Uncategorized যাপিত জীবন

জাপানের যাপিত জীবন – ৯ | সুশীল কুমার পোদ্দার

ধা রা বা হি ক…….পূর্ব প্রকাশের পর

জাপানের যাপিত জীবন – ৯ | সুশীল কুমার পোদ্দার

সকালে ভার্সিটি যাবার পথে প্রায়ই দেখা হয় এক জাপানী মায়ের সাথে। সাথে তার অনেক বড় এক ছেলে। মায়ের হাত ধরে কেমন যেন অসংলগ্ন ভাবে হেটে চলে। দেখে মনে হয় ওর এ পার্থিব জগতের সাথে কোন যোগাযোগ নেই, আপন মনে কখনো হাসছে, কখনো একা একা কথা বলছে। দূর থেকে দেখি, সরাসরি কথা বলতে সংকোচ হয়-যদি এ ভাগ্য বিরম্বিত মা টিকে কিছু জিগ্যেস করে অনাকাঙ্খিত ভাবে কষ্ট দিয়ে ফেলি।

একদিন ওর মা রাস্তার মাঝে ওয়ালেট ফেলে দিয়েছে। আমি কুড়িয়ে নিয়ে ওনাকে দিতেই গভীর কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে বার বার বলে চলে আরিগাতো গোজাইমাছু, দোমো আরিগাতো গোজাইমাছু। আমি সাহস সন্চয় করে ছেলেটাকে অভিবাদন করি। ও ওর নাম না বলে আমার দিকে নির্বাক চেয়ে থাকে। ওর মা ওর হয়ে ওর নাম বলে।

ছেলে তার কৈশোর পার করলেও বুদ্ধিতে, সামাজিকতায় অনেকটা পিছিয়ে, ও ওর নিজের জগতের মাঝে থাকতে ভালো বাসে,:কখনো কখনো মা বলে ডাকে তাও সম্পূর্ন নিজের ইচ্ছায়। এর পর থেকে যখনি দেখা হয়, মহিলা অকাতরে বলে যায় তার জীবনের গল্প । তার আরও একটা ছেলে আছে সেও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, বয়সের চেয়ে দুক্লাস নিচে স্কুলে বিশেষ ব্যবস্থপনায় পড়ালেখা করছে, আর তার এই ছেলে ছোট ছেলের চেয়ে অনেক অনেক পেছানো। স্বামী একক ভাবে তাকে দোষারোপ করে পরিত্যাগ করেছে। মহিলার কথা শুনে শান্তনা দেবার ভাষা খুজি, প্রেরণা দেবার ভাষা খুজি। মুখে কিছুই আসে না। অব্যক্ত যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে পরে স্কুল জীবনের কথা। মনে পরে আমাদের স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়া দুই সহোদরের কথা। বাবা ওদের কলেজের শিক্ষক। ওরা প্রতিবার ফেল করে একই ক্লাসে থেকে যায়। আমাদের রসীদ স্যার ওদেরকে সুন্দর গাধা বলে ডাকে। আমি সহ অনেকেই ঐ নাম শুনে কতো হাসাহাসি করেছি। কিন্তু কখনো বুঝিনি ওরা পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে, তাস খেলে বা বাজে সংগে মিশে ইচ্ছবাকৃতভাবে বারংবার পরীক্ষায় ফেল করেনি। প্রকৃতির এক দুজ্ঞেয় রহস্যময় কারনে ওরা আমাদের দৃষ্টি তে প্রতিবন্ধী হয়ে এ পৃথিবীতে এসেছে। (বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ASD -Autism spectrum disorder। কখনো কখনো ওদের বুদ্ধিমত্তা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক অনেক নিচে আবার কখনো কখনো আইনস্টাইনের চেয়েও বেশী। কিন্তু যেহেতু ওরা স্বাভাবিকের চেয়ে ভিন্ন তাই আমাদের সমাজ ওদেরকে প্রতিবন্ধী বলে)।

ঐ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলেটার সাথে, ওর মার সাথে পরিচিত হবার পর থেকে একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খেয়ে চলে। ছোটবেলায় যে আদুভাইয়ের গল্প পড়েছি, গল্পের প্রধান চরিত্র আদুভাই কি তাহলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছিলেন? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত মানুষ জানতো না autism কি বা কেন। শিক্ষিত পিতামাতার হাবাগোবা সন্তানকে কতো তুচ্ছ করে গরু বলে, গাধা বলে সমাজ ও রাষ্ট্র ওদের সামনে এক বিরাট অলঙ্ঘনীয় প্রাচীর তুলে দিতো। ঐ প্রাচীর ডিন্গিয়ে আদু ভাইয়ের মতো কজনাই বা জীবনের শেষ প্রচেষ্টা দিয়ে ক্লাস উর্তীণ হতে পেরেছে! অথচ উপযুক্ত পরিবেশ ও সহযোগিতা পেলে ওরা অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে অথবা সমাজে উল্লেখ যোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে – এর প্রমাণ মোটেই অপ্রতুল নয়। যখন autistic তালিকায় প্রতিথযশা মানুষদের নাম চোখে পড়ে তখন মনে হয় স্বাভাবিক হাত পা নিয়ে জন্ম নিয়ে জীবনটাই বৃথা হয়ে গেল; যদি হতাম ওদের মতো autistic!

Ref:
https://www.appliedbehavioranalysisprograms.com/historys-30-most-inspiring-people-on-the-autism-spectrum/

Carroll – Author of “Alice in Wonderland” Charles Darwin – Naturalist, Geologist, and Biologist
Albert Einstein – Scientist & Mathematician
Bobby Fischer – Chess Grandmaster
Bill Gates – Co-founder of the Microsoft Corporation
Steve Jobs – Former CEO of Apple
Sir Isaac Newton – Mathematician, Astronomer, & Physicist
Jerry Seinfeld – Comedian
Satoshi Tajiri – Creator of Nintendo’s Pokémon
Nikola Tesla – Inventor

আজ সকালটা অন্যরকম। নিয়মিত ধরা বাধা জীবনের মাঝে আজকের এ ব্যতিক্রম চোখে পড়ার মতো। রাস্তায় নানা রংবেরঙের ফেস্টুন। বড় বড় ট্রাক্টরের উপর ঝুলানো ব্যানারে জাপানিজে কি যেন কি সব লেখা। শহরের রাস্তা জুড়ে একটা সুশৃঙ্খল মৌন মিছিল। বহুদিন কোন মিছিল দেখিনি। আমরা মিছিল প্রিয় জাতি। ছোটবেলা যখন পাশের গলি দিয়ে মিছিল যেত কিছু না বুঝে কতবার গলা মিলিয়েছি – মানি না, মানতে হবে। মিছিলে শ্লোগানের মধ্যে এক একাত্মবোধ যা এখানে অনুপস্থিত। মিছিলটা একটা সপিংমলের কাছে স্বল্প বিরতি নেয়। একটা নিদিষ্ট স্থানে (speaker corner) একজন কিছু একটা বক্তব্য রাখে পরে শুনেছি এটা জাপান জুড়ে জাপানিজ সরকারের ইন্দোনেশিয়ার থেকে চাল আমদানির বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিবাদ।

জাপানিজরা স্টিকি রাইস খেতে অভ্যস্ত। জাপান সরকার দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় ইন্দোনেশিয়া থেকে যে চাল আমদানি করেছে তা স্টিকি নয়। সরকারি প্রচার মাধ্যমে এই নন-স্টিকি রাইসকে কেমন করে স্টিকিতে পরিণত করা যায় তার উপর একটা ডকুমেন্টরী প্রতি রাতেই প্রচার করে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয় না। জাপানিজরা এই চাউলকে সম্পূর্ণ ভাবে বর্জন করে। রাস্তায় কোন পুলিশী তান্ডব নেই, নেই কোন ধরপাকড়। জনগণের কাছে সরকারের এহেন আত্মসমর্পণে খুলে যায় আমাদের ভাগ্য।

এক সন্ধ্যায় ডঃ আকবর আমাদের জানায় বাঙালী কমিউনিটি পরিবার পিছু বিনামূল্যে একশ কেজি করে চাল বরাদ্দ হয়েছে। আমাদের কমিউনিটি জুড়ে একটা আনন্দের ঢেউ খেলে যায় – যে ঢেউয়ে সমানভাবে উদ্বেলিত হয় এই ছোট্ট শহরে বসবাসকারী মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সকল বাঙালী ।

জাপানে এসে যে জিনিষটা সবচেয়ে ভাল লাগে তা হলো ওদের সবকিছুতে নিয়মতান্ত্রিকতা। কোন কিছুতে তেমন বাড়াবাড়ি নেই। ওরা মিছিল করে, তবে শৃঙ্খলা নিয়ে। Kenzaburō Ōe সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি এই সিককু তথা মাৎসুইয়ামার সন্তান। তার কৈশোর, শৈশব ও যৌবনের প্রারম্ভ কেটে গেছে এই সিককুতে অথচ এই নিয়ে নেই কোন সাধারণ মানুষের না বুঝে মাতামাতি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অডিটোরিয়ামে ঊনার জীবনের উপর এক আলোচনা সভা ডাকা হয়েছে। আমার সেনসি শুধু বিজ্ঞানেই নয় সাহিত্যেও ঊনার আগ্রহ অপরিসীম। আমি সেনসেই এর সাথে হাজির হই অডিটোরিয়ামে। Kenzaburō Ōe এর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করছেন বিভিন্ন প্রাজ্ঞ জন। পর্দায় ভেসে উঠে Kenzaburō Ōe সাথে তার সন্তান, হিকারী ( আলো)। পৃথিবীতে ও জন্ম নিয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ মস্তিস্ক নিয়ে। এই প্রতিবন্ধী সন্তানের প্রতিবন্ধকতাকে মেনে নিতে তার বড় কষ্ট হয়। এ কষ্ট থেকে উত্তরণের পথ তিনি খুঁজে পান তার লেখনীর মধ্যে। আর এমনি এক লেখা তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। তিনি বড় হয়েছেন ঘন অরণ্যঘেরা সিককুর প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তার জীবনের বড় সাধ ছিল একদিন তিনি পাখীদের ভাষা বুঝবেন, ওদের সাথে কথা বলবেন, দূর আকাশে ওদের সাথে উড়ে যাবেন একদিন। তার এই সাধ পূরণ করেছিল তার প্রতিবন্ধী সন্তান।

হিকারী তখন ছয় বছরের বালক। ও কথা বলতে পারে না। মানুষের কথায় কোন প্রতিত্তোর করে না, শুধু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। একদিন এক গভীর বনাঞ্চলের মাঝে ওরা এক কটেজে। অদূরে জলাভূমিতে ঘুঘুরা একে অপরের সাথে কথা বলছে। হিকারী যেন বুঝতে পারে ওদের কথা, তার মুখে প্রথম কথা ফোটে। আধো আধো কন্ঠে বলে উঠে -ঘুঘু …। জীবনের অনেক চরাই উৎরাই পার হোয়ে হিকারী এখন vocational training center e প্রতিবন্ধীদের সাথে কাজ করে, গান লেখে। হিকারীর জীবনের অনেক অজানা তথ্য Kenzaburō তার নোবেল প্রাইজ স্পীচে বলে যান অকাতরে। প্রতিবন্ধী সন্তানের এ উত্তরণের কাহিনী আমায় মুগ্ধ করে। আমি মনে মনে খুঁজে বেড়াই সেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তানের মা টিকে। সেদিন তাকে সান্ত্বনা দিতে পারিনি। আজ আমার কাছে আছে Kenzaburō , আছে হিকারী। হিকারীর আলো নিশ্চয়ই সেই স্বামী পরিত্যক্ত মা টিকে প্রেরণা দেবে। প্রতিদিন আশায় থাকি হয়ত দেখা হবে আবার…

চলবে…
জাপানের যাপিত জীবন – ৯ | সুশীল কুমার পোদ্দার ,  ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
লেখকের স্মৃতিচারণের অন্যান্য পর্বগুলি দেখতে হলে 
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ১ |  যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ |  যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৩ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ |  যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৫ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৬ |  যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৭ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৮ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৯ |
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ১ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ২ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৩ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৪ | ,
জাপানের যাপিত জীবন – ১ |জাপানের যাপিত জীবন – ২ জাপানের যাপিত জীবন – ৩ জাপানের যাপিত জীবন – ৪ জাপানের যাপিত জীবন – ৫ জাপানের যাপিত জীবন – ৬ জাপানের যাপিত জীবন – ৭ জাপানের যাপিত জীবন – ৭
এস এস/সিএ

সর্বশেষ সংবাদ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
সংবাদটি শেয়ার করুন