সত্তরের ডিসেম্বর মাসে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে প্রেরিত আমার প্রথম রিপোর্টটি সিলেটের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক যুগভেরী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় । এটাকে যদি আমার সাংবাদিকতা জীবনের গোড়াপত্তন হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে থাকি , তাহলে ২০২০ সালের আসছে ডিসেম্বর মাসে আমার সাংবাদিকতার ৫০বছর পূর্তি হবে । এই সময়কালে সিলেটের চারটি সাপ্তাহিক সহ দেশ- বিদেশের বহু সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকায় কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয় । এই অভিযাত্রায় সাংবাদিক হিসেবে আমার বেড়ে ওঠার পেছনে যাদের অবদান ছিলো অনস্বীকার্য, তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন আমীনূর রশীদ চৌধুরী, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, হিমাংশু শেখর ধর ( ঝর্ণা বাবু), সুধীরেন্দ্র বিজয় দাস ( সলুদা ), তবারক হোসেইন ও আব্দুল বাসিত । অকপটে স্বীকার করছি, সাংবাদিকতা জীবনের সূচনা লগ্ন থেকে এ পর্যন্ত এঁদের নানা দিক-নির্দেশনা ও সহযোগিতা আমাকে সৎ ও বস্তুনিষ্ঠতার পাশাপাশি সচেতন এবং নির্ভিক হতে প্রভূত প্রেরণা যুগিয়েছে । সকলের প্রতি আমার বিনম্র কৃতজ্ঞতা ।
সিলেটের সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে সর্বশেষ কর্মস্থল ছিলো আমার ‘ দেশবার্তা ” । প্রথিতযশা সাংবাদিক সর্বজন শ্রদ্ধেয় হিমাংশু শেখর ধর ( ঝর্ণা বাবু ) সম্পাদিত এই কাগজে আমার ‘৮৩ সাল পর্যন্ত টানা দীর্ঘদিন কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো । দেশবার্তা’য় কাজের সুবাদে আমি কখন কিভাবে যে পিতৃতূল্য সম্পাদকের পরিবার সদস্যদের সাথে এক নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে যাই, তা ভাবতে গেলেই বারবার স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি । আমি নিশ্চিত, আমৃত্যু এ বন্ধন অটুট থাকবে । কখনো কোনো ছেদ পড়বে না এই বন্ধনে ।
এই লেখাটির উপজীব্য বিষয় কিন্তু শুধুই ”দেশবার্তা” কিংবা পারিবারিক বিষয়- আশয় নয়, লেখাটির মূল চরিত্র হিসেবে আমি আজকের প্রজন্মের সংবাদকর্মী ও তরুণ- যুবাদের সামনে দেশবার্তা সম্পাদক হিমাংশু শেখর ধর সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরতে চাই এ কারণে যে, সিলেটের শতাধিক বর্ষের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে এই পথিকৃৎ গুণী মানুষটির অবদান সম্পর্কে অবহিত করার জন্য । কারণ, প্রচার বিমুখ এই মানুষটি সাংবাদিকতার পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে আমৃত্যু যে সেবা দিয়ে গেছেন , সে তুলনায় তাঁকে নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না । অথচ এই সমাজে নিরন্তর চলছে এমন সব মানুষের বন্দনা, যারা দানের চেয়ে গ্রহণই করছেন বেশি বেশি । আর উপেক্ষিত হচ্ছেন দেশ -জাতি ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার পরীক্ষা দিয়ে আসা প্রকৃত বিদগ্ধজনেরা।
বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের খলাগ্রাম নিবাসী এডভোকেট সুন্দরী মোহন ধর ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী প্রভাবতী ধর- এর দ্বিতীয় পুত্র হিমাংশু শেখর ধর ১৯১৯ সালের ২৬ এপ্রিল সিলেট শহরের কাষ্টঘরস্থ বাসভবনে জন্মগ্রহণ করেন।
একুশ বছর বয়েসে অর্থাৎ ১৯৪০সালে এই সুদর্শন লম্বাটে গড়নের যুবাটি সাংবাদিকতার সাথে প্রথম যুক্ত হন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কোলকাতা থেকে প্রকাশিত লোক সেবক ও ভগ্নদূত পত্রিকায় সিলেট প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের পর ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ডন, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব পাকিস্তান এবং ইউনাইটেড প্রেস অব পাকিস্তান- এর সিলেট প্রতিনিধির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এবং কাজ করেন টানা দীর্ঘদিন। ১৯৬১ সালে সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে আমিনুর রশীদ চৌধুরী সম্পাদিত সিলেটের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক যুগভেরী ও ইংরেজি সাপ্তাহিক ইস্টার্ন হ্যারলড-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। এ দুটি কাগজে টানা দীর্ঘ কর্ম জীবনের পর ১৯৬৮ সালে নিজ বাসভবনের সামনে সিলেট প্রিন্টার্স প্রতিষ্ঠা করে এবার নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করলেন ” সিলেট বার্তা ” ।
নানা ঝুঁকি সত্ত্বেও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পত্রিকাটির সর্বশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর বাসভবন, পত্রিকা কার্যালয় সহ পুরো ছাপাখানা এবং খলা গ্রামের বাড়িটি মারাত্মক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় । এলাকার ১৩ জন নিকট আত্মীয়কেও নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। হিমাংশু শেখর ধর এই মানসিক বিপর্যয়ের পরও দমে যাননি এতোটুকু। এই ধ্বংসস্তূপের উপরই নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ফের গড়ে তুলেন সিলেট প্রিন্টার্স এবং আবারও পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে এবার পত্রিকার নাম হলো ”দেশবার্তা ‘। নতুন কাগজে সিলেট নগরীতে নির্বিচারে গণহত্যার ধারাবাহিক কলাম লিখতে শুরু করেন খোদ সম্পাদক। কলামটি দ্রুত আলোচিত হয়ে ওঠে। পরবর্তি সময়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লিখতে গিয়ে অনেককেই এই কলামের সাহায্য নিতে দেখেছি। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটির প্রকাশনা ছিলো অব্যাহত। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে সে বছর চিকিৎসার জন্য হিমাংশু শেখর ধর কানাডা পাড়ি জমালে পাঠকপ্রিয় কাগজটির প্রকাশনা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। একই দশা হয় সিলেট প্রিন্টার্সেরও। বলতেই হয়, লন্ডন পাড়ি জমানোর আগে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত এই কাগজে আমার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সোনালী স্মৃতি রয়েছে। প্রয়াত কবি বন্ধু মাহমুদ হকও ছিলেন আরেক সহকারী সম্পাদক। আমাদের সময়কালে এটা অফসেটে ছাপা হতো । এক সময় হু হু করে প্রচার সংখ্যাও বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে চিত্রগ্রাহক আতাউর রহমান আতা এবং সিলেটের বিশিষ্ট লেখিয়েদের অবদান ছিলো শতভাগ। সম্পাদক তনয় দিবাকর ধর রাম , দীপঙ্কর ধর দীপু , দীপক ধর অপু এবং দেবাশীষ ধর গৌরাঙ্গ কাগজটির প্রচার ও মান ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্পাদকীয় উদার নীতির কারণে লেখকরা পত্রিকায় প্রাণ খুলে লিখতে পারতেন। এসময় কবি তুষার কর ছিলেন পত্রিকার অন্যতম নিয়মিত শক্তিমান লেখক। আর এটাও সত্য যে, কাগজের সকল লেখক ও শুভানুধ্যায়ীরা সব সময় প্রিয় সম্পাদকের কাছ থেকে পেতেন সমান সমাদর, স্নেহ- মমতা ও ভালোবাসা।
ভারতের সদ্য প্রয়াত লেখক- সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য ছাড়াও সিলেটের বহু রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং লেখালেখির জগতের নামি – দামী বরেণ্য ব্যক্তিদের আমি দেশবার্তা কার্যালয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা জম্পেশ আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে দেখেছি। এ ধরনের প্রাণবন্ত আড্ডা এখনো দেশের সংবাদপত্র অফিসগুলোতে হয় কিনা আমার জানা নেই। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, দেশবার্তায় একসময় যারা প্রথম লিখেছেন, তারাও আজ প্রতিষ্ঠিত লেখক হিসেবে স্বীকৃত। বাকীরা স্বমহিমায় দেদীপ্যমান।
দেশবার্তা সম্পাদক হিমাংশু শেখর ধর সিলেট প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালীন টানা দু’বছর সাধারণ সম্পাদক ও সহ – সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডেও নজিরবিহীন অবদান রাখেন। ১৯৬১ সাল থেকে ”৮৮ পর্যন্ত তিনি সিলেট পৌরসভার ইউনিয়ন কমিটির সদস্য ও পৌর কমিশনার হিসেবে জনগণকে সেবা দিয়ে যান। এছাড়া ১৯৬৩ থেকে ”৯০ সাল পর্যন্ত মদন মোহন কলেজ ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছাড়াও এইডেড হাই স্কুল, মির্জাজাঙ্গাল বালিকা বিদ্যালয়, রামকৃষ্ণ মিশন বালিকা বিদ্যালয়, মডেল হাই স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন স্কুল পরিচালনা কমিটির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এদিকে ১৯৬১ থেকে ”৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সিলেট জেলা সংখ্যালঘু বোর্ডের অন্যতম সদস্য। সিলেট জেলা সমবায় জমি বন্ধকী ব্যাংকের সভাপতি হিসেবেও তিনি প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় নিষ্ঠার সাথে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এ ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করায় তৎকালীন সরকার তাঁকে যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি প্রদান করে। সিলেটের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নিম্বার্ক আশ্রম, কালীঘাটের কালী বাড়ি, দুর্গাবাড়ি, ভোলানন্দগিরি আশ্রম, গোবিন্দ জিউর আখড়া ও রামকৃষ্ণ মিশনের সাথেও তিনি জড়িয়ে ছিলেন দীর্ঘদিন। আর ১৯৬০ সাল থেকে সিলেটের চালিবন্দর শ্মশান ঘাটের সার্বিক উন্নয়নে তিনি যে অবিস্মরনীয় অবদান রাখেন, তা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী। এক কথায়, মানব সেবাকে তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বলেই যা কিছু মহৎ ও চির কল্যাণকর, তার জন্যে সবসময় উজানে দাঁড় বেয়ে গেছেন।
এক জীবনে যার এতো কর্মযজ্ঞ, দেশ ও জাতিকে বিভিন্ন মাধ্যমে যিনি এতো এতো সেবা দিয়ে গেছেন, তাঁর জীবনের গল্প জানেন এই সময়ের ক’জন? আজকের সিলেটে অগণন পত্র- পত্রিকা, সংবাদকর্মী ও ফটো সাংবাদিক। এই সৃষ্টির পেছনে কারা নিরন্তর প্রেরণা যুগিয়ে গেছেন, আমরা একবারও কি তা ভেবে দেখেছি ? এই পথিকৃৎ ব্যক্তিরা যদি কালের অতলে হারিয়ে যান, তাহলে আমাদের জন্য তা হবে খুবই দুঃখ ও বেদনার বিষয়।
২০০৫ সালে হিমাংশু শেখর ধর চিকিৎসাধীন অবস্থায় কানাডার মন্ট্রিয়েলে ৮৫ বছর বয়েসে অগণন প্রিয়জনকে কাঁদিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বাঙলাদেশের হাইকমিশনার ও স্থানীয় মেয়রসহ অসংখ্য প্রিয়জন উপস্থিত ছিলেন। কানাডায় এখনো ঘটা করে তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হয়। তাঁর জীবনচিত্র নিয়ে কানাডা থেকে ”মৃত্যুঞ্জয়ী হিমাংশু শেখর ধর ” শীর্ষক একখানা স্মারক গ্রন্থও প্রকাশিত হয়। অথচ নিজের জন্ম মাটি প্রিয় বাঙলাদেশে মৃত্যুর পনেরো বছর পরও তিনি যেনো এক উপেক্ষিত নাম। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতো দূরের কথা , নিজেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেওয়া এই কীর্তিমান মানুষটি নিজ শহরেই যেনো আজ পরবাসী! এ লজ্জা আমরা ঢাকবো কি দিয়ে?