মুক্তিযুদ্ধ

স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার


পূর্ব প্রকাশের পর…

স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার

প্রায় সকালে খবর আসে ইটের ভাটায় লাশ পরে আছে। কখনো পরিচিত,কখনো অপরিচিত। এ সহজ লভ্য মৃত্যু, ঐ ফ্যাঁকাসে মৃত দেহগুলোকে আড়চোখে দেখে বিচলিত হই, শঙ্কিত হই। তবু দল বেধে কেন যে দেখতে যাই বুঝে উঠতে পারিনে।

আমাদের বাড়ী সংলগ্ন রাস্তাটির গা ঘেঁষে আকাশ ছোঁয়া মেহুগুনী গাছ। সকাল হলেই দলে দলে কাক এসে গাছটাকে ছেয়ে ফেলে। স্থানীয় এক সৌম্য দর্শন যুবক রাইফেল দিয়ে অকাতরে হত্যা করে গাছে বসা কাকগুলোকে। আপন জনের সংকটে কোথা থেকে ছুটে আসে অযুত নিযুত কাক। কাকা রবে মুখরিত হয় মধ্যাহ্নের আকাশ। আমরা ছোটরা দৌড়ে দৌড়ে আহত নিহত কাকগুলো এক জায়গায় জড়ো করি। নিহত কাকেরা নিস্পলক চেয়ে থাকে। আহতরা ডানা ঝাপটায়। আদালতের টিউব ওয়েল থেকে খোলায় করে জল নিয়ে এসে ওদের মুখে তুলে দেই। মনে প্রশ্ন জাগে ওরা কি কোন অপরাধ করেছে? যার শাস্তি এই মৃত্যুদণ্ড! অনেককে প্রশ্ন করি সবাই কেন যেন এড়িয়ে যায়। একদিন প্রত্যুষে সেই সৌম্য দর্শন যুবকের লাশ পড়ে থাকে বি এ কলেজ মাঠে। রাজনীতি বুঝি না। জীবনের জটিলতা বুঝি না। তাই তার সম্মানিত পিতা যখন মৃত পুত্রকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন, তখন চোখ ভরা জল নিয়ে নীরবে দাড়িয়ে থাকি।

চারিদিকে কেমন যেন অস্থিরতা। বাবা সামান্য পূঁজি নিয়ে পার্টনারশিপে একটা সোনা কেনা বেচার দোকান খোলে। খদ্দেরের চেয়ে দোকানের সংখ্যা অধিক। মানুষকে ঠকানোর কতো অভিনব কৌশল নিয়ে অসংখ্য দোকানী উৎ পেতে বসে থাকে। গ্রাম থেকে সরল সহজ মানুষগুলো গহনা বেচতে আসে। নাকের নোলক, কানের দুল, হাতের শাখা। আমি স্কুল থেকে এসে বাবার সাথে দোকানে বসি। কষ্টি পাথরে কষ দিয়ে, নাইট্রিক এসিড দিয়ে, সিগারেটের ছাই দিয়ে সোনার গুনগত মান যাচাই করার গুপ্ত বিদ্যা আস্তে আস্তে রপ্ত করে ফেলি। গন্ধ শুকে, ধাতব বস্তুর উপর ফেলে দিয়ে শব্দ শুনে শিখে ফেলি চাঁদি রুপা, তামুজ রুপার পার্থক্য। অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি সোনার সাথে আনুপাতিক হারে দস্তা মিশিয়ে গলিয়ে কেমন করে তৈরি করতে হয় সোনার পিঠে। শিখে ফেলি সোনার পিঠেতে এসিড দিয়ে কিভাবে খাদ বেড় করতে হয়।

দোকানে তেমন খদ্দের আসে না। স্বল্প বেচাকেনা দিয়ে আমাদের সংসারে দরিদ্রতা কিছুতেই দূর হয় না। রেশন থেকে চাল চিনি গম সংগ্রহ করতে হয়। দিন দিন সেই চাল গমের মান নিম্ন থেকে নিম্নতর হয়ে যায়। একটা শ্রেণী হঠাৎ করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছে পরিণত হয়। আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে চলি চুয়াত্তরের মন্বন্তরের দিকে ।

সেবার আকাশ ভাঙ্গা বর্ষণ ও সীমান্তের ওপার থেকে বেয়ে আসা ঢলে উত্তর বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসলী জমি ডুবে যায়। বিপণন অব্যবস্থা, এক শ্রেণী মানুষের সীমাহীন দুর্নীতি সহ বহুবিধ কারণে চালের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে চলে। তখনকার সময়ে তিন-বেলা ভাত খাবার রীতি ছিলো। চালের আক্রাতে তিন-বেলা থেকে দুবেলা ভাত খেতে যেয়ে নিজকে খুব দুখী দুখী লাগে। একদিন খবর আসে আমাদের বাড়ী সংলগ্ন খলিফা পট্টিতে ন্যায্য মূল্যে চাল দেবে। স্কুল বাদ দিয়ে আমরা দুভাই বিরাট লাইনে দাড়িয়ে পড়ি। দোকান খোলা মাত্র অপেক্ষারত মানুষ গুলো মরিয়া হয়ে উঠে। লাইন ভাঙ্গা গড়ার খেলা চলে। আমি পায়ের নিচে পিষ্ট হবার নিশ্চিত সম্ভাবনা থেকে কোনমতে বেচে যাই। আমার পায়ের উপর অকস্মাৎ চলে যায় একটা রিক্সার চাকা।আমি দাঁত কামড়িয়ে লাইনে দাড়িয়ে থাকি। দুভাই ফিরে আসি চার কেজি চাল নিয়ে।

গ্রাম থেকে অসংখ্য মানুষ শহরে এসে জড়ো হয়। পথে ঘাটে অসংখ্য ভিক্ষুক। চুয়াত্তরের মন্বন্তরের নীরব সাক্ষী হয়ে ইলিয়ট ব্রিজের উপর, বাজার স্টেশনে ভিক্ষার থালা হাতে বসে থাকে নিরন্ন মানুষ। সে আঁকালের দিনগুলোতে বাবা মার হতাশা ভরা চোখের ভাষা বয়সের কারণে হয়তো বুঝতে পারিনি। তাই বাবার কাছে বায়না করি নতুন জামার। লাল সবুজ পতাকার ঐ সবুজ রংয়ের জামা। সকাল বিকাল ধর্না দিয়ে খলিফার কাছ থেকে নিয়ে আসি আমার স্বপ্নের জামা। সে জামাতে অনেকগুলো ঢাকনা দেয়া পকেট। বিস্তর পকেটের বৈভবে নিজকে খুব বিত্তশালী মনে হয়। এক এক পকেটে এক এক স্বপ্ন পুরে ঘুরে বেড়াই ছোট্ট শহরের অলিতে গলিতে।

চ ল বে ….

লেখকের স্মৃতিচারণের অন্যান্য পর্বগুলি দেখতে হলে 

যুদ্ধের স্মৃতি কথা ১ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৫ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৬ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৭ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৮ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৯ | সুশীল কুমার পোদ্দার
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ১ | সুশীল কুমার পোদ্দার

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

 

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন