লেখালেখি

সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ঐক্যের সুর | সঙ্গীতা ইমাম

সাংস্কৃতিক-বৈচিত্র্যে-ঐক্যের-সুর

সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ঐক্যের সুর | সঙ্গীতা ইমাম

২১ মে, বিশ্ব সাংস্কৃ‌তিক বৈ‌চিত্র সংলাপ দিবস । সংস্কৃ‌তি একজন মানুষ‌কে প্রকৃত মানু‌ষে প‌রিণত ক‌রে। গ‌বেষক‌দের ম‌তে, ভাষা, সা‌হিত্য, রী‌তিনী‌তি, মূল্য‌বোধ, জ্ঞান, শা‌ন্তি, শৌর্য, বিশ্বাস, চিরাচ‌রিত প্রথা ম‌নোভাব প্রস্তু‌তির সমাহার হ‌চ্ছে সংস্কৃ‌তি। জীব‌নের অর্ন্তগত সব বিষয়, কর্ম, চর্চা ও সাধনাই সংস্কৃ‌তি। বিশ্বে শা‌ন্তি ও স্থি‌তিশীলতা প্র‌তিষ্ঠায় সাংস্কৃ‌তিক বৈ‌চিত্রের অবদান‌কে স্বীকৃ‌তি দেয়ার ল‌ক্ষে পা‌লিত হয় সাংস্কৃ‌তিক বৈ‌চিত্র দিবস।

২০০১ খ্রীঃ ন‌ভেম্ব‌রে ইউ‌নে‌স্কো সাংস্কৃ‌তিক বৈ‌চিত্র বিষয়ক সার্বজনীন ঘোষণা দেয়। এর পর থে‌কে প্র‌তি বছর ‌গোটা বি‌শ্বে পা‌লিত হ‌য়ে আসছে সংলাপ ও উন্নয়‌নের জন্য সাংস্কৃ‌তিক বৈ‌চিত্র দিবস।

আজ জাতিসংঘ ঘোষিত ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দিবস’। ২০০১ সালে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ঘোষণা গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২১ মে বিশ্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য কী অসীম শক্তির ভান্ডার হিসেবে কাজ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে। আজকের প্রেক্ষাপটে যদি চিন্তা করি, তাহলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আমাদের রাজনৈতিক দর্শনগত আন্দোলনের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ, তার স্বরূপ সন্ধান করা যাবে। যে কোনো জাতীয় উৎসব, পূজা-পার্বণ বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক নানা উৎসবের সময় আমরা দেখি একদল হাজির হয় নানা ধরনের ভেদনীতির বক্তব্য নিয়ে। ধর্ম-বর্ণ-জাতি-সম্প্রদায় ইত্যাদি নানা বিভেদের দেয়াল তুলে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বহুধা বিভক্ত করার চেষ্টা দেখতে পাই। পাকিস্তান আমলেও আমরা দেখেছি ধর্মের দোহাই তুলে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা করেছিল শাসকগোষ্ঠী। বাঙালি তার সাংস্কৃতিক চেতনাবোধের আলোকেই তা প্রতিহত করেছিল ১৯৬১ সালে প্রতিবাদী রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে, তারা বাঙালি সংস্কৃতির উদার প্রেক্ষাপট বদলে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে মদদ দিয়েছে। ফলে বাহাত্তরের সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে উদারনৈতিক ধারণা ছিল, ধর্মনিরপেক্ষতার যে রাষ্ট্রীয় প্রত্যয় ছিল, তার বদলে প্রতিষ্ঠিত হয় সংকীর্ণবাদী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত কখনও ধর্মীয়, কখনও জাতিগত বা সম্প্রদায়গত বিভেদের দেয়াল তুলে যেভাবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হয়, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া একটি জাতিরাষ্ট্রের কাছে তা অনভিপ্রেত। কিন্তু রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও সাংস্কৃতিক ভেদবুদ্ধি আমাদের এই পথে ধাবিত করেছে।

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজ নিজ সংস্কৃতির যে ধারা তা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাকে গ্রহণ করেই বৃহৎ অর্থে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিধি তৈরি হয়। ধর্ম-জাতি বা সম্প্রদায়গত বিভেদের ধুয়া তুলে যারা এই সাংস্কৃতিক পরিধিকে ছোট করে আনতে চায়, তারা বাংলা সংস্কৃতির মূল মন্ত্রটাই বোঝেন না।

দুই

এখন সংস্কৃতি বলতে কেবল পরিবেশনাভিত্তিক সাংস্কৃতিক চর্চাকেই বোঝায়। কিন্তু সাহিত্য, শিল্পকলা, নাটক, চলচ্চিত্র বা নৃত্যগীতিবাদ্য সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, সংস্কৃতির সার্বিক তত্ত্ব আরও গভীর। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতি বলতে মুখ্যত দুটো ব্যাপার বোঝায় : বস্তুগত সংস্কৃতি আর মানস-সংস্কৃতি’। তিনি যাকে মানস-সংস্কৃতি বলেছেন, তার ওপরেই একটি জাতির মনন ও বোধের বিস্তার নির্ভর করে। বস্তুগত সংস্কৃতি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন কিন্তু সেই নিদর্শনের ইতিহাস অনুসন্ধান ও তার বোধ সঞ্চয়ের মানসিকতা মানস-সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে আমরা যে সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছি, তা কালের বিবেচনায় অনেক পুরোনো। এই সংস্কৃতির কিছু বৈশিষ্ট্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে মেলে, কিছু আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। নৃতাত্ত্বিক বিচারে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশে, ধর্মানুপ্রেরণায়, বর্ণপ্রথায় বা উৎপাদন পদ্ধতির অনেকখানিতে বাঙালি সংস্কৃতির মিল পাওয়া যাবে গোটা উপমহাদেশের সঙ্গে। এই স্বতঃস্টম্ফূর্ত দেওয়া আর নেওয়ার মোহনাতেই একটি সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করে। এখানে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, সাংস্কৃতিক মিথস্ট্ক্রিয়াও তেমনি জরুরি।

আজকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বললে যতখানি ইতিবাচক দৃশ্যপট ভেসে ওঠে, তার চেয়েও বেশি নেতিবাচক লক্ষণগুলো শনাক্ত হয়। আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতাতেও বাংলা ভাষারই নানা অঞ্চলের উচ্চারণ নিয়ে যে ব্যঙ্গ-তামাশা লক্ষ্য করি, তাতে মনে শঙ্কা জাগে। কারণ আমরা তো নিজের ভাষার উচ্চারণগত বৈচিত্র্যটুকুই গ্রহণ করতে পারছি না। অন্য ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি তো দূর অস্ত! এই বিভেদগুলো যখন প্রতিদিনের কাজে-কর্মে বা জীবনযাপনে চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তখন মনে হয় একটি দিন বিশ্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দিবস হিসেবে পালন করলেই কি এত বড় একটি সমস্যার সমাধান করা সম্ভব? হয়তো না, কিন্তু এর মাধ্যমে এই বিভেদগুলো নিয়ে আমাদের আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

আরেকটি বিষয় আমাদের আলোচনায় আনা প্রয়োজন। কেবল আগ্রাসনের কারণে পৃথিবী থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতি আজ হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে ভাষা। এগুলোর সঙ্গে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে অনেক লোককথা, পুরাণভিত্তিক জ্ঞান ও নানা ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি। হারিয়ে যাচ্ছে স্থাপত্যশৈলী, সাহিত্য ও সংগীত। এ যে কত বড় সভ্যতার সংকট, তা অনুভূতিপ্রবণ মানুষ মাত্রেই বুঝতে পারবেন। যে উন্নয়নের জোয়ারে আজ এই আগ্রাসনকে আমরা অনুমোদন করছি, সেই উন্নয়ন কিন্তু নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অভাবেই।

তাই আমাদের দায়িত্ব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা নানা ধরনের সংস্কৃতির পারস্পরিক মিথস্ট্ক্রিয়ায় ভূমিকা পালন করা। কাজটি আমাদের নিজের দেশ থেকেই শুরু করা উচিত। এই শ্যামল-সবুজ বাংলায় নানা ভাষার, নানা জাতি ও সম্প্রদায়ের যে সংস্কৃতি ছড়িয়ে রয়েছে, তাকে বিপন্ন না করে উপলব্ধি করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব। তাহলেই মানুষ হিসেবে এই বৈচিত্র্য থেকেই আমরা ঐকতান সৃষ্টি করতে পারব।

সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ঐক্যের সুর | সঙ্গীতা ইমাম : লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

আপনার মতামত দিন

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten − nine =