মহান স্বাধীনতার অগ্নিঝরা মার্চ মাস ও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এই ঐতিহাসিক ভাষণ
বিদ্যুৎ ভৌমিক || অগ্নিঝরা ও উত্তাল মার্চ মাস হল বীর বাঙালির গৌঁরবগাথা ও মহান স্বাধীনতার মাস। বাঙালী জাতির স্বাধীনতার মাস এ মার্চ মাস। আমাদের কাছে এই রক্তঝরা ও অগ্নিঝরা মার্চ মাসের রয়েছে এক স্বতঃস্ফূর্ত ও গৌরবউজ্জল অনুভূতি ও আবেদন। বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও জাতির জীবনেই স্বাধীনতা দিবসটি চির অম্লান ও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জীবনেও রয়েছে এর অপরিসীম গুরুত্ব ও তাৎপর্য। ১৯৭১ সালে গোটা মার্চ মাসই ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয়েছিল এই অগ্নিঝরা মার্চেই।
এটি একদিকে যেমন অগ্নিঝরা ইতিহাসের গৌরবউজ্জল মার্চ মাস, অন্যদিকে এটি একটি বিষাদ ও বেদনার মাস। ’৬৯-এর পাকিস্তানের তৎকালীন স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট আইউব বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ যে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে এগোচ্ছিল তা স্পষ্ট হয়ে যায় এই ১৯৭১ এর অগ্নিঝরা মার্চ মাসে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালিন স্বৈরাচারী সেনাশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য নবগঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আহ্বানকৃত সভা অগণতান্ত্রিকভাবে স্থগিত করার পরক্ষণেই উত্তাল হতে থাকে ঢাকার রাজপথ।
স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সেই অবৈধ এবং স্বৈরাচারী ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালি জাতির কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় যেতে পারবে না। স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করা ছাড়া অধিকার আদায়ের আর কোন বিকল্প নেই। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ছাত্র এদিন বটতলায় এসে জমায়েত হন। বটতলার সমাবেশে ইয়াহিয়ার স্বৈরাচারী ঘোষণার ধিক্কার জানানো হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২ মার্চ থেকে অহিংসা ও অসহযোগের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু ডাকে পুরো দেশই অচল হয়ে পড়েছিল। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু পল্টনে ঘোষণা করলেন ৭ মার্চ জনসভায় তিনি জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন।
১৯৭১ সালের এই সাতই মার্চ বাঙালির জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তি আন্দোলনের চরম উত্তাল সময়ে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন যা ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালি সার্বিক দিক-নির্দেশনা । সেদিন রেসকোর্স ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীনতাকামী লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেই দিনের বজ্রকণ্ঠে অগ্নিঝরা ভাষণেই ছিল আমাদের মহান স্বাধীনতার সার্বিক দিক-নির্দেশনা ও মুক্তিযুদ্ধের এক সঞ্জীবনী মন্ত্র। এই ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল বাঙালি জাতির নহে, পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী, নিপীড়িত, বঞ্চিত ও শোষিত জনগণের জন্য এক আলোকউজ্জল দিক-নির্দেশা। সম্প্রতি ইউনেস্কো এই ভাষণটিকে ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ বা বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল হিসাবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ যুক্ত করিয়াছে। তাই ইতিহাসে চির অম্লান তথা উজ্জ্বল হয়ে থাকবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এই ঐতিহাসিক ভাষণ। সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠেছিল গোটা জাতি । শুরু হয় রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম এই মার্চ মাসেই। একাত্তর সালের এই দিনে মুক্তিকামী বাঙালী জাতিকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ ২৪ বছরের লড়াই-সংগ্রামের পর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ভাষণেরই পরিণতি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মাত্র ১৮ মিনিটের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সেই ভাষণের আবেদন এতটুকু কমেনি। প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে এই ভাষণ প্রেরণার উৎস। যতদিন যাবে নতুন প্রজন্মের কাছে ৭ মার্চের ভাষণ অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে।
বিশ্বাসঘাতক ও নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে সব মূল্যবোধ ও ন্যায়নীতি লঙ্ঘন করে মধ্যরাতে গণহত্যার নীলনক্সা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ এ নামে তাদের ভয়ংকর মৃত্যুক্ষুধা মেটাতে দানবীয় নিষ্ঠুরতায় ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগেই মহান স্বাধীনতার মহান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তৎকালীন ইপিআরের ওয়ারলেসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। ইপিআরের ওয়ারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছড়িয়ে পড়লো সারাদেশে।
আগামী ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে ৫০তম মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পালন করবে। প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাঙালি তার মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়। তবে এবারের স্বাধীনতার মাসটি অন্যান্যবারের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রমী, তাৎপর্যে সুগভীর ও খুবই চেতনাসমৃদ্ধ। আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর নানা কর্মসূচী উদযাপিত হবে বছর জুড়েই । ২০২১ সালেই যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে সাড়ম্বরে পালিত হবে স্বাধীনতার ৫০তম সুবর্ণজয়ন্তী। আগামী ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী একই সূত্রে গাঁথা এক অমলিন চিরস্মরণীয় উপাখ্যান, যা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে মাথা উঁচু করে স্থাপন করেছে বিশ্ব মানচিত্রে, স্বমহিমায় ও স্বগৌরবে লাল-সবুজ পতাকার উজ্জল আলোকে। আমরা আজকের দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সেই বীর শহীদদের, যাঁরা স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁদের মূল্যবান জীবন দান করে প্রতিরোধ সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন । বাঙালী জাতি নানা আনুষ্ঠানিকতায়, অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে বাংলাদেশ স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
বিদ্যুৎ ভৌমিক, কলামিষ্ট, লেখক ও সিবিএনএ’এর উপদেষ্টা। মন্ট্রিয়ল, ক্যানাডা ৭ মার্চ, ২০২১ ( মহান স্বাধীনতার অগ্নিঝরা মার্চ মাস ও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এই ঐতিহাসিক ভাষণ )
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান