রিনা আর তার মেডিটেশন |||| আলীফ আলম
প্রতি বিকেলে একবার হলেও কাঠকুড়ুনির মত কুঁজো হয়ে উঠোনের মরা পাতা কুঁড়ায় রিনা । এ তার প্রতিদিনকার কাজ । বাড়ির সামনে এক বিরাট উঠোন আর তার পেছন দিকেই রিনার ঘর । দেয়াল বিহীন এক ফাঁকা জায়গা দিয়ে তার বাড়ি যেতে হয় । ঝকমকে উঠোন পেরুলেই চোখে পড়ে উঠোনের দু’পাশে দুটো বিশাল আম গাছ । প্রতিদিন ভোরে উঠে সে গতরাতের শুকনো ঝরা পাতা ঝাড়ু দেয় আর তার কিছুক্ষণ বাদে আবারও গাছের নিচে পাতা এসে ভরে যায় তবুও এ কাজ করে সে ক্লান্ত হয় না ।
ঝকঝকে বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকতেই রিনাকে চোখে পড়ে । বিছানায় টান টান চাদরের উপর শান্ত চোখে শোয়া রিনা, সারাদিনের কাজ শেষে বিছানায় একটু গা এলিয়েছে । মুখে তেমন হাসি থাকে না , দাঁত পড়া , তোবড়ানো মুখের ছোটখাটো একজন মানুষ । স্বামী মারা যাবার পর ছোট ছোট ছয়-সাত বাচ্চা নিয়ে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া মানুষ । তার চোখে মুখে একটা জিনিস স্পষ্ট আর তা হল আত্মবিশ্বাস । অনেকে ভুল করে তাকে অহংকারী বলে । অহংকার যে তার একেবারেই নেই তা কিন্তু নয় , হাজারো সমস্যায় কিংবা অভাবে কারো কাছে হাত না পাতা , এক ধরণের অহংকার বটে । আর এই অহংকারই তাকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছে ।
তার বিয়ে হয়েছিল যখন তার বয়স পনের কি ষোল। স্বামী তার বড় সাংসারিক । যে সময় মানুষ দালান বাড়ির কথা ভাবতেই সাহস পেত না, সেই সময় তার দালান বাড়ি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে । বাজারে দোকান , দালান বাড়ির সামনে গ্রামীণ-গৃহস্থদের মত একটা আধা-পাকা ঘর। তার স্বামী কি তবে তার জীবনের শেষ ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছিল? নাকি জীবন তাকে অনেক বেশি লোভাতুর করে তুলেছিল? রিনা তার উত্তর জানে না। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই তার কাজ শুরু হয়। এতো গুলো বাচ্চা আর তেমন ধন সম্পদ না থাকা একজন বিধবার হয়ত এ অবস্থায় ভীষণভাবে বিষণ্ণতায় ডুবে যাবার কথা, কিন্তু তার বেলায় এমন কিছুই হয় নি। দারুণ মনোবল মানুষটার!
দিন রাত রিনা কাজে ডুবে থাকে। কোন রকম কাজ সারা তার স্বভাবে নেই। তার দালান বাড়ির সাথে লাগোয়া এক চালা রান্নাঘর দেখতে বেশ বেমানান মনে হলেও প্রতিদিন সে তা পরিষ্কার করে ঝকঝকে করে রাখে, কোথাও ময়লা জমতে দেয় না। মাটির মেঝে বলে মাঝে মাঝে তাতে পোকা- মাকড়ের বসত বাড়ি আর ছিদ্র দেখা দেয়। বয়সের ভারে কিছুটা কুঁজো হলেও প্রায়েই সাদা রঙের এক ফেলনা বালতিতে মাটি আর পানি নিয়ে সময় করে সে মেঝে লেপে দেয়।
স্বামীর রেখে যাওয়া দালান বাড়ির ভেতর সবে মাত্র দুটো ঘর। আসবাব বলতে দুটো খাট, একটা টেবিল আর একটা আলনা ছাড়া তার তেমন কিছুই নেই। তবুও সামনের বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকতেই ঘর-দুয়ার হেসে উঠে। প্রয়োজনীয় কিংবা সামান্য সব জিনিস সে খুব যত্ন করে গুছিয়ে রাখে। পরিপাটি বিছানা, আলনায় খুব সুন্দর করে ভাঁজ করা কাপড় আর নোনা ধরা দেয়ালে লোহায় ঝুলানো ধান ক্ষেতে কৃষকের হাসিমাখা ছবির ক্যালেন্ডার। প্রতিদিন দুই তিন বেলা মেঝে ঝাড়ু দেয় বলে ঝকমক করে চারপাশ। কোথাও ধুলো-বালির ছিটে ফোঁটা নেই। ঘরের প্রতিটি জিনিস তার মনের গভীর যত্নে লালিত।
কিন্তু কোথা থেকে পায় সে এই শক্তি? অনেকের মতো তার তো হতাশায় ডুবে থাকার কথা ছিল! কিন্তু দারুন তার মনের জোর! ভাগ্যের প্রতি তার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। বাইরের মানুষজনের সাথে তার তেমন উঠা বসা হয় না। খুব কাছের মানুষ ছাড়া তেমন কেউ তার বাড়ি আসে না। মাঝে মাঝে কারো কারো সাথে তার গোলমাল বাঁধে, ঠোকাঠুকি হয়, তাতে সে তেমন গা করে না, সব ভুলে গিয়ে আবারও কাজে মন দেয়। কার কি আছে বা নেই তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই, তার যা আছে তা নিয়েই সে খুশী। ঠোঁটে তার তেমন হাসি লেগে না থাকলেও, চোখে-মুখে একটা তেজী ভাব সবসময়য় লেগেই থাকে।
বয়স এখন আশির কোঠা ছুঁয়ে পেরিয়ে গেছে। শারীরিক সমস্যা বলতে কেবল চোখে ছানি। এখন ও জীবন তাকে ভয়ংকর ভাবে চেপে ধরে। একে তো স্বামীহীন জীবন তার উপর ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে জীবন সমুদ্র পাড়ি দেয়া তার জন্য খুব সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু এই অসাধ্যকে সে কি করে জয় করল? জীবনের এতো উথান-পতন সামলে কি করে সে এত দৃঢ় মনোবল রাখে! তার এই জীবন জয়ের রহস্যই বা কি! এই রহস্য ভাঙ্গতে যেয়ে যা বুঝতে পারা যায় তা হল তার মনোনিবেশ। সারাদিনের প্রতিটি কাজ সে এত নিবিষ্ট মন দিয়ে করে যে কোন ধরণের দুশ্চিন্তা তার কাছেই আসতে পারে না। কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু করে ঘুমানোর আগ অবধি প্রতিদিনের ছোট বড় সব কাজ তার মনোজগতকে ঘিরে রাখে। সংসারের কোন কিছুই তার চোখ এড়ায় না। জীবনের আড় মোড়া ভেঙে, ঘড়ির অনুশাসন মেনে চলা মানুষ সে। কাজ তার কাছে খুব আনন্দের আর উপভোগের।
আজ থেকে আড়াই হাজার বছরের পুরনো চীনা বিখ্যাত দার্শনিক লাওৎস এর ‘ তাও দর্শন ‘ ও আমাদের তাই বলে যে খুব অস্থির আর বিষণ্ণ সময়ে যদি কেউ বর্তমানের উপর তার সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে, তবে তার মন আর মস্তিস্ক খুব শান্ত থাকে যাকে এক প্রকার মেডিটেশন বলে। যেমন ধরা যাক, কেউ খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কিংবা খুব অশান্ত মনে টেবিলের উপর বসে চা খাচ্ছে । সে তখন কি নিয়ে দুশ্চিন্ত তা না ভেবে, সে দেখছে তার চায়ের রঙটা আজ কেমন হল অথবা টেবিলের উপর দিয়ে কয়েকটা লাল পিঁপড়া হেঁটে যাচ্ছে আর তারা খাবারের জন্য এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে কিংবা চারপাশের পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের উপর যখন কেউ ভীষণ ভাবে মনোযোগ দেয় তখন তার দুশ্চিন্তা অনেক কমে আসে । রিনার বেলায় ও তাই ঘটেছে । কিন্তু সে তেমন পড়াশুনাও জানে না, সে জানে ও না তাও দর্শন কি, সে কেবল জানে কি করে এক মন দিয়ে কাজ করতে হয়। আশ্চর্যের বিষয় হল মনকে কেন্দ্রীভূত করে কাজ করার কারণেই সে এমনভাবে জীবন জয় করতে পেরেছে।
বয়স দিন দিন বেড়েই চলেছে । স্বাস্থ্য ভেঙে যাওয়াই এখন তাকে দেখতে আরও ছোটখাটো দেখায়। সব মেয়েদের বিয়ে দিয়ে এবার ছেলেকে ও বিয়ে করিয়েছে। এখন বাড়ির সব কাজ করার মানুষ এলেও জীবন থেকে সে মোটেও অবসর নেয়নি। এখন ও তার ঘর দুয়ার ঝকমক করে, গোসলের পর ভেজা কাপড় সে নিজেই রোদে মেলে দেয়। ছেলের বউকে ঘরের কাজে সাহায্য, নাতি নাতনিদের দেখভাল করা, সব কিছুতেই সে আনন্দ খুঁজে পায় । সে জানে সে বুড়ী হয়ে গেছে তবুও জীবনের রঙ তার কাছে এখনও এত তীব্র যে তার ভারী কাঁচের চশমার আড়ালে তার ঘোলা চোখে জীবন আজও রোদের ঝিলিক দিয়ে ঝলসে উঠে ।
আলীফ আলম: কথা সাহিত্যিক, মন্ট্রিয়ল, কানাডা
সিএ/এসএস
সর্বশেষ সংবাদ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন