পর্ব – ৬ (শেষ) | পূর্ব প্রকাশের পর…
ধারাবাহিক একটি রিয়্যালিটি উপন্যাস || দশচক্র || সিদ্ধার্থ সিংহ ।। পর্ব ৬
সানন্দায় ছাপা হয়েছিল ঋজুর ‘বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল’। সেই গল্পটার নাট্যরূপ দিয়ে এর আগে শিশির মঞ্চে নাটক করেছিল বিশ্ব ও শিল্পী সাংস্কৃতিক সংস্থার সর্বময়কর্তা সত্যজিত্ কোটাল। একদিন সে এসে জানাল, তারা আবার ওই নাটকটা করছে। স্টেজ রিহার্সালের জন্য বুক করা হয়ে গেছে মুক্তাঙ্গন। আগের শো-টার স্ক্রিপ্ট একটু অদলবদল করা হয়েছে। ওই দিন আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে…
ঋজু জিজ্ঞেস করল, কখন?
সে বলল, আমরা তো বারোটা-সাড়ে বারোটার মধ্যে ঢুকে পড়ব। ওই দিন কোনও শো নেই। আমরা সারা দিনই থাকব।
ঋজু বলল, সারা দিন!
রিহার্সালের জন্য আর কতক্ষণ লাগে! বিকেলের মধ্যে যদি ওটা সেরে নেওয়া যায়, তা হলে তো সন্ধে থেকে একটা অনুষ্ঠান করা যায়। তাই না? কিন্তু কী অনুষ্ঠান! কী অনুষ্ঠান! কী অনুষ্ঠান! ঋজু নিজেই বলল, ধরো, আমার একটা গল্পের নাট্যরূপ দিয়ে দিলে তুমি। সেটা মঞ্চস্থ হল…
— এত তাড়াতাড়ি নাটক তোলা যাবে না দাদা…
— তা হলে… তা হলে… তা হলে… একটা কাজ করো, নাটক না তুলতে পারো, শ্রুতিনাটক তো তুলতে পারবে, না কি?
— হ্যাঁ, সেটা পারব।
— তা হলে শ্রুতিনাটকই করো। তার পর ধরো, কয়েকটা বাচ্চা আমার কিছু কবিতা আবৃত্তি করল। আমার উপরে দু’-একজন কিছু বলল…
— কে বলবে?
— বিখ্যাত কেউ। যেমন ধরো প্রদীপ ঘোষ…
— কোন প্রদীপ ঘোষ? আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ?
— হ্যাঁ।
— আসবেন?
— ওটা আমার উপরে ছেড়ে দাও।
— আর?
— পি সি সরকার।
— উনি তো মারা গেছেন।
— না না, তিনি নন। জুনিয়ার পি সি সরকার।
— আনতে পারবেন?
— চেষ্টা করে দেখি।
— আর?
— আর ধরো পবিত্র সরকার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, দিব্যেন্দু পালিত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও বলব। তার পর তুমি বলবে।
সত্যজিত্ বলল, আপনি যদি পাশে থাকেন, সে তো করাই যায়। কিন্তু অনুষ্ঠানের নাম কী দেবো?
— সেটা ভেবেচিন্তে ঠিক করা যাবেখ’ন।
— না, আসলে দলের সবাইকে বলতে হবে তো…
— আমি জানি। দলটল নয়, তোমার কথাই শেষ কথা।
— তাও।
তিন চারটে নাম লিখে রেখেছিল ঋজু। সত্যজিৎও ভেবে রেখেছিল দুটো নাম। অবশেষে ঠিক হল, অনুষ্ঠানটার নাম দেওয়া হবে ঊষা উত্থুপ নাইট, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কিংবা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার অনুকরণে— ঋজু সন্ধ্যা।
ঠিক হয়ে গেল কী কী হবে। কাকে কাকে বলা হবে। সমস্ত মিডিয়াগুলিতে অন্তত এক সপ্তাহ আগেই আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দিতে হবে। তার ম্যাটার কী হবে, মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ড জুড়ে থার্মোকল কেটে বড় বড় অক্ষরে যে ‘ঋজু সন্ধ্যা’ লেখা হবে, সেটা স্পনসরড করার জন্য ঋজুই বলে দিল কমলকে। কমল ওর ছোটবেলাকার বন্ধু। কুলিশ নামে একটি অনিয়মিত ছোট্ট পত্রিকা বার করে। পোস্টার করার জন্য বৈঠকখানা বাজার থেকে ওজন দরে এ ফোর সাইজের মতো রঙিন কাগজের ছাট আনার দায়িত্ব নিয়ে নিল সত্যজিত্ নিজেই। ও-সব জায়গা ও খুব ভাল করে চেনে। ওর বাবার একটা ছোট প্রেস আছে। সেই সূত্রে ওকে প্রায়ই ওখানে যেতে হয়। ওরা দু’ভাই এখন ওটা চালায়। ওর ভাইও নাটক করে। এটা নাকি ওরা পেয়েছে ওদের বাবার কাছ থেকে। ওদের বাবাও নাটক করতেন।
— ওই অনুষ্ঠানে আসার জন্য ঋজু সবাইকে ফোন করে করে বলছে। ফোন করল কণিকাকেও।
ওই ঘটনার ক’দিন পরেই সানন্দায় ছাপা হয়েছিল— মণিপর্ব ২৫। কণিকার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে ওকে নিয়ে অনেকগুলি কবিতা লিখেছিল ঋজু। কণিকা ছিল ওর চোখের মণি, আবার মণিমাণিক্যের মতোই মূল্যবান। তাই ওকে নিয়ে লেখা কবিতা সিরিজটার নাম দিয়েছিল— মণিপর্ব।
ঋজুদের বারুইপুরের বাগানবাড়িতে একটা মন্দির আছে। ত্রিমাতৃ মন্দির। ওর মায়ের তৈরি। সেই মন্দিরে কালী, মনসা আর শেতলার মূর্তি আছে। মহাধুমধাম করে পুজো হয়। শেতলা পুজোতে আসার জন্য কণিকাকে নেমন্ত্রন্ন করেছিল ও। কণিকাও বলেছিল, আসবে। কিন্তু শিয়ালদহ থেকে যে ট্রেন ধরে ওর আসার কথা, তার পরের ট্রেনেও ও না-আসায় বড় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল ঋজু। লিখে ফেলেছিল পঁচিশতম কবিতা— মণিপর্ব ২৫।
সেটাই সানন্দায় ছাপার জন্য মল্লিকা সেনগুপ্তকে দিয়েছিল ও। কণিকা শুনে বলেছিল, যে দিন মণিপর্ব প্রথম বেরোবে, সে দিন আমি সেলিব্রেট করব। তোমাকে বড় কোনও হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়াব।
অথচ সেই কবিতাটা বেরিয়েছে তিন দিন হয়ে গেছে। ও কি দেখেনি! না, জানে না! অফিস থেকে বেরোবার সময় দেখে, দেয়াল ঘড়িতে বারোটা কুড়ি। ড্রপ কার দিতে দিতে আরও দশ মিনিট। প্রথমে সব লং রুটের দেবে। তার পরে শর্ট রুটের। একদম শেষের দিকে দেয় বেহালার গাড়ি। ও ওই গাড়িতেই ওঠে। ওকে চেতলায় নামিয়ে দিয়ে যায়। হাতে এখনও প্রচুর সময়! ও কি জেগে আছে! এক বার দেখব! বেরোতে গিয়েও, কী এক অমোঘ টানে ও টপাটপ বোতাম টিপল ফোনের। কণিকাই ধরল। বুঝতে পেরেই ঋজু বলল— মণিপর্ব বেরিয়েছে তিন দিন হয়ে গেছে। যাকে নিয়ে মণিপর্ব লেখা, সেই মেয়েটি বলেছিল, প্রথম যে দিন মণিপর্ব বেরোবে সে আমাকে খাওয়াবে। অন্য কিছু না খাওয়াক, এক কাপ চা তো খাওয়াতে পারে। সে কি খাওয়াবে?
কোনও কথা নয়। ঋজু শুধু শুনেছিল, টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে কণিকার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। সে দিন সাড়ে বারোটা নয়, একটা পনেরোরও নয়, আড়াইটের গাড়ি ধরেছিল ঋজু। তাও দৌড়ে গিয়ে। আর কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে ওই গাড়িটাও বেরিয়ে যেত।
পর দিন তিনটের সময় ঋজু চলে গিয়েছিল ওর অফিসে। টেলিফোন ভবনের উল্টো দিকে লাইম লাইট রেস্টুরেন্টে ওরা বসেছিল । চা খেতে খেতে কণিকা বলেছিল, আমি অরুণকে বলে দিয়েছি, ঋজু আমাকে ভীষণ ভালবাসে। আমাকে ছাড়া ও বাঁচবে না। আমি ওকে ফেরাতে পারব না।
তারপর থেকে আবার যাতায়াত। এখানে যাওয়া। সেখানে যাওয়া। কোথায় সুন্দরবনের জ্যোতিষপুর হাইস্কুলের হীরক জয়ন্তী উত্সব, কোথায় ঝাড়খন্ডের সেরাইকেলায় বিশাল অনুষ্ঠান, কোথায় বাঁকুড়ার সোনামুখীতে লগ্নঊষার বার্ষিক বনভোজন, সব জায়গাতেই ওরা। একদিন কফি হাউসের সামনে ওর পুরোনো বন্ধু ভাস্কর দেবের সঙ্গে দেখা। সে নাকি নতুন একটা ট্যুর এজেন্সি খুলেছে। সামনের মাসেই সাংস্কৃতিক দল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছে। সে বলল, যাবি? ঋজু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। দু’জনের জন্য পাঁচ-পাঁচ দশ হাজার টাকা দিয়ে কণিকাকে নিয়ে ও চলে গেল ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার।
এর মধ্যে কণিকা একদিন বলেছিল, বহু দিন আগে প্রতিদিন-এ একটা গল্প পাঠিয়েছিলাম। কী হল, খবর পেলাম না। ওখানে তোমার কোনও জানাশোনা আছে?
ঋজু বলেছিল, কোন পাতায়?
— শনিবারে যে গল্প বেরোয়, সেখানে।
— কপি আছে?
— জেরক্স আছে।
— তা হলে নিয়ে এসো। কাল তোমার অফিস ছুটির পর তোমাকে নিয়ে প্রতিদিনে যাব।
ওই পাতার বিভাগীয় সম্পাদক সুদেষ্ণা রায়। যিনি এক সময় সানন্দায় ছিলেন। পরে প্রতিদিন-এ যান। কণিকাকে দেখিয়ে ঋজু বলল, ওর একটা গল্প দিয়ে গেলাম, একটু দেখো তো।
সুদেষ্ণা জিজ্ঞেস করলেন, তুই পড়েছিস?
— হ্যাঁ।
— ঠিক আছে?
— হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভাল গল্প। ঋজু কথা বলছে ঠিকই। কিন্তু ওর চোখ সুদেষ্ণার হাতের দিকে। লেখাটার উপরে গল্পের নাম, লেখকের নাম এবং বডি পয়েন্ট মার্ক করতে করতেই সুদেষ্ণা বললেন, এই নামেই চেক হবে তো?
ঋজু বলল, হ্যাঁ।
সেই শনিবারেই কণিকার গল্পটা ছাপা হয়ে গেল। এর ক’দিন পরেই কণিকা বলল, তোমাদের অফিসে যে সুমন চট্টোপাধ্যায় আছেন না, তাঁর সঙ্গে আমার একটু আলাপ করিয়ে দেবে?
— সুমন চট্টোপাধ্যায়! ঋজু আমতা আমতা করতে লাগল। অনেকেই মহাধন্দে। কে বড়? আনন্দবাজার না সুমন চট্টোপাধ্যায়! যাঁর নামে এক ঘাটে বাঘে আর হরিণে জল খায়, সেই সুমন চট্টোপাধ্যায়!
— দাও না গো, খুব দরকার।
— কী দরকার বলো না, আমি আগে এক বার বলে দেখি…
— না না, তুমি বললে হবে না। তুমি আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও, যা বলার আমিই বলব।
ঋজু জানে, ও যা চায়। তা না করলেই ওর মুখ ভারী হয়ে যায়। ঠিক মতো কথা বলে না। ফোন করলে ধরে না। ল্যান্ড লাইনে ফোন করলে মেয়েরা বলে, মা নেই। কিংবা বলে, ও দিকে কাজ করছে।
সে দিনই সন্ধেবেলায় করিডর দিয়ে যেতে যেতে সুমন বললেন, কাকে নিয়ে এসেছিলি? ওর অফিসের কোন এক বসের ছেলে নাকি এখানে গ্রুপ ফোরে কাজ করে। তার হয়ে বলতে এসেছিল। তাকে যাতে আনন্দবাজারে নিয়ে নিই। এ ভাবে হয় নাকি? তুই জানিস না?
তার ক’দিন পরেই কণিকা বলল, তোমার সঙ্গে কে এম ডি-র কারও সঙ্গে যোগাযোগ আছে গো?
— কেন? প্রশ্ন করতেই ও বলল, রাজারহাটে যদি একটা প্লট পাওয়া যায়, দেখো না, আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে থাকব…
ঋজু দেখেছে, দূরে কোথাও যাবার কথা হলে কিংবা রবিবার খাওয়াদাওয়ার পরেই শুতে যাবার আগে কণিকা কোনও না কোনও আবদার করে। ঋজু আমতা আমতা করলেই, তক্ষুনি কোনও মেয়েকে এ ঘরে ডেকে নেয় কণিকা। কিংবা টিভিতে কোনও সিনেমা চালিয়ে দেয়। আদর করতে গেলেই বলে, বিরক্ত কোরো না। সিনেমা দেখছি।
কিছু দিন আগে ‘চলমান শিল্প আন্দোলন’-এর তরফ থেকে কর্পোরেশন বিল্ডিংয়ের পেছনে, নিউ মার্কেটের চ্যাপলিন স্কোয়ারে আয়োজন করা হয়েছিল তিন দিন ব্যাপি এক চিত্রপ্রদর্শনী। তার সঙ্গে ছিল কবিতা পাঠের আসর। সেখানে যেমন বিভিন্ন নামী-অনামী শিল্পীরা যোগ দিয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন নানান বয়সের কবিরাও।
ওখানে আমন্ত্রিত হয়েছিল ঋজু। চিঠি পাওয়ামাত্র উদ্যোক্তাদের বলে-কয়ে কণিকার নামটাও কবিদের তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আজকাল যেখানেই ওদের কবিতা ছাপা হয়, একই পাতায় পাশাপাশি ছাপা হয়। লেখালিখির জগতের প্রায় সকলেই ওদের কথা জেনে গেছে।
লক্ষ্মণ শেঠের বউ তমালিকা পন্ডা শেঠ কয়েক বছর ধরে হলদিয়ায় যে বিশ্ব বাংলা কবিতা উত্সব করছে, সেখানে প্রথম বছর থেকেই ঋজু যায়। উত্সব কমিটির সম্পাদক শ্যামলকান্তি দাশকে ধরে সেখানেও ওর কবিতা পাঠের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ঋজু। ওখানে পৌঁছনোর পরে ও ছুঁক ছুঁক করছিল কোথাও ঘর পাওয়া যায় কি না। কিন্তু কাকে বলবে সে! রিসেপশন কাউন্টারে খুব মাতব্বরি করছিল একটি ছেলে। আশিস মিশ্র। তাকে বলতে যাবার আগেই দেখে, উদ্যোক্তারা ওদের থাকার জন্য আকাশদ্বীপ হোটেলে একটা ঘর বরাদ্দ করে রেখেছে।
চলমান শিল্প আন্দোলন-এর অনুষ্ঠানেও একই দিনে ওদের দু’জনের কবিতা পড়ার কথা। কণিকাকে নিয়ে ঢুকতেই ঋজু দেখল, মাঠের এক পাশে কিছু চেয়ার নিয়ে মিহির, গণেশ, রফিক, দিশা ছাড়াও আরও কয়েক জন দল বেঁধে আড্ডা মারছে। ওরাও ওদের সঙ্গে বসে পড়ল। হঠাত্ একজন এসে ঋজুকে বলল, আপনাকে অভিজিৎদা ডাকছে। অভিজিৎদা মানে অভিজিৎ ঘোষ। যার সম্পাদিত সৈনিকের ডায়েরিতে ওর প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা তিনিই। সঙ্গে সঙ্গে ঋজু চলে গেল সেখানে। জড়িয়ে ধরল অভিজিৎকে। দু’-চার কথার পরেই উনি বললেন, তোর সঙ্গে যে মেয়েটি ঢুকল, কণিকা না?
— হ্যাঁ, তুমি চেনো নাকি?
— ও তো আগে আব
ধারাবাহিক একটি রিয়্যালিটি উপন্যাস || দশচক্র || সিদ্ধার্থ সিংহ ।। পর্ব ৬ ঃ লেখক, গল্পকার, ভারত
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান