পূর্ব প্রকাশেরপর…
মুখোশ || নাজনীন নিশা । শেষ পর্ব
আমার ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষ শেষের আগে আমার সেই চাচাচাচী মানে শৈলীর বাবা মা আরো একদিন আসলেন আমাদের বাসায়। ফোনে বাবার সঙ্গে তাদের কথা হয়েছিল কিনা আমি জানিনা। তবে বাসায় দেখলাম খুব ভালো রান্নার আয়োজন চলছে যার সমস্তটাই জোৎস্না খালা করলেন । আজ শৈলী আসেনি । আমি চাচাচাচিকে সালাম করে নিজের রুমে চলে গেলাম । কিছু সময় পরে বাবা ডাকলেন খাবার টেবিলে। স্নান সেরে টেবিলে আসতে কিছুটা দেরি হয়ে গেলো আমার । এসে দেখি সবাই আমার অপেক্ষাতেই টেবিলে বসে। জোৎস্না খালার হাতের রান্না আসলেই অনেক মজাদার । খাবার খেতে খেতে সবাই তার রান্নার প্রশংসা করতে লাগলেন। কিন্তু আমার মনটা একটু খচখচ করছিলো শৈলী আজ আসেনি বলে। আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছিলামনা। খাবারের মাঝখানে বাবা হঠাৎ চাচাকে বললেন শৈলীকে নিয়ে আসলে ভালো করতে। তারপর বুয়াকে বললেন শৈলীর জন্য খাবার প্যাক করে দিতে যাবার সময়। চাচা বাবার কথা শেষ হওয়া মাত্রই বলে উঠলেন, ভাইজান একটা নতুন খবর দেব বলে আজ আমরা এসেছি “শৈলীতো আগামী শুক্রবার মানে আর দুদিন পরে চলে যাচ্ছে আমেরিকায় ওর বোনের কাছে।” শৈলী চাইছিলো আমরা আপনার বাসায় এসে আপনাদের খবরটা দেই তাই ফোনে শুধু আসবো বলেছি , কারণটা বলিনি। শৈলী ফোনে কথা বলে দোয়া চেয়ে নেবে ভাইজান আপনার কাছ থেকে, এবং না আসতে পারার জন্য মাফও চেয়ে নেবে বললো।
তাদের কথাগুলো আমি আমার খাবার খাওয়া বন্ধ রেখে শুধু শুনেই যাচ্ছিলাম। আমার কথাগুলো শুনতে কেন যেন ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। আমি ঠিক নিতে পারছিলাম না। এই প্রথমবারের মত মনে হলো আমি শৈলীকে বারবার ফিরিয়ে দিয়ে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। এখনই দৌড়ে গিয়ে শৈলীর পায়ে ধরে খুব মাফ চাইতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে শৈলীকে বলতে যেন আমাকে ছেড়ে শৈলী কোথাও না যায়। খাবার শেষ হবার কিছু পরে চাচাচাচী বিদায় নিলেন কিছুটা কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে।
শৈলী বাবার কাছ থেকে ফোন করে বিদায় নেবে আমি সে ফোনের অপেক্ষায় থাকলাম। সময় যেন কিছুতেই আর কাটতে চাইছেনা।
পরদিন সন্ধ্যায় ফোন বাজতেই আমি তড়িৎগতিতে ফোন তুললাম। ওপাশ থেকে শৈলী আমাকে কেমন আছি জানতে চেয়েই বাবাকে চাইলো, আমি শৈলীর সঙ্গে আরো কথা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু বাবা পেছনে দাঁড়িয়ে, বাবাকে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে আমি রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। যেতে যেতে ভাবলাম শৈলীর সঙ্গে কিভাবে কথা বলা যায়। আমি আবারো ঘুরে এলাম ফোনের কাছে কিন্তু ততক্ষনে বাবা কথা শেষ করে ফোনটা নামিয়ে রেখেছেন।
সারারাত নির্ঘুমে এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম , এরুম থেকে বাবার কাতর ঘুমের ভেতরে নাক গোঙানির শব্দ পাচ্ছি ! আমার শুধু মনে হতে লাগলো আর একদিন পর শৈলী চলে যাচ্ছে, শৈলীকে আমার কিছু একটা বলা দরকার। ভাবতে ভাবতেই ফোন বেজে উঠলো। এ ঘর থেকে বেরিয়ে ফোনের ঘরে গিয়ে ফোনটা তুলেই বললাম “শৈলী তোমার না গেলে হয়না ?” কিন্তু অন্যপাশ থেকে ফোনে সেদিনের সেই অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠ জবাবে বললো “আমি শৈলী না বাবা, তবে তোমার সঙ্গে দেখা করাটা খুব জরুরি। আমি দেখা করতে চাই। কোথায় আসবো বলো। তোমার বাবাকে তুমি কিছুই বলতে পারবেনা এ বিষয়ে।” শৈলীর ফোন না হওয়াতে আমার মনটা বেজায় খারাপ হলো। তবুও বললাম আপনি নম্বর দিন আমি পরে যোগাযোগ করে জানাচ্ছি। মানুষটি তার কোন নম্বর আমাকে দিতে পারলোনা, তবে বললো সে আমাকে আবার কল দিবে। কিন্তু সে আর কল দেয়নি। আমি তার কল এর অপেক্ষায় থেকেছি অনেক, আমি শৈলীর ফোনের অপেক্ষাতেও থেকেছি অনেক। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মনে হয়েছে অপেক্ষা নামক এ শব্দটি অনেক ছোট, পাশাপাশি এটি অনেক বেশি নিরানন্দ।
শৈলী চলে যাবার পর অনেক চড়াই উৎরাই পার করে আমি শৈলীর ফোন নম্বর জোগাড় করে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। রাগ ভাঙানোর জন্য বেশ কয়েকবারই ওকে ফোন দিয়েছি। কিন্তু কখনো শৈলী ফোন ধরছেনা, আবার কখনো ফোন ধরছেতো কথা বলছেনা। কিছুটা অসহায়বোধ হতে লাগলো, কিন্তু হাল ছাড়িনি কারণ আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিলো ও ফোন ঠিকই ধরবে এবং আমার সাথে কথাও বলবে। অবশেষে সেটাই সত্যি হলো। শৈলীর মান ভাঙলো এবং শৈলীও কিছুদিন পর পর আমাকে ফোন দিতে শুরু করলো। এভাবে ফোনে ফোনেই আমাদের সম্পর্কটা অনেকটা গভীরে চলে যায়।
টানা তিন বছর পর শৈলী দেশে ফিরে এলে সবার মতামত নিয়ে আমি শৈলীকে বিয়ে করি। ভালোবাসা মান-অভিমান সবকিছু মিলিয়ে শৈলীর সঙ্গে আমার সংসারটাও বেশ গোছালো এবং সুখের। সংসারে আমি বাবা আর শৈলী শুধু এই তিনজন মানুষই এখন পর্যন্ত আছি। জোৎসনা খালা এখন আর আমাদের সঙ্গে নেই। তিনি তার মেয়ে এবং তার বরের সঙ্গে গিয়ে থাকছেন। কিছুদিন ধরে শৈলী একটানা অসুস্থ। অসুস্থতার কারণে চাচী মানে আমার শাশুড়ি এসে কয়েকদিন থাকলেন শৈলীকে দেখাশোনা করার জন্য। আমি অফিস থেকে ফিরে যতটুকুন সময় পাচ্ছি সে সময়টাতে ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। জানতে পারলাম শৈলী অন্তঃসত্ত্বা। দু বাড়িতে খুশির বন্যা বইছে এ খবরে। শৈলী ওর বাবা মায়ের বাড়িতেই সময় বেশি কাটাচ্ছে। আমি অফিস থেকে প্রতিদিন যাচ্ছি শৈলীকে দেখতে। এদিকে বাবাও কিছুটা অসুস্থ, বয়সের ভারে আগের মত চলতে পারছেন না এখন আর।
বাবাকে দেখার জন্য এবং রান্নার কাজে এখন যে সাহায্য করছে তার নাম রেবা। রেবাও খুব মনোযোগ দিয়ে সব কাজ করে ।
একদিন সন্ধ্যা সাত টায় অফিসের কাজ শেষ হতেই পিওন এসে বললো” স্যার কেউ একজন অনেক্ষন ধরে অপেক্ষায় আছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। আমি পিয়নকে বললাম লোকটিকে ভেতরে আসতে দিতে। কিছুক্ষন পরেই দেখলাম দাঁড়িগোঁফ সমেত একটি লোক আমার অফিস রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে। আমি তাকে চেয়ার দেখিয়ে ইশারায় বসতে বললাম। লোকটি বসলোনা, আমার কাছে এগিয়ে এসে ঠিকানা সমেত একটা কাগজ দিয়ে বললো ” আপনার সঙ্গে দুলাভাই দেখা করতে চান, তিনি এখন হাসপাতালে আছেন, অনেক অসুস্থ। আসতে চাইছিলো কিন্তু পারেনাই, যেকোনো সময় মইরা যাইবো, এই বলেই সে কাগজটা টেবিলে রেখে চলে গেলো। আমি কাগজের টুকরোটি হাতে নিয়ে দেখলাম কারো নাম, রুম নম্বরসহ হাসপাতালের একটি ঠিকানা লেখা আছে ওতে। কিন্তু সেটা পড়ে কোন কারণ বোঝা গেলোনা। কে এই লোক ? কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় ? বিষয়টা ভীষণ রহস্যময়ী একটি বিষয় মনে হতে থাকে আমার কাছে। বাসায় এসে এ বিষয় নিয়ে কারো সঙ্গে কোন কথা বলিনি আমি। তবে কয়েক বছর আগে অচেনা একটি লোক আমাকে ফোন করে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলো, সেই লোকটির সঙ্গে আমি নিজের অজান্তেই এই ঠিকানা পাবার ঘটনাকে মিলিয়ে ফেললাম। যদিও সেই ফোনের বিষয়টা আমি মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজকের এই ঠিকানার বিষয়টা আমাকে সত্যিই চিন্তিত করে তুললো।
ওদিকে শৈলীকে নিয়েও খুব চিন্তা হচ্ছে। কারণ ও খুব বেশি মাত্রায় অসুস্থ। বাচ্চাটা সুস্থ আছে কিনা শৈলীর পেটে সেটাও আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। সবকিছু নিয়ে খুব ব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছি।
জীবনের এসব ব্যস্ততা আসলে আমাদের জীবনেরই অংশ। মৃত্যু না হলে এর থেকে পরিত্রান নেই । কিন্তু এই ব্যস্ততার সময়গুলো খুব আনন্দেরও হয় মাঝে মাঝে। শৈলীর পেটে আমার বাচ্চা। সেটা নিয়ে আমার ব্যস্ত সময়টাকে আমি খুব বেশি উপভোগ করে যাচ্ছি। একদম সময় পাচ্ছিনা সেই লোকটির সঙ্গে দেখা করার মত সময় বের করার। তবুও সময় আমাকে বের করে নিতে হলো একদিন অফিস থেকে কয়েক ঘন্টা আগে বেরিয়ে। পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে একবার দেখে নিলাম ঠিকানা লেখা কাগজটা মানিব্যাগে ঠিকমত রাখা আছে কিনা। হাসপাতালটা খুব একটা কাছে বলে মনে হলনা। শহরের আশেপাশের কোন গ্রাম্য হাসপাতাল হবে।
গাড়ি টান দিয়ে ছুটলাম ঢাকা শহরের প্রতিদিনের ট্রাফিক জ্যামের সাথে পাল্লা দিয়ে। গাড়ির ভেতরের ঠান্ডা বাতাসের কারনে বাইরের প্রকট রোদের তাপমাত্রার কিছুই টের পাচ্ছিনা আমি আমার শরীরে। তবে জানালার কাঁচ ভেদ করে দেখতে পাচ্ছি রিক্সা চালকের কপালের ঘাম, কখনোবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর প্রচন্ড তাপদাহে চোখ কুঁচকানো মুখ, ফুলবিক্রেতাদের ছোটাছুটি, এরকম আরো অনেক অনেক পরিচিত জগৎ যা এদেশে থেকে রাস্তায় নামলে প্রতিদিন দেখে যেতে হয়। শৈলী খুব গোলাপ ভালোবাসে। সেকথা মনে হতেই জানালার কাঁচ নামিয়ে ছোট্ট একটি কিশোরীর কাছ থেকে গোটা বিশে’ক গোলাপ ফুল কিনে বাচ্চা মেয়েটির হাতে কিছু টাকা দিয়ে আবারো গাড়ি টান দিয়ে ছুটতে শুরু করলাম সেই হাসপাতালের উদ্যেশ্যে। একটা সময় গাড়ি এসে থামলো শহরের কিনারের একটি অতি পুরোনো কোন এক হাসপাতালের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে পায়ের পাতাগুলো যেন ভীষণ অবস হয়ে এলো। একেবারেই আর চলতে চাইছেনা। অনেক কষ্টে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে গেলাম। ভেতরে ঢুকতেই প্রথম রুমটিতে একটি ছোট্ট টেবিল দেখতে পেলাম যার উল্টো পাশে বসা মধ্যেবয়সী একজন মানুষ। হাতের কাগজটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরতেই তিনি তার চশমাটা চোখের নিচে নামিয়ে পলক না ফেলেই আমাকে খুব ভালো করে দেখে নিলেন। সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বসতে বললেন। আমি না বসেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার নাম ঠিকানা সব জিজ্ঞেস করলেন। তারপর কোন একজনকে ডেকে তার হাতে কাগজটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন আমাকে কাগজে লেখা হাসপাতালের সেই রুম নম্বরের দিকে নিয়ে যেতে। আমি লোকটির পেছন পেছন যেতে শুরু করলাম। আয়তনে বেশ ছোট মাপের হাসপাতালটির এই মাথা থেকে ওই মাথা অব্দি এক নিমিষেই দেখা যাচ্ছে। লোকটি একতলার সিঁড়িগুলো ভেঙে দোতলায় উঠার পর বাঁ দিকে একটু মোড় নিয়েই হাত দিয়ে নিচে মেঝেতে শুয়ে থাকা অনেকগুলো মানুষের মাঝখান থেকে একজনের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বললো এই বেড এ যিনি আছেন তার নামই এইটা স্যার। আমি এক নজর চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম গোটা বিশেক রোগী একটি লম্বা আকৃতির রুমের ভেতরে এদিক সেদিক এলোপাথাড়িভাবে শুয়ে আছে। তবে সবার নিজ নিজ বিছানা রয়েছে। যে লোকটি আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাকে এখানে ডেকে এনেছে তার দিকে তাকিয়ে মনে হলো লোকটি জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় শুয়ে আছে। আমি লোকটির কাছে গিয়ে আমার নাম বললাম এবং ভনিতা না করে তার কাছে সরাসরি জানতে চাইলাম কেন সে আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় ? লোকটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো । পাশে বসে থাকা মাথায় ঘোমটা টানা মাঝবয়সী মহিলাটি লোকটিকে বিছানার উপরেই বসতে সাহায্য করলো। লোকটি কাশতে লাগলো বুকে হাত দিয়ে। একসময় কাশি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো আমি কেমন আছি ? আমাকে সে তার পাশে বিছানায় বসতে বললো, যদিও সেখানে বসার মত কোন অবস্থাই ছিলোনা আমি তাই দাঁড়িয়েই ছিলাম। লোকটি কিছুক্ষন পর পরই কাশছে। আমাকে সে আবারো বসতে বললো এবং আরো বললো কথাগুলো শোনা আমার জন্য অনেক জরুরি। আমি যেন তার পাশে একটু বসি। লোকটির কথা আমি আর ফেলতে পারিনি। পাশেই একটু জায়গা করে কোনরকম বিছানায় বসলাম। লোকটি আমার হাত ধরে কিছুক্ষন কাঁদলো। কাঁদতে কাঁদতেই বললো তার একটি মেয়ে ছিল, আমার চেয়ে বয়সে একটু বড়। কিছুদিন হয় তার মেয়েটি একটি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় এই গ্রামেই। বলেই আবার সে কেঁদে ওঠে । লোকটির সঙ্গে সঙ্গে তার পাশে বসে থাকা মহিলাটিও কাঁদছে। ওদের কান্না দেখে আমি কিছুটা ইতঃস্তত বোধ করতে লাগলাম। ওদের কান্না থামাতে বললাম। সাথে আরো বললাম আমার পক্ষে এখানে বেশিক্ষন থাকা সম্ভব নয়। তিনি যেন আমাকে কেন ডেকেছেন সেটা খুলে বলেন। লোকটি এবারে কান্না থামিয়ে আমাকে বলতে শুরু করলো “সে অনেক বছর আগে আমার বাবার গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতো, তার নাম শমসের আলী। আমার মায়ের সঙ্গে আমার বাবার বিয়ের কয়েক বছর আগেই সে বাবার গাড়ি ড্রাইভিং এর কাজটি নেয়। আমার মায়ের বাড়িতে একজন পালিত কন্যা ছিল যাকে ওই বাড়ির সবাই খুব আদর করতো। পালিত কন্যাটি আমার মা’কে মা বলেই ডাকতো। এটা নিয়ে সে মুহূর্তে আমার বাবার কিংবা আমার বাবার বাড়ির কারোই কোন অভিযোগ ছিলোনা। আর এ বাচ্চা মেয়েটির বাবা ছিলেন আমার মায়ের বন্ধু। তারা একসাথে পড়াশোনা করেছিলেন। বচ্চাটি জন্ম দেবার কিছুদিন পর তার সেই বন্ধুর স্ত্রী পরলোক গমন করেন। এ অবস্থায় তাদের বাচ্চাটিকে দেখার মতন কেউ ছিলোনা ওদের দুই পরিবারের এক পরিবারেও, তখন মা বন্ধুর প্রতি দায়িত্ত পালনে বাচ্চাটিকে নিয়ে আসেন এবং বাচ্চাটি আমার নানা নানুর বাড়িতেই সবার আদরে একটু একটু করে বড় হতে থাকে। নাম তার পৃথা, পৃথার বাবা বছরে দু একবার এসে মেয়েকে দেখে আবার চলে যান। এসব কিছু জেনেই আমার বাবা নাকি তাদের পরিবারের মতামত নিয়ে আমার মাকে বিয়ে করেন। মা পৃথাকে সঙ্গে নিয়েই আসেন আমার বাবার বাড়িতে। এক বছরের মাথায় আমি আমার মায়ের কোল জুড়ে আসি এ সংসারে। আমার মা আমাকে এবং পৃথাকে সমানভাবে আদরযত্ন করতে থাকেন। কমবেশি বলে কিছু নেই আমার মায়ের সেই ভালোবাসা এবং যত্নআত্তিতে। পৃথার সাথে সাথে আমিও একটু একটু করে বড় হতে লাগলাম। কিন্তু এদিকে আমার বাবার সাথে প্রায়শই আমার মায়ের বাকবিতন্ডা শুরু হয়ে যায় পৃথাকে নিয়ে। বাবা পৃথাকে ফিরিয়ে দিতে বলেন কিন্তু আমার মা কিছুতেই সেটা মানতে পারেননা। এমনকি পৃথার বাবা মেয়েকে দেখতে এলে আমার বাবা সে বিষয়টা নিয়ে মায়ের প্রতি কটাক্ষ আর অশ্লীল ভাষা ছুড়তে থাকেন। আমার মা দিনের পর দিন ভীষণ অসহায় এক জীবন যাপন করে যাচ্ছিলো এ বিষয়টা নিয়ে। ড্রাইভার শমসের আলীরও একটি মেয়ে ছিল যার দুটো কিডনিই হটাৎ করে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো । তাকে বাঁচানো সম্ভব নয় যদি না একটা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা যায়। শমসের আলী মেয়েকে নিয়ে খুব দুর্ভাবনায় থাকেন আর একা একাই কাঁদেন। নিজের মেয়ের কথা ভেবে পৃথার প্রতি তারও স্নেহসুলভ একটা মনোভাব কাজ করতো। একদিন সন্ধ্যে বেলায় বাবা বাসায় ফিরে দেখলেন পৃথার বাবা এসেছে কিছু খাবার এবং সঙ্গে আমার আর পৃথার জন্য নতুন কাপড় নিয়ে, আমার মা’কেও তিনি বাদ দেননি। তাঁর জন্যও একটি শাড়ী কিনে এনেছিলেন । কারণ তাঁর মেয়েকে যে মানুষটি এত নির্ভেজাল ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুলছে তাকে সে একটি সামান্য শাড়ী দিতেই পারেন এই ভেবে। এ নিয়ে সারারাত বাবার সঙ্গে মায়ের কথাকাটাটি চলতেই থাকে।
রাত তখন তিনটে হতে পারে। বাড়িশুদ্ধ মানুষ ঘুমে অচেতন। হটাৎ বাবার ফিসফিসানি শব্দ শমসের আলীর কানের পাশে। তিনি শমসের আলী বলে ডেকে চলছেন তার গায়ে ধাক্কা মেরে মেরে। তারপর তাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে উপরে নিয়ে গেলেন । অন্ধকারে বাবার পেছন পেছন শমসের আলীও ঘরের ভেতরে ঢুকলো। বাবা বাতিটা জ্বালিয়ে দিলেন। সামনের দৃশ্য আর শমসের আলী সহ্য করতে পারছিলোনা । হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছিলো তার। বাবা জোরে এক ধাক্কা দিতেই শমসের আলী আবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ঘরের এখানে ওখানে কাঁচা রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে এবং সেইসাথে মেঝেতে পড়ে থাকা আমার মায়ের লাশ যার মুখের একটা পাশ থেতলে আছে এবং মাথার একটা পাশও ফেটে রক্তের বন্যা বইছে। রক্ত মাখা কাঁচের টুকরো গুলো সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শমসের আলী চিৎকার করতে যেয়েও পারেনি কারণ বাবা তার মুখ চেপে ধরেছিলেন। এবং বলেছিলেন শমসের আলীর মেয়ের কিডনি কিনতে যত টাকা লাগবে তার পুরোটাই তিনি দিবেন যদি আজ রাতের ঘটনা শমসের আলী মুখ বন্ধ করে রাখে চিরজীবন এবং এ মুহূর্তে তাকে সাহায্য করে। সেদিন বাবার প্রস্তাবে সে সাথে সাথেই রাজি হয়ে যায় তার মেয়েকে ফিরে পাবার লোভে। তার মনে হল সে যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়েছে ।
রাত ৪’টা নাগাদ ঘরের ভেতর থেকে লাশ বস্তায় পেঁচিয়ে শমসের আলী আর আমার বাবা গাড়ির পেছনের ডিকিতে লাশ তুলে রওনা হলো আলো এবং অন্ধকার মিশ্রিত জনহীন পথ ধরে। রাস্তার কোথাও কোথাও শুধু দু একটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করা গোঙানির শব্দে তাদের কান্না নিংড়ে যাচ্ছে। গাড়ি চলতে চলতে একটা সময় কোনো একটি ব্রিজের উপরে এসে থামলো বাবার নির্দেশে। চারিদিক তাকিয়ে কোনো কথা না বলে গাড়ি থেকে দুজন ধরাধরি করে লাশের বস্তাটিকে ব্রিজের উপর এনে ছুঁড়ে ফেলে দিলো নিচে। পানির কঠিন শব্দের সাথে আমার মায়ের লাশটি পানির অতলে তলিয়ে যেতে যেতেই দুজন গাড়িতে উঠে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখান থেকে গাড়ি টান দিয়ে পালিয়ে গেলো এক নিমেষে।
পরের দিন বাবা শমসের আলীকে দিয়ে পাড়াপ্রতিবেশীদের দুএকজনের কাছে বলতে বললেন আমার মা কারো হাত ধরে চলে গিয়েছেন কাউকে কিছু না বলে। পৃথাকে আমার নানার বাড়িতে রেখে আসা হলো। এবং বাবা তার পুরোনো জায়গা ছেড়ে নতুন বাড়ি কিনে চলে আসলেন এ বাড়িতে। আত্মীয়স্বজনকে জানানো হল মায়ের সঙ্গে বাবার ডিভোর্স হয়ে গেছে। গোটা একমাস পর নিখোঁজি মামলায় পুলিশ লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও কোনো এক অজানা কারণে পুলিশ সে মামলা নিয়ে বেশিদূর এগোয়নি। ওখানেই তা থেমেছিল ।
শমসের আলী আরো বললো তার মেয়ের কিডনি কেনার টাকাও বাবা দিয়েছিলেন এবং মেয়ে তার কিডনি নিয়ে অনেক বছর বেঁচে ছিল কিন্তু তার বিয়ের পর সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে সে মারা যায়। তাকে আর কেউ বাঁচাতে পারেনি। এদিকে শমসের আলী অসুস্থ হয়ে আজ কয়েক বছর ধরে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তার মনের ভেতরে এই পাপের বোঝা সারাক্ষন খচখচ করতে থাকে। কোন কিছুতে সে শান্তি পায়না ! তাই সিদ্ধান্ত নিলো আমাকে তার সবকিছু বলতেই হবে এ পাপের বোঝা কমানোর জন্য । অনেকবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে যেয়েও সে পারেনি। সে সুযোগ মেলেনি। শমসের আলী এটাসেটা আরো বলে যাচ্ছিলেন কিন্তু আমি আর এক বিন্দুও ওখানে থাকতে পারিনি। গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা চলে এলাম বাড়িতে।
বাড়ির সবকিছু ঠিকঠাক সেই আগের মতই আছে। কিছুই যেন পাল্টায়নি। শুধু পাল্টে গেছে মন। কি অদ্ভুত এ মন ! আমার আদর্শ আমাকে তার কাছ থেকে সামান্যতম বিচ্যুত হতে শেখায়নি। নির্বিচারে মায়ের নৃশংস খুন আমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিনা। তাই থানায় গিয়ে শমসের আলীর কথাগুলো সেখানে জমা দিয়ে এলাম। নিষ্ঠুর সময়ের কাছে কখনো কখনো জীবনকে হার মানতেই হয়।
কয়েকটাদিন পুরো বাড়ির গন্ডির ভেতরে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছি ! মাঝে মাঝে ছাদে উঠে আকাশ দেখি ! খোলা আকাশটাকে বড়বেশি নিঃস্বঙ্গ মনে হয় ঠিক আমারি মতন !
আমার আদর্শ বাবা এখন আমার মা’কে খুনের দায়ে জেল খানার চার দেয়ালের মাঝে বসে একটা একটা করে মৃত্যুর প্রহর গুনে যাচ্ছেন।
আর ওদিকে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আমার স্ত্রী শৈলী নতুন একজন মানুষ এ পৃথিবীতে ভুমিষ্ট হবার প্রহর গুনে যাচ্ছে।
বাবাকে জেলে দিয়ে আজ আমি নিজে বাবা হতে চলেছি ! বাবার হাত ধরে শৈশব, কৈশোর, যৌবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আজ আমিও হবো বাবারই মতন আরেকজন বাবা। মায়ের অভাবটা ভীষণ অনুভব করি। কষ্ট আর আনন্দে চোখ ছল ছল করছে আমার! জীবনের কোন কোন অপ্রাপ্তির জায়গাটা চিরকাল হয়তোবা এভাবেই শূন্য পড়ে থাকে। হাজারো প্রাপ্তিতেও এ শূন্যতা বিলীন হয়ে যায়না !!