ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব – ৬ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব – ৬ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

পূর্ব  প্রকাশের পর। পর্ব- ৬

প্রাণতোষ ইরাকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন৷ গোবিন্দও বাড়ি চলে গেল৷ যাবার সময় গোবিন্দকে বলে গেলেন, আমি কালকে ফ্যাক্টরিতে যাব, সবাইকে বলে রেখো৷ গোবিন্দ মাথা নাড়ল৷

ইরাকে গাড়িতে উঠিয়ে বালীগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে যখন পৌছলেন প্রাণতোষ তখন বেশ রাত হয়ে গেছে৷ ড্রাইভার গাড়ি গ্যারেজ করে চলে গেল৷ ইরাকে সঙ্গে নিয়ে বৈঠকখানা ঘরে বসালেন প্রাণতোষ৷ বাড়ির সব সময়ের কাজের লোক রতন ঘরে ঢুকতেই প্রাণতোষ ইরাকে দেখিয়ে বললেন, আমার এই মাকে ভেতরে ছবিমাসির কাছে নিয়ে যাও৷ ছবিমাসি হল প্রাণতোষের মায়ের আমলের লোক৷ ছবিমাসির তিন কূলে কেউ নেই৷ ছবি মাসিই কোলে পিঠে করে প্রাণতোষকে মানুষ করেছেন৷ তাই মা মারা যাবার পরও প্রাণতোষ ছবি মাসির সব দায়িত্বই নিয়েছেন৷

ইরা রতনের সঙ্গে ছবি মাসির ঘরের দিকে পা বাড়াল ৷ আর প্রাণতোষ সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলেন গিন্নী রমলার সঙ্গে দেখা করতে৷

প্রাণতোষের রক্তে ব‍্যবসা। ওর বাবা  আশুতোষবাবুও ছিলেন বৈষয়িক মানুষ।  ওর মায়ের বাবা খগেন্দ্রবাবু একসময়ে দাপুটে উকিল ছিলেন। ওর মা নীলিমা সে সময়ে বাসন্তী দেবী কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেছিল৷ নীলিমার মধ্যে একটা লাবণ্য ছিল ৷ সবাইকে আপন করে নিতে জানত৷

সেই নীলিমার বয়স যখন তেইশ তখন আশুতোষবাবুর সঙ্গে  বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে সংসার করতে আসেন৷ নীলিমার বাবা খগেন্দ্র নাথ রায়ের পছন্দ হয়েছিল আশুতোষকে৷ জমি সংক্রান্ত একটা বিষয়ে গন্ডগোল হওয়ায় খগেন্দ্র বাবুর কাছে গিয়েছিলেন আশুতোষ৷ টালিগঞ্জের ওখানে কুড়ি কাঠা জমি কিনেছিলেন  আশুতোষবাবু৷ সেই জমিতে লোকাল মস্তানরা চোলাইয়ের ঠেক বানিয়েছিল৷

আশুতোষ ঠিক করলেন, ওখানে বাল্বের কারখানা বানাবেন, তখন ওরা হুমকি দিতে থাকল।একদিন আশুতোষ বাড়ি ফিরছিলেন, বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল৷ ঝড় বৃষ্টিতে রাস্তায় গর্তে গাড়ির চাকা পরে আটকে গিয়েছিল , ড্রাইভার আর আশুতোষ গাড়ি থেকে নেমে বৃষ্টিতে ভিজে গাড়িটা পেছন দিয়ে ঠেলে সবে গাড়ি গর্ত থেকে উঠিয়েছেন , সে সময় দু তিনজন ষন্ডামার্কা লোক এসে আশুতোষের শার্টের কলার ধরে যেই ঘুষি মারতে যাবে অমনি টহলদারি একটা পুলিশের ভ্যান সেখানে এসে পরায় ওরা দৌড়ে পালাল৷ কিন্তু ওরা যে চোলাই মদের ঠেকের মস্তান সেটা উনি চিনে ফেললেন৷

তারপর আশুতোষ আর দেরী করেন নি৷ উকিল হিসেবে খগেন্দ্র বাবুর নাম আগেই শুনেছিলেন৷ তাই ওনার  জুনিয়র হীরকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে খগেন্দ্র বাবুর সঙ্গে দেখা করলেন৷ প্রথম দর্শনেই আশুতোষকে ভাল লেগে গেল খগেন্দ্রর৷ সুদর্শন, শিক্ষিত, অমায়িক স্বভাবের ছেলেটিকে জামাই করবার প্রস্তাব নিয়ে তিনি নিজে গিয়েই উপস্থিত হলেন আশুতোষের মা বিভাবতী দেবীর কাছে৷ আশুতোষের যখন দশ বছর বয়স তখন উনি পিতৃহারা হন। বিভাবতীই একার হাতে ছেলেকে বড় করেছেন। তাই তিনিই ছেলের অভিভাবক।

খগেন্দ্রবাবুর প্রস্তাবে তিনি আর আপত্তি করলেন না ৷ বিশে ফাল্গুন ঘটা করে ছেলের বিয়ে দিয়ে পুত্রবধু করে আনলেন নীলিমাকে৷

এরমধ্যে খগেন্দ্র বাবুর ফোনে লোকাল এম এল এর ধমকে চোলাই মদের ঠেকও ভেঙে গেল৷ আশুতোষও ওখানে বাল্বের কারখানা তৈরি করলেন৷ বিয়ের  বছর ঘুরতেই নীলিমার কোল আলো করে প্রাণতোষের জন্ম হল।

প্রাণতোষ আর রমলার দুই পুত্র সন্তান। বড় মনোতোষ ছোট দেবতোষ ৷ দেবতোষ প্রেসিডেন্সিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়ে৷ মাঝে মাঝে গিয়ে বাবার ব্যাবসাও দেখাশুনা করে৷

গোবিন্দর সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক দেবতোষের৷ দমদমের কারখানায় গেলে গোবিন্দই ওকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখায়৷ নাটক, ফুটবল এসব নিয়ে গল্পও হয়৷

আশুতোষবাবু গত হয়েছেন অনেক বছরই হল৷ নীলিমাও স্বামী  মারা যাবার ছয় মাসের মধ্যেই গত হলেন। এখন রমলা সংসারের কর্ত্রী হলেও , শ্বাশুরীর আমলের  ছবিমাসির কথা ওরা সবাই মেনে চলে৷

প্রাণতোষ ঘরে ঢুকে রমলাকে সব কথা খুলে বলল৷ রমলা বলল, তুমি ভালই করেছো৷ আমাদের তো মেয়ে নেই৷ ভালই হল একটা মেয়ে পেলাম৷ তাহলে তো আর বেশী দেরী নেই, আসছে রবিবার মানে আজকে শুক্রবার মাঝে মোটে নয় দিন৷ কালকে থেকেই জোগাড় যন্তর করতে হবে৷

তুমি বাইরের পোষাক ছেড়ে পরিষ্কার হয়ে নাও তারপর ছবি মাসির ঘরে চল৷

প্রাণতোষ বলল, সেই ভাল৷

কিছুক্ষণ পরে প্রাণতোষ আর রমলা ছবি মাসির ঘরে গেল৷ খাটের এককোনে ইরা বসে আছে৷ আসার সময় বাড়ি থেকে একটা ছোট্ট ব্যাগে করে কয়েকটা কাপড় এনেছিল৷ স্নান করে তার থেকে একটা হলুদ রঙের শাড়ি পরে বসে আছে৷

মুখটার বড্ড মায়া৷ প্রাণতোষ  বললেন, এই যে ইরা মা তোমার মাসীমা৷

ইরা সবার পা ছুঁয়ে আবার প্রণাম করল৷

রমলা ইরার চিবুক ছুঁয়ে বলল, ভয় পেও না মা৷ ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য৷

প্রাণতোষ মাসী বলে ডাকতেই , ছবি মাসী বলে উঠলেন, আমি ইরার কাছে সব শুনেছি৷

তোরা কাজকর্ম সব শুরু করে দে৷

তবে আমার একটা কথা আছে৷

সবাই ছবি মাসীর দিকে তাকাতেই ছবিমাসী বললেন, দেখ ওর বাড়ির যা অবস্থা শুনলাম, বাবা ছাড়া তো কেউই নেই৷ আর বাবাও বিছানায় পরে আছে৷

মেয়েটা এরপর সংসার করবে৷ ওর বাবাকে কি মনে করিস কেউ আর দেখবে? বিছানায় নোঙরার মধ্যেই পরে থাকবে, খাবারও ঠিক মতন জুটবে না৷

আমাদের এখানে কাজের অনেক লোক আছে৷ কাজেই ওনাকে দেখাশুনা করার অসুবিধে হবে না৷ আর তাছাড়া বাগানের দিকের ঘরগুলো তো ফাঁকাই পরে আছে৷ ওর একটিতে যদি ওর বাবার একটা থাকার ব্যাবস্থা করে দিস তবে মেয়েটাও শান্তি পাবে৷

আর ওর বাবাও যে কদিন বাঁচবেন একটু ভালভাবে থাকতে পারবেন৷

প্রাণতোষ আর রমলা দুজনেই আনন্দে বলে উঠল, মাসী তুমি ঠিকই বলেছো৷ কালকে আমি কারখানায় যাব৷ তখন গোবিন্দকে সব বলে রবিবার সকালে আমাদের বাড়িতে আসতে বলব৷

তারপর গোবিন্দ, ইরা, রতনকে নিয়ে গাড়ি করে আমি নিজে  গিয়ে ইরার বাবাকে এখানে নিয়ে আসব৷ আমি সঙ্গে থাকলে আর কারুর কিছু বলার সাহস থাকবে না৷

সব শুনে ইরা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল৷

পরদিন শনিবার হাফবেলা করে ছুটি হয়ে যায় কারখানা৷ তাই একটু সকাল সকাল করেই গাড়ি নিয়ে  বেড়োলেন প্রাণতোষ৷ কারখানায় পৌছতে এগারোটা বেজে গেল৷ প্রাণতোষের গাড়িটা কারখানার বড় দরজা দিয়ে ঢুকতেই হৈ হৈ পরে গেল৷ প্রাণতোষ সবাইকে বললেন, আপনারা কাজ সেরে অফিস ঘরে সবাই আসবেন৷

তারপর প্রাণতোষ গোবিন্দকে অফিস ঘরে ডেকে এনে গতকাল রাতের সব কথা বললেন৷ আর বললেন, শোনো তুমি যে ঘরে থাকো সেই ঘরদুটো, রান্নাঘর, বারান্দা সব রঙ করিয়ে, নতুন খাট, আলমারি সব সাজিয়ে তারপরে ইরা মাকে নিয়ে এখানে আসবে৷ আগে তোমাদের বিয়েটা হয়ে যাক তারপর এই কাজগুলো করা যাবে৷ যতক্ষণ না এসব ব্যাবস্থা হবে তোমরা বিয়ে করে আমাদের বাড়িতেই থাকবে৷

আজকে বিকেলে বাড়িতে স্যাকরা আসবে, তোমার আঙুলের মাপটা দিয়ে দাও৷

গোবিন্দ ওর ডান হাতের মধ্যমায় যে তামার আঙটিটা পরত সেটা খুলে প্রাণতোষের হাতে দিয়ে দিল৷

প্রাণতোষ বললেন, তোমার যদি কাউকে মনে হয় বিয়েতে বলবে, তাকে বলে দিও৷

গোবিন্দ বলল, আমার আর কে আছে ? সেই কোন ছোটবেলা থেকে আপনার আশ্রয়ে আছি৷ এক মা ছিল, সেও চলে গেল৷ তারপর থেকে তো আপনারাই আমার সব৷

কারখানায় ছুটির ঘন্টা বাজতেই সবাই অফিস ঘরে এসে জড়ো হল৷ প্রাণতোষ বললেন, আপনাদের একটা আনন্দের খবর দেবার জন্যই আমার এখানে আসা৷ খবরটা হল গতকাল একটি মেয়েকে আমাদের গোবিন্দ মস্তানের হাত রক্ষা করে এবং বিষয়টা থানা পর্যন্ত গড়ায় আপনারা সবাই জানেন৷ আর আমি যদি সময় মতন না আসতাম তাহলে ব্যাপারটা আরও দূর গড়াতো৷ কিন্তু বিষয়টা থিতু হলেও মেয়েটির বাড়ি থেকে একপ্রকার মেয়েটিকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়৷ বাড়িতে তার অসুস্থ পঙ্গু বাবা ছাড়া কেউই নেই৷

আমি তখন অসহায় মেয়েটিকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি ৷ আর সেই সঙ্গে ঠিক করি আমাদের গোবিন্দর সঙ্গে মেয়েটির আগামী রবিবার বিয়ে দেব৷ সেজন্য আমি আপনাদের সবাইকে নিমন্ত্রন করতে এসেছি৷ আগামী রবিবার সন্ধেবেলা আপনারা বিয়ে দেখে রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরবেন৷

প্রাণতোষের কথা শেষ হতেই শ্রমিকদের মধ্যে হৈ হৈ শুরু হয়ে যায়৷ সবাই খুশীতে গদগদ হয়ে  বলতে থাকল, স্যার আপনি একটা মেয়েকে উদ্ধার করে দিলেন৷ আপনার তুলনা হয় না৷

প্রাণতোষের আগেই ড্রাইভার রতনকে বলা ছিল তাই রতন রসগোল্লার হাড়ি নিয়ে অফিস ঘরে ঢুকে, হাড়ির মুখ খুলতেই টপাটপ সবাই মুখে রসগোল্লা পুরে যে যার বাড়ির দিকে রওনা হল।

শনিবার বিকেলে বাড়ির স্যাকরা হরিবাবু এল৷ এই বাড়ির সমস্ত গয়না বানানোর দায়িত্ব তার৷ রমলা, ছবি মাসি হরি বাবুর সঙ্গে কথা বলা শুরু করল৷ যেহেতু সময় বেশী নেই, তাই হরি বাবু আসার সময় কিছু তৈরি করা গয়না নিয়ে এসেছিল৷

তার মধ্যে থেকে একটা সীতা হার, একটা চিক , কানবালা আর দুটো চূড় পছন্দ হল রমলার৷ ইরাকে ডেকে চুড়টা পরিয়ে দেখল রমলা, হাতের মাপ ঠিকই আছে৷ বিয়ের পর সব সময়ের জন্য পরার চুড়ির কথা উঠতেই হরি স্যাকরা বলল, বৌদি আমার চুড়ি বানানো নেই৷

তখন রমলা ছবি মাসিকে বলল, মাসি আমার বিয়ের পর যে আট গাছা চুরি আমার দাদা শ্বশুর দিয়েছিলেন ওগুলোতো এখন আমি পরতেও পারিনা, আমার হাতে ছোট হয়, ওর থেকে ছগাছা চুরি ইরাকে দিয়ে দিই কি বল?

ছবি মাসিও ঘাড় কাত করল৷

রমলা তখন হরি স্যাকরাকে বলল, আপনি জামাইয়ের আঙটি আর মেয়ের আঙটি , জামাইকে আশীর্বাদ করার জন্য সোনার বোতাম, আর একটা নোয়া বাঁধানো বানিয়ে আগামী শণিবারের মধ্যে নিয়ে আসবেন৷

আর এই গয়নাগুলো রেখে যান৷ দাদার কাছে গিয়ে টাকা পয়সার হিসেব করে নেবেন৷

হরি স্যাকরা চলে যাবার পর রমলা গয়নাগুলো নিয়ে শোবার ঘরের সিন্দুকে তুলে রাখল৷

চলবে…

কৃষ্ণা গুহ রয়- উপন্যাসিক, কবি। পশ্চিমবঙ্গ


অন্যান্য পর্বগুলো পড়তে হলে

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব -১ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব -২ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব -৩ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব -৪ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স || পর্ব – ৫ ।। ভাল থাকার বাসা ||| কৃষ্ণা গুহ র‍য় 

 

 





সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

 

সংবাদটি শেয়ার করুন