাঁধে। দেবী দুর্গার ১০ হাতে দশটি অস্ত্র শোভা পায়। অস্ত্র মাহাত্ম্য ও নাম— ১. মহাদেব দিলেন ত্রিশূল, তমঃ রজঃ এবং সত্য; ২. বরুণদেব শঙ্খ; ৩. বিষ্ণুদেব সুদর্শন চক্র; ৪. দেবরাজ ইন্দ্র মহামায়াসম’র হাতে তুলে দেন ‘বজ্র’; ৫. সংহতির অশনি দৃঢ়তাসহ ব্রহ্মা দিলেন পদ্ম; ৬. যমরাজ প্রদান করেন গদা। এটি ভক্তি ও আনুগত্যেরও প্রতীক (অনুমেয়ো খড়গ বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞার প্রতীক); ৭. অগ্নিদেব দিলেন অগ্নিবিদ্যা যা জ্ঞানের প্রতীক; ৮. পবনদেব দিলেন তীর ও ধনুক। উভয়ই ইতিবাচক শক্তির প্রতীক। ৯. দেবী দুর্গার প্রধানতম বাহন সিংহ। ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত দিলেন দেবীর হাতে ঘণ্টা। ১০. সাপ বা সর্প। দেবী দুর্গাকে শেষ নাগ প্রদান করেছিলেন নাগরাজ।
বোধন, পূজন ও বিসর্জনের অসামান্য মানবিকী মিলন ক্ষেত্র। সত্য বচন এই যে, শিল্পজ্ঞান ও প্রকৃতিপ্রেম সনাতন ধর্মের সারকথা। দেবী দুর্গা আসছেন ঘোটকে চড়ে দীপ্ত তেজে, চলে যাবেন দোলায়…। যাওয়া-আসার মাঝখানে ছায়াসম যে সনাতন ধর্মের প্রাণ ফিরিয়ে দেন; প্রাণে প্রাণে মিলনের উত্সবে। আমরা নেচে উঠি শরতের আকাশ হয়ে বাদ্যের তালে তালে। আমাদের দুর্গতি নাশ হয়। দুর্গাসম মনন থেকে মননে। শুভম।
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান