যাপিত জীবন

মৎস মারিব খাইবো সুখে -১ | সুশীল কুমার পোদ্দার

মৎস মারিব খাইবো সুখে -১ | সুশীল কুমার পোদ্দার

আমার বাড়ীর পাশে বহতা নদী গ্র্যান্ড রিভার। ও দক্ষিণ ওনটারীওর সবচেয়ে দীর্ঘতম এক নদী। নদী বলতে আমার চোখের সামনে যে কূল নাই কিনার নাই সীমাহীন ব্যাপ্তি চোখে পড়ে, যে আছাড়ি পাছাড়ি ঢেউ আমার মনের মধ্যে আছড়ে পড়ে, তা এখানে অনুপস্থিত। এ নদী কূল ভেঙে তেমন দরকার না হলে জনপদে ঢুকে পড়ে না, ভাসিয়ে নেয় না কোন বসত বাড়ি। প্রায় সাড়া বছর ও শুধু চলার জন্যই চলে। বসন্তের প্রারম্ভে যখন পাখীরা জেগে ওঠে, জেগে ওঠে বনভূমি দীর্ঘ শীত নিদ্রা থেকে, ও তখন বুক ভরা বরফ গলা জল নিয়ে কি এক প্রচণ্ড উৎচ্ছাসে ছুটে চলে আমার দেশের বরষার জলে ভরা নদীর মতো। তখন এ নদীতে ক্ষুধার্ত মাছেরা মরিয়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় খাদ্যের সন্ধানে।

কানাডায় মাছে ভরা নদী-নালা, লেক গুলোতে এ সময় ভিড় জমে চার ধরনের মানুষের :
* শৌখিন মৎস্য শিকারি – বোকা (?) কিসিমের কিছু মানুষ ( অধিকাংশ নন-এশিয়ান) যারা বড় বড় মাছ ধরে ছবি তুলে, চূমো দিয়ে পরম যত্নে মাছগুলো আবার ছেড়ে দেয়
* কিছু অমানবিক ও লোভী মানুষ যারা সারা বছরের মাছের প্রয়োজন মেটাতে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক মাছ শিকার করে আইনের পরোয়া না করে
* হাওয়া খাওয়া মানুষ – যারা বাস্তবতা থেকে ছুটি নিয়ে ফিরে আসে ক্ষণকাল প্রকৃতির কাছে
* সুযোগ সন্ধানী মানুষ – যারা করুন ভাবে চেয়ে থাকে যদি শৌখিন শিকারিদের কাছ থেকে মাছগুলো বিনা পয়সায় বাগিয়ে নেওয়া যায় ।

এখানে কেউই বিনা লাইসেন্সে মাছ ধরতে পারে না। কিন্তু অভ্যাস বসে সামান্য ক’টা পয়সা বাঁচানোর জন্য অনেকে বিনা লাইসেন্সে দেদাড়শে মাছ ধরে বেড়ায়। তারা আমায় উপদেশ দেয় লাইসেন্স করে পয়সা নষ্ট করার কোন মানে হয় না। কেউ কেউ নাকি লাইসেন্স বিহীন দীর্ঘ জীবনে কোন কনজারভেশন অফিসারকে দেখতেই পায়নি। আদৌ ওদের অস্তিত্ব আছে কিনা এ সম্বন্ধে অনেকে সন্দিহান। আমি দুর্বল চিত্তের মানুষ তাই দশ কথা ভেবে ছোট খাট একটা লাইসেন্স করে নেমে পড়ি মৎস্য শিকারে এই গ্র্যান্ড রিভারের জলে। কিন্তু আমি তো জানিনা কীভাবে রড দিয়ে মাছ ধরতে হয়! সেই শৈশবে ছোড়দার হাত ধরে মাছ ধরা শিখেছিলেম। বাঁশের একটা লগি অথবা গাছের কোন ডালের সাথে সুতো বেঁধে আটা দিয়ে মাছ ধরেছি। না ছিল কোন আর্ট, না ছিল কোন প্রযুক্তি। কিন্তু এখানকার মাছ শিক্ষিত। এক এক মাছের এক ধরণের রুচি বোধ – কেউ পছন্দ করে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, কেউ চূঈণ গাম, কেউ স্পুন, কেউ ব্যাঙ, কেউ মাকড়শা, আবার কেউ কেঁচো। এ বিদ্যা রপ্ত করার মতো হাতে সময় নেই তাই দেখে দেখে শিখে নেবার পথ বেছে নেই। কিন্তু দু একটা সান ফিস ছাড়া তেমন কিছু কপালে জুটে না।

একদিন ভাগ্যক্রমে পেয়ে যাই এক মৎস্য গুরুকে। উনি আমায় শিখালেন মাছ ধরার ছলা কলা। কি এক উদগ্র নেশায় পেয়ে বসে আমায়! আমি অফিসে যাবার নাম করে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে যাই শুনশান জঙ্গলের মাঝে বয়ে যাওয়া নদীর কাছে, ব্রিজের নীচে অগভীর জলাশয়ে। রাত্রে ঘুমের মাঝেও মাছ আমায় ডেকে নিয়ে যায়, স্বপ্নে পাতাড়ি (ফ্লোটার) উঠানামা করে। যা পাই তাই নিয়ে আসি ঘরে। সান ফিস ফ্রাই অত্যন্ত সুস্বাদু, মাছের ডিমগুলোও পুঁটী মাছের ডিমের মতো। ছেলেপুলে পরম আনন্দে খায়। গৃহিণীর চোখে আমি একজন দক্ষ মৎস্য শিকারি হয়ে উঠি। কিন্তু ওতো জানেনে আমি সারা দিন না খেয়ে অফিস কামাই করে হাওড়ে বাঁওড়ে ঘুরে ঘুরে এ মাছ গুলো ধরে এনেছি।এমনি করে আমি আস্তে আস্তে দক্ষ হয়ে উঠি। মাছের সাথে কেমন করে খেলতে হয়, কেমন করে হেঁচকা টানে মাছকে বড়শীতে গাথতে হয় আস্তে আস্তে সব রপ্ত করে ফেলি।

একদিন এক ছুটির সকালে আমরা এক নদীর ধারে। অসংখ্য মৎস্য শিকারি বিশেষ পোশাক পড়ে হাঁটু, কোমর জলে দাড়িয়ে। আমার সুতোয় টান পড়ে। অনেক খেলিয়ে উঠে আসে এক বিশাল মা কার্প। পেট ভর্তি ডিম। টেনে উপরে নিয়ে আসি। মৃত্যু আসন্ন মাছটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে অনিমেষ চোখে। কান্তা দিয়ে রক্ত ঝরছে, মুখটা বার বার খুলছে নিঃশ্বাস নেবার জন্য। পেটে ডিম নিয়ে ও হাঁপিয়ে গেছে। আমার সহধর্মিণী অদূরে দাড়িয়ে ব্যথিত চিত্তে আমায় মাছটা ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু আমি তো ছেড়ে দিতে শিখিনী। আমি যে মাছ ধরা আর মাছ মারার মাঝে পার্থক্য করতে শিখিনী। ছেলে বেলা থেকে শিখেছি মাছ ধরলে মরতে হবে, আর মারতে হলে ধরতে হবে। আমার বিবেক নাড়া খেতে অনেকটা সময় চলে যায়। হঠাৎ করে নিজকে অপরাধী মনে হয় – কেন আমি মাছটার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেছি। আমি মাছটাকে পাবার জন্য কি চরম নিষ্ঠুরতার পথ বেছে নিয়েছি ! ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি পরম যত্নে ওকে ছেড়ে দেই জলে । ও ভেসে থাকে প্রাণহীন দেহ নিয়ে। সবকিছু গুটিয়ে আমরা ফিরে আসি মৃত কার্পটিকে সাথে নিয়ে। কোথাও কোন আনন্দের লেশ নেই। সারা রাস্তা একটা সূক্ষ্ম বেদনাবোধ আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। সেদিনের মাছটা দীর্ঘ দিন ফ্রিজারে রেখে একদিন ফেলে দিয়ে চেষ্টা করি অপরাধ স্খালনের। মৎস মারিব খাইবো সুখে। কিন্তু সে সুখ আমার কপালে সয় না… চলবে…

মৎস মারিব খাইবো সুখে -১ | সুশীল কুমার পোদ্দার ,  ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন