লেখালেখি

অমর একুশে আট ফাল্গুন

অমর-একুশে-আট-ফাল্গুন

অমর একুশে আট ফাল্গুন ।। ৮ই ফাল্গুন, ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ, বৃহস্পতিবার, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দ – এই দিনটি ছিল শুধুই বাঙ্গালীর, ছিল আমাদের স্বাধীনতার উৎস, ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শাণিত বাঙ্গালী জাতিসত্বার এক প্রমত্ত ও অমিত দুর্বার বোধ; ছিল মায়ের মুখের ভাষায় লালিত ও অপরিমেয় প্রকাশ শক্তিতে উদ্বেল এক বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রাণময়তায় অনন্য নিঃশর্ত এক দাবী। অমর ভাষা আন্দোলনের মহান ৮ই ফাল্গুনই তো আমাদের চেতনার অমর একুশে, ৮ই ফাল্গুন হচ্ছে ২১শে এবং ২১শে হচ্ছে ৮ই ফাল্গুন। মুক্তবুদ্ধি, চেতনা আর বিবেকে লালিত এই ৮ই বা ২১শে-কে আমরা ভুলতে পারি না, ভুলতে পারে না আমাদের অতন্দ্র প্রজন্ম।

আবহমানকালের অনন্য শৌর্য-বীর্যে লালিত স্বয়ংস¤পূর্ণ বাঙ্গালী জাতিসত্ত¡ার স্বীকৃতি আজ বিশ্বে তুলনারহিত, নানান বাধা-বিঘ্ন  সাংঘর্ষিক প্রতিরোধ আর হিংস্র প্রতিক‚লতাসহ বিবিধ আগ্রাসন-অভিযানের শিকার হয়েও ফল্গুধারার মতো অস্তিত্ব রক্ষা করে বাঙ্গালী জাতি, বাংলাভাষা এবং বাংলাদেশ তার হার্দিক স্বাতন্ত্রের স্বমহিমতার অনুপুঙ্খ মহিমাকেই শুচিস্নিগ্ধ চেতনায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।

উল্লেখ্য যে, আমাদের বাংলাদেশ-ভাষা-জাতিসত্ত¡াকে নিয়ে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই লড়তে হয়েছে দেশী-বিদেশী হিংস্র-লোভী-হায়েনাদের সাথে; তাতেও কিন্তু দমে-থেমে না গিয়েও, নানান আকার-প্রকারের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এসেছি ‘ আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয় ’-এর মতো সত্যকে হৃদয়, মনন, বুদ্ধি, চিন্তন-চেতনায় গ্রহণ এবং লালনসহ সজ্ঞানে আত্মস্থ আর অনুধাবন করে, সৃষ্টিসুখের উল্লাসেই। আদিমতম অকৃত্রিম জিগীষার হৃদ্যতায় দৃপ্ত ও লালিত ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, কৃষিভিত্তিক, সাংস্কৃতিক এবং নৃ-তাত্তিক সাযুজ্যকে সম্পূন্ন-স¤পূর্ণ করতে যত্ববান থাকতে হবে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী ও জাতিকে। একবিংশ শতকের বিজ্ঞান-বীক্ষণ ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ প্রভাবেই আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভ‚-রাজনীতির শুদ্ধ সমীকরণে রাজনীতি থেকে ধর্মতান্ত্রিক ও সা¤প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে কথা-কাজে বিচার করার উদ্দ্যোগ গ্রহণ করার সময় এসেছে। সুন্দর ও মহতি কর্মধারায় অতীতের সদিচ্ছাগুলো বাঙময় হয়ে দীপ্ত-দৃপ্ত করে তুলেছে সবুজ জমিনের বুকে লাঞ্ছিত প্রদীপ্ত সূর্যের আলোক রশ্মিতে স্বয়ংসিদ্ধ পতাকার অমিয় ¯িœগ্ধতায় ‘আমি তোমায় ভালবাসি’ -এর অমায়িকতায়।

মহান ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিকাশে সবাইকে একতাবদ্ধ করেছে বলেই ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের প্রতি দেশটির পূর্ব অংশের জনগণের মোহ কেটে যেতে থাকে খুব তাড়াতাড়ি। তখনই বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সহজে উপলব্ধি করতে পেরেছে নিজস্ব জাতিসত্ত¡া সৃষ্টিতে ভাষা-সংস্কৃতির সম্পর্ক, গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে অনেক বেশী স্পষ্ট করে। বাঙ্গালী হিসেবে গুরুত্ববহ এই আত্মপরিচয়েই তাঁদের রাজনীতি, শিক্ষা, সমাজ-সংস্কৃতি এবং নিজস্ব অর্থনীতি গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় এবং তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে মানসিক শক্তি অর্জন করে; ভাষা ভিত্তিক এহেন একাত্মবোধই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের অমোঘ শক্তিকে বীর্যবন্ত করেছে যা’ পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অনন্য ও অনবদ্য ইতিহাস রচনা করেছে। তবে সেই দাম চুকিয়েছে শুরু থেকেই টকবগে রক্ত দিয়ে পূর্ব বাংলার অতন্দ্র ছাত্রসমাজ।

আসলে বাঙালী জাতিসত্বাকে যাঁরা সহনশীল বলে মনে করেছেন, যাঁরা বাংলার আলো-বাতাসকে ভেবেছেন একান্ত দৈবের, যাঁরা গ্রামীন প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিশাল সহজ ও সরল অর্ধ ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চিন্তায় ছেলেন-আছেন-থাকছেন, যাঁরা কেবলই আত্মস্বার্থ-রক্ষায় নিজেদের চতুরতাকে বিশেষ কৌশলে ব্যবহার করে বাংলার জনতাকে বিভক্ত করে পরস্পরের বিরুদ্ধে ধর্ম, অঞ্চল, সম্প্রদায় ইত্যাদির বদৌলতে আক্রমণাত্মক করে তুলছেন, তাঁরা জানেন না-জানেননি-জানবেনও না যে, পলল বিধৌত এই বাংলার সমস্ত সত্বায় রয়েছে এক প্রমত্ততা, প্রচন্ডতা, ভয়াবহতা – যা ঠিক ভাবেই সঠিক জায়গায় আঘাত হেনে প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিপক্ষের সবধরণের গর্ব, দম্ভ আর অহংকারকে চ‚র্ণ-বিচ‚র্ণ করে নিজের অস্তিত্বকে ঠিকই বিপন্ন হতে দেয়না।

“এ পর্যন্ত আমরা ফুটো কলসে জল ভরাকেই কাজ বলিয়া জানিয়াছি, সেই জন্য বারবার আক্ষেপ করিয়াছি – এদেশে কাজ করিয়া সিদ্ধিলাভ হয় না। বিজ্ঞান সভায় ইংরেজী ভাষায় পুরাতন বিষয়ের পুনরুক্তি করিয়াছি, অথচ আশ্চর্য হইয়া বলিয়াছি, দেশের লোক আমার বিজ্ঞান সভার প্রতি এরূপ উদাসীন কেন? ইংরেজী ভাষার গুটি কয়েক শিক্ষিত লোক মিলিয়া রেজুলেশান পাস করিয়াছি, অথচ দুঃখ করিয়াছি জনসাধারণের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কর্তব্যবোধের উদ্রেক হইতেছে না কেন? পরের নিকট প্রার্থনা করাকেই কষ্ট বলিয়া গৌরব করিয়াছি, তারপর পরকে নিন্দা করিয়া বলিতেছি, এত কাজ করি তাহার পারিশ্রমিক পাইনা কেন’’ ?
– রবীন্দ্র রচনাবলী, ২য় খন্ড, পৃ: ৬৫৭।

উপমহাদেশের বিভক্তিকাল থেকেই আমাদের সংস্কৃতিবান বিদগ্ধজনেরা জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের পরিকল্পনায় অনেকটা সন্দেহ ও সংশয়ের মধ্যেই ছিলেন, কারণ দ্বি-জাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে ভারত ও পাকিন্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও তার শুরুটি হয়েছিল অনেক আগেই। মূলতঃ বেনিয়া ইষ্ট ইঙ্গিয়া কো¤পানীর স্বার্থে ইংরেজ শাসকদের ষড়যন্ত্রে ১৯০৫ সালের বঙ্গ-ভঙ্গ থেকে নিখুঁত ভাবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অনুসারে উপমহাদেশকে ‘শাসন কর এবং ভাগ কর’ রীতিতে দেড়-হাজার মাইলের ভৌগোলিক ব্যবধানের দূরত্বের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থানও বিভিন্ন কারণেই তাঁদের কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। নানান ধরণ ও গড়নের ভাষা-ভাষীকে সাথে নিয়ে বিশাল দূরত্বের অবস্থানে সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড, নেতৃত্ব দান, দূরদর্শীতা, দিক নির্দেশনা, সুষ্ঠ‚ পরিকল্পনা প্রভৃতি নিয়েও যথেষ্ট দ্বিধা, দ্ব›দ্ব, ভীতি, নৈরাশ্য অন্ততঃ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চিন্তক, বুদ্ধিজীবি ও রাজনীতিবিদদের ভাবনা, চিন্তন, বুদ্ধি ও মননকে সংকট-বিহবলতাকে জন্ম দিয়ে অভাবিতভাবে দোলা দিয়েছিল।

বলা বাহুল্য প্রাচীনকাল থেকে অত্যন্ত সযতেœ আমাদের ইতিহাস নিয়ে বাংলা ও বাঙ্গালী বিদ্বেষীদের চক্রান্তের তান্ডবে হিংসা-দ্বেষের নোংরা ঘটনাবলির মাধ্যমে কি মিলেছে ? মিলেছে সা¤্রাজ্যবাদ আর উপনিবেশবাদী ক্রীড়নকদের ব্যর্থতার গøানিতে বিপর্যস্তদের ইচ্ছা-কাহিনীর নবতর চেহারা, চরিত্র ও আঙ্গিকের যথার্থ ক্লেদাক্ত ইতিহাস। নানান আকারের বেশী-বিদেশী অভিযান-অভ্যুত্থান, হানা-আক্রমণ এবং গৎবাঁধা শোষণ-নিপীড়ন ইত্যাদির গমকে বঙ্গ-বাংলাকে রাজনীতি আর শাসনের অহংকারে ক্ষত-বিক্ষত ও খÐ-বিখÐ করা হয়েছে। বেনিয়াদের একটানা প্রায় আড়াইশ’ বছরের সুশাসনের (!) শেষার্ধে বঙ্গ-ভঙ্গের নামে একটি ঐতিহ্যবাহী শান্তিপ্রিয় জাতিকে ধর্মের মোহে দ্বি-জাতিতত্তে¡র আবরণে বিভিন্ন ভাবে ও ভাগে পৃথক করে কার, কি, কতটা এবং কোন প্রকারের ফায়দা হলো বা হয়েছে, ইতিহাস তার সাক্ষ্য অবশ্যই দেবে। অথচ, আমাদের বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলাকালেই অভাবনীয় ভাবে বুঝা গেছেঃ
“ভাষা আন্দোলন এক দিক দিয়ে ছিল সামস্তবাদ বিরোধী, অন্যদিকে উপনিবেশবাদ বিরোধীও। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের চিন্তা সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই ধর্মের স্থলে ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার যে সম্মিলিত উদ্যোগ, তাতে উদ্দেশ্য ছিল সামন্ততান্ত্রিকতার বাইরে চলে আসা। পক্ষান্তরে, বিদেশী ভাষার আধিপতাকে মেনে না নেয়ার যে চেতনা তা উপনিবেশবাদ বিরোধী। এ দেশের শিক্ষিত বাঙালী তরুণরা যেমন চায়নি ধর্মের নামে শোষণকে, তেমনি বিরোধিতা করেছে উপনিবেশবাদ তথা সা¤্রাজ্যবাদের। সুতরাং ভাষা আন্দোলন যুগপৎ জনগনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রয়োজনে উদ্ভুত হয়েছিল। অর্থাৎ, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালীরা দেশীয় সামন্তবাদ এবং বহির্দেশীয় উপনিবেশবাদ – উভয়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেছিল। এ দু’মুখো বিরুদ্ধতার টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ ঘটেছে।”
– রাষ্ট্রভাষা থেকে বিশ্বমাতৃভাষা, গোলাম শায়িক, দৈনিক মুক্তকণ্ঠ, ২১শে ফেব্রæয়ারি, ২০০০; পৃ – ১৪।

অনেকে প্রশ্ন করেন – ২১শে ফেব্রুয়ারি কেন ? আটই ফাল্গুন বলতে দোষ কি ? অনেকেই তাই রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মত্যাগের এই মহিমাময় দিনটিকে একুশে ফেব্রæয়ারি হিসেবে ব্যবহার রদ না করেও করে আটই ফাল্গুনের ব্যবহারিক প্রয়োগের পক্ষে সায় দিচ্ছেন। তাঁদের কেউ-ই কিন্তু দুটো পৃথক বর্ষপঞ্জির অর্থাৎ খৃষ্টাব্দ ও বঙ্গাব্দের বর্ষ গণনারীতির প্রয়োগরীতিকে চিন্তা করে এহেন বক্তব্য রাখছেন না। মূলতঃ এই উভয় বর্ষপঞ্জির গণনাপদ্ধতির বৈচিত্রেই প্রতিবছর আটই ফাল্গুন ২১শে ফেব্রুয়ারি হচ্ছে না। সাদামাটাভাবে এ সত্যটুকুই বাস্তব যে, প্রতিটি ৮ই ফাল্গুনই যেমন একুশে ফেব্রæয়ারি হচ্ছে না, তেমনি প্রতিটি একুশে ফেব্রæয়ারিও ৮ই ফাল্গুন হচ্ছে না। অথচ অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই জিজ্ঞাসা জাগে, একুশে ফেব্রুয়ারি হতে পারলে ৮ই ফাল্গুন হতে পারবে না কেন? কেন ২১শে ফেব্রæয়ারী ৭ই বা ৯ই ফাল্গুন হবে? কিন্তু, বিপত্তিটা যে খৃষ্টাব্দ-বঙ্গাব্দের বর্তমান গণনারীতির বর্ষপঞ্জিতে রয়েছে, একুটু ভাবছেন না কেউ-ই। বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধন করেও বরাবর ও সঠিক দিন মিলছে না। কিন্তু, কেন এমনটি হচ্ছে না ? ৮ই ফাল্গুনের চেয়ে একুশে ফেব্রæয়ারির পরিচিতি যে ব্যাপক এবং তৎকালীন বৈশ্বিক পরিমন্ডলে ৮ই ফাল্গুনের চাইতে ২১শে ফেব্রুয়ারির পরিচিতিই ছিল বেশী, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তার মূল ও মুখ্য কারণই হচ্ছে আন্তর্জাতিক বর্ষপঞ্জি গণনারীতি। খৃষ্টাব্দ বা ঈসায়ীসন বা মসীহ্সাল আন্তর্জাতিকভাবে বহুল পরিচিত ও সমাদৃত। বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন আন্তর্জাতিক নিরিখে ততটা আদৃত নয় এবং বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জি গণনামতেও তার তেমন পরিচিতি বা ব্যবহার নেই। ফলে বাংলা আটই ফাল্গুনের চাইতে বেশী ব্যবহৃত হতে পেরেছে ২১শে ফেব্রুয়ারি। খৃষ্টাব্দের সাথে বঙ্গাব্দের অভিন্ন বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন ও প্রচলন না করা পর্যন্ত এমন বিভ্রান্তি থাকবেই।

তাছাড়া তৎকালীন পাকিস্তানী বর্ষ গণনারীতিতে আন্তর্জাতিক মানের বর্ষপঞ্জি হিসেবে খৃষ্টাব্দের গণনাপদ্ধতিই ছিল স্বীকৃত। উল্লেখ্য পাকিস্তানের আলাদা কোনো বর্ষপঞ্জি ছিল না, আবার আমাদের বাংলা বর্ষপঞ্জিও ত্রæটিমুক্ত ছিল না। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন স্তব্ধ করার পৈশাচিক ঘটনাবলীতে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত হতে পেরেছে খৃষ্টাব্দ, বঙ্গাব্দ নয়। খৃষ্টাব্দ ও বঙ্গাব্দ গণনারীতিতেই পদ্ধতিগত পার্থক্য বজায় রেখেছে বলেই প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি ৮ই ফাল্গুন থাকছে না। দুটো সনই সৌরমানে গণিত হলেও মূলতঃ কাঠামো ও পদ্ধতিতে তারা পৃথক হওয়ার ফলেই কেবল ২১শে ফেব্রুয়ারি নয়, ১লা মে, ২৬শে মার্চ, ১লা বৈশাখ, ২৫শে বৈশাখ, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১লা জানুয়ারী ইত্যাদি তারিখ একেক বছর খৃষ্টাব্দ ও বঙ্গাব্দ গণনায় একেক অর্থাৎ একই না থেকে বিভিন্ন হয়ে থাকে। অবশ্য বেশ কিছু সংস্কার-সংশোধনীতে বাংলা বর্ষপঞ্জির কিছুটা উন্নতি করা হয়েছে। এতে কিছুটা মাত্র ইতিবাচক লক্ষণ দেখা গেলেও, সমস্যা থেকেই গেলো। তাই সহজ ও রীতিঋদ্ধ বাংলা বর্ষপঞ্জি এখনো পচলিত হতে পারেনি। ৮ই ফাল্গুনকে ২১শে ফেব্রুয়ারি হিসেবে গণনা করতে হলে প্রয়োজন বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের। আর এমনটা করা দুরূহ একটি কিছু নয়। খৃষ্টাব্দ বর্তমান আকৃতি লাভ করেছে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় মাত্র দশটি সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৯৯ সাল থেকে মহান ও অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হবার বিরল সম্মান লাভ করেছে। অথচ আমাদের সরকারী গণনা মতে ২১শে ফেব্রæয়ারি এই বছরও ৯ই ফাল্গুন হচ্ছে, ৮ই ফাল্গুন নয়। এই ৮ই ফাল্গুনকে ২১শে ফেব্রুয়ারী হিসেবে গণনারীতি চালু করতে হলে সরকারী উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য ও বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জিরও যথার্থ সংশোধনী অনিবার্য এবং বিশেষ নির্দেশে গণনারীতি চালুর ব্যবস্থা করাও অবধারিত বলে বিবেচনা করতে হবে। স্মর্তব্য, প্রথম বিশ্বমাতৃভাষা দিবসে ২১ পেলেও ৮ কে পেলাম না আমরা।

অমর একুশে আট ফাল্গুন, আটই ফাল্গুনই যে একুশে ফেব্রুয়ারি, এ সত্যটাকে আমরা নিম্নবর্ণিত বক্তব্য অনুসারে উপস্থাপন করছি। অবশ্য এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বর্তমানে যেভাবে বঙ্গাব্দের গণনারীতি প্রচলিত রয়েছে, বিজ্ঞান ও যুক্তিগ্রাহ্য একটি বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তিত না হলে আটই ফাল্গুন আর একুশে ফেব্রুয়ারি একটি বছরে একই দিনে পাওয়া যাবেনা এবং পরবর্তী বছরগুলোতেও তার ব্যতিক্রম হবে না। আরও উল্লেখ্য যে, খৃষ্টাব্দের সাথে স্থির, বরাবর ও অভিন্ন বাংলা তারিখের জন্য বর্ষপঞ্জি প্রণয়নও খুব একটা দুরূহ কিছু নয়, যা আমরা পরে আলোচনা করছি। খ্রিষ্টাব্দ ও বঙ্গাব্দ প্রস্তাবিত এই উভয় সনের মধ্যে একটা যোগসূত্র রেখে বঙ্গাব্দকেও আন্তর্জাতিক বর্ষ গণনারীতিতে গণিত ও স্বীকৃত করে তুলতে আলোচ্য অভিন্ন বাংলা বর্ষপঞ্জি অনায়াসেই আমাদেরে বিতর্কের ঊর্ধে রাখতে পারছে।

উল্লেখ করা উচিৎ যে খৃষ্টাব্দের গণনারীতির সাথে মিল রেখে বঙ্গাব্দের গণনাপদ্ধতি প্রচলন করতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা একাডেমীর ব্যবস্থাপনায় সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জির বদলে একটি উপসংঘের মাধ্যমে বর্ষপঞ্জি সংস্কার করেন। অবশ্য ১৪০৪ বঙ্গাব্দ থেকে সরকার বাংলা একাডেমী কর্তৃক সংস্কার করা বাংলা বর্ষপঞ্জিই অনুসরণ ও ব্যবহার করার নির্দেশ দান করেছেন। তাতেও কিন্তু সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি। সংস্কার করা ও সংশোধিত বাংলা বর্ষপঞ্জি গণনা অনুসারেও আমাদের জাতীয় দিবসগুলোর খৃষ্টাব্দ ও বঙ্গাব্দের বর্ষপঞ্জির দিন-তারিখ সমান বা অভিন্ন কিংবা বরাবর অথবা সঠিক বা একই থাকছে না। ফলে আমাদের ৮ই ফাল্গুন যেমন ২১শে ফেব্রæয়ারি হচ্ছে না, তেমনি ২১শে ফেব্রুয়ারিও ৮ই ফাল্গুন হচ্ছে না। প্রমাণ হিসেবে ১৪০৪ বাংলার ৯ই ফাল্গুনকেই আমরা পাচ্ছি ২১শে ফেব্রæয়ারি হিসেবে। বলা প্রয়োজন যে, শহীদুল্লাহ সাহেবের ছেলে তকীয়ুল্লাহ সাহেবও শহীদুল্লাহ স্মৃতি সংসদের নামে পৃথক বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রচলন করেছেন খৃষ্টাব্দ ও বঙ্গাব্দের তারিখের মধ্যে সমতা আনতে। বলা বাহুল্য, তার গণনামতেও আমাদের জাতীয় দিবসের দিনগুলো অভিন্ন থাকছে না। তার গণনা অনুসারে কেবল ৮ই ফাল্গুনই ২১শে ফেব্রুয়ারি হয়েছে বটে, তবে অন্য কোন জাতীয় দিবসের এবং মাসের কাংখিত প্রয়োজনীয় ও উল্লেখ্য কোনো মিলও নেই। আমাদের সনাতন বর্ষপঞ্জিকে সংশোধন করে বাংলা একাডেমীর উপসংঘ, শহীদুল্লাহ স্মৃতি সংসদ ইত্যাদি ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ৮ই ফাল্গুনকে সাতটি সংস্কার-সংশোধনীর পরেও অব্যর্থ, অভিন্ন, নিরাপদ ও নিশ্চিত রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই আমরা ৮-এ ২১কে পাই না, এবং ২১-এও ৮কে পাই না।

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বলতে সহজেই আমরা বুঝে থাকি একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতেই ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে আত্মদান করেন আমাদের দামাল সূর্যসন্তানেরা। ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৮ই ফাল্গুন, বৃহস্পতিবারই ছিল ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। আমাদের বাংলা বর্ষপঞ্জি গণনারীতিতে খৃষ্টাব্দের গণনাপদ্ধতি বরাবর ও স্থির হয় না বলেই আমরা প্রতি বছর খৃষ্টাব্দ ও বঙ্গাব্দে ৮ই ফাল্গুনকে ২১শে ফেব্রুয়ারি হিসেবে পাই না। কোনও বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি ৮ই ফাল্গুন হলেও কোন কোন বছর তা আবার ৭ই অথবা ৯ই ফাল্গুন হয়ে থাকে। যেমনটি হয়েছে ২০১৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ৯ই ফাল্গুন।

এবার আমরা ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৮ই ফাল্গুনকে অবিমিশ্রভাবেই ১৯৫২ খৃষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে কিভাবে পাই বা পেতে পারি, তা নিয়ে আলোচনা শুরু করছি। আসলে মহান ও অমর একুশে বা স্মরণীয় ও বরণীয় ৮ প্রত্যাশিতভাবেই যে আমাদের চেতনা, নিঃশ্বাস ও বিশ্বাসে ঠাঁই করে নিয়েছে আমাদের আলোচনা থেকেই তা প্রকট, যথাযথ ও ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য। আলোচনার প্রথমেই আমাদের জেনে রাখতে হবে এই সত্যটুকু ঃ

১৩৫৮ খৃষ্টাব্দের ৮ই ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার; ৮ ঋধষমড়ড়হ, ১৩৫৮ ই.ঝ., ঞযঁৎংফধু.
১৯৫২ খৃষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রæয়ারি, বৃহস্পতিবার; ২১ ঋবনৎঁধৎু, ১৩৫২ অ.উ., ”

ক) সন দুটোর
শতক এবং অশতক অংশের দশক ও একক হচ্ছে ঃ
১৩ ৫৮
১৯ ৫২

খ) উপরিউক্ত ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের মোট যোগফল, যেমন ১+৩+৫+৮ = ১৭; তেমনি, ১৯৫২ খৃষ্টাব্দের যোগফল, যেমন ১+৯+৫+২ = ১৭

গ) উভয় সন-সংখ্যার যোগফল ১৭ এর ১+৭ মিলে হচ্ছে ৮। অর্থাৎ ‘দশক’ এর ১ ও ‘একক’ এর ৭ যোগ করে হচ্ছে ৮।

ঘ) ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের শতক অংশের সংখ্যা হচ্ছে ১৩ এবং অশতক অংশের সংখ্যা হচ্ছে ৫+৮। ৫+৮ = ১৩ এর সাথে ‘গ’-এর ১+৭=৮ যোগ করলেই আমরা পাই ১৩+৮ = ২১।

ঙ) ১৯৫২ খৃষ্টাব্দের শতক অংশের ১৯এর ১+৯ = ১০এর ও অশতক অংশের (৫২এর) ৫+২ = ৭ এর সাথে বঙ্গাব্দের শতক অংশের ১৩এর ১+৩=৪ যোগ করলে একুনে মিলছে ১০+৭+৪ = ২১।

চ) ‘ক’-এর একক, দশক ও শতকসূত্রে প্রাপ্ত ১৭ এর সাথে ‘ঙ’-এর ১+৩ = ৪ যোগ করে পাওয়া যাচ্ছে ১৭+৪ = ২১।
ছ) ‘ক’ এর নিয়মে প্রাপ্ত সন দুটোর ১৭ এর একক হচ্ছে ৭ এবং দশক হচ্ছে ১। এই দুটো মিলে হচ্ছে ১+৭=৮। আবার এই ৭ থেকে ১ বিয়োগে মিলে (৭Ñ১) = ৬। দুটো সনের শতক অংশের বিয়োগ সংখ্যার বৃহত্তর সংখ্যা থেকে ক্ষুদ্রতর সংখ্যাকে বিয়োগ করলে পাই যথাক্রমে ৯Ñ১ = ৮ এবং ৩Ñ১ = ২। এই ৮ থেকে ২ বাদ দিলে আবার আমরা পাই ৬। ঠিক একইভাবে উভয় সনের (১৯ এবং ১৩) শতক অংশের যোগফল পাই ১+৯ = ১০ এবং ১+৩ = ৪; এই বৃহত্তর যোগফল ১০ থেকে ক্ষুদ্রতর যোগফল ৪ বিয়োগ করলে পাওয়া যাচ্ছে (১০Ñ৪) = ৬। উভয় সনের গুণফল ১৯ = ৯ এবং ১৩ = ৩ থেকে পাই ৯Ñ৩ = ৬ কে। আবার ১৩৫৮ এর অশতকাংশের ৫+৮ = ১৩ থেকে ১৯৫২ এর ৫+২ = ৭ কে বিয়োগ করেও পাই (১৩Ñ৭ = ৬। আবার ৫৮Ñ৫২ = ৬ এবং ১৯Ñ১৩ = ৬।

জ) বিভিন্নভাবে প্রাপ্ত এই ‘৬’-এর সাথে ‘ক’ অনুসারে পাওয়া উভয়সনের ১৭ এর একক ৭কে যোগ করলে পাচ্ছি ৬+৭ = ১৩। আবার এই ১৩ এর সাথে ‘গ’ অনুসারে পাওয়া ৮কে যোগ দিলে পাই ১৩+৮ = ২১।

ঝ) ‘ক’ এর ১৭ থেকে বঙ্গাব্দের শতক অংশ ১৩কে বিয়োগ করলে পাওয়া যাবে (১৭Ñ১৩) = ৪। বঙ্গাব্দের শতক অংশের যোগফলও ১+৩ = ৪। এভাবে ৪+৪ দিলে হচ্ছে ৮। এভাবেই মিলে উভয় সনের শতক অংশের ১৯Ñ১৩ = ৬ এর সাথে ‘ক’ এর ১৭কে খৃষ্টাব্দের শতক অংশের ১৯ থেকে বিয়োগ দিলে (১৯Ñ১৭) পাওয়া ২কে যোগ করলেও মিলে ৬+২ = ৮। ছ-এর ৬ থেকে ঝ-এর ৪ বিয়োগে মিলে ৬Ñ৪ = ২ এবং ১৯+২, অর্থাৎ, ১৩+৬+২, ১৭+৪ থেকেই মিলে ২১কে।

ঞ) উভয় সালের শতকাংশের যোগফল মিলে ১+৯ = ১০ এবং ১+৩ = ৪। উভয় যোগফলের যোগফল দাঁড়াচ্ছে ১০+৪ = ১৪। এই ১৪ থেকে ‘ছ’ এর ৬কে বিয়োগ করলেও পাচ্ছি ১৪Ñ৬ = ৮।

ট) ‘ঞ’ অনুক্রমে প্রাপ্ত ১০+৪ = ১৪ এর সাথে ‘ক’ এর ১৭এর একক ৭কে যোগ দিলে আমরা পাই ১৪+৭ = ২১ কে।

ঠ) আবার ‘খ’ এর ১৭ কে ‘ঝ’ এর ৪ এর সাথে মিলালে হচ্ছে ১৭+৪=২১শে।

ড) ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের একক সংখ্যাটি হচ্ছে ৮।

ঢ) উভয় সনেই অর্থাৎ, ১৩৯৮ বঙ্গাব্দ ও ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের শহীদ-দিবসটি ছিল বৃহস্পতিবার;

ছাপাখানার এনালগ পদ্ধতির মুদ্রাযন্ত্রে সাজাতে গেলে আমরা অক্ষর হিসেবে পাইঃ
বৃ হ স্প ি ত ব া র
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮
ইংরেজী বানানটিতেও পাইঃ
ঞ ঐ ট জ ঝ উ অ ণ
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮

ণ) এবার দেখুনঃ
অ া ট ই ফ া ল্গু ন
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮
৮ ঋ ট খ এ ঙ ঙ ঘ
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮

ত) তবে ঞ ড ঊ ঘ ঞ ণ ঙ ঘ ঊ ঋ ঊ ই জ ট অ জ ণ
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮ ৯ ১০ ১১ ১২ ১৩ ১৪ ১৫ ১৬ ১৭

আবার ঞ ড ঊ ঘ ঞ ণ ঋ ও জ ঝ ঞ
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮ ৯ ১০ ১১
ঋ ঊ ই জ ট অ জ ণ তে পাই
১২ ১৩ ১৪ ১৫ ১৬ ১৭ ১৮ ১৯ কে ।

থ) ‘ত’ অনুসারে ১৭এর সাথে বঙ্গাব্দের শতকাংশ (১+৩)= ৪ যোগ করলে পাই ১৭+৪=২১কে ।

দ) আবার বঙ্গাব্দের শতকাংশ ১৩কে বৃহত্তর সংখ্যা থেকে ক্ষুদ্রতর অংশকে বিয়োগ করলে পাই ৩Ñ১ = ২। এই ২এর সাথে ‘ত’ এ প্রাপ্ত ১৯কে যোগ করলেও আমরা পাচ্ছি ২+১৯ = ২১ ।

ধ) ত-এর খৃষ্টাব্দের শতক অংশ ১৯ থেকে ১৭ বিয়োগ করলেও মিলছে ১৯Ñ১৭ = ২। দ-এর (৩Ñ১) = ২-এর সাথে ১৯ যোগ করলে মিলে ১৯+২ = ২১ এবং ‘ত’ ও ‘ধ’-এর যথাক্রমে ১৯Ñ১৭ = ২ ও ৩Ñ১ = ২ মিলিয়ে ২+২ = ৪ এর সাথে ১৭ যোগ দিলেই পাই ১৭+৪ =২১ কে ।

মহান ও অমর একুশে ফেব্রæয়ারি অর্থাৎ ৮ই ফাল্গুনকে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে জাত বাংলা ভাষায় ১৯৭৪ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর, সোমবার বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে প্রমিত আবেগে ভাষণ দান করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলা-বাঙ্গালীর ঐশ্বর্যময় ভাষা বাংলার শ্রী ও হ্রী বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ খৃষ্টাব্দে জাতিসংঘে প্রদত্ত তাঁর ভাষণের মাধ্যমে আরো বৃদ্ধি করেন। বিশ্বময় রক্ত দিয়ে কেনা একটি জাতিসত্বার ভাষাকে তিনি বাঙময় এবং পরিচিত করে তুলেন আধুনিক বৈশ্বিক সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে।

[ক]. দেখাই যাক ১৯৭৪ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর থেকে আমরা কিভাবে ২১ এবং ৮ কে পাচ্ছি ঃ

অঃ ১৯৭৪ কে ১+৯+৭+৪ করলে মিলছে ২১কে।
আঃ ২৩শে সেপ্টেম্বর থেকে ২ + ৩ = ৫ পাই।
খৃষ্টাব্দের দশকের ৭ থেকে একক ৪ বিয়োগ করলে মিলে (৭-৪ = ৩) এবং এই ৫+৩ মিলেই পাই ৮, অভীষ্ট আট ফাল্গুনকে।
ইঃ খৃষ্টাব্দের শতক অংশের ১+৯কে দশক ও একক ৭+৪ থেকে বিয়োগ করলে ১১-১০ = ১ এবং দশক থেকে একক বিয়োগে ৭-৪ = ৩ পাই। ২৩ সেপ্টেম্বর ২ী৩ = ৬ এর সাথে উপরের ৩-১ = ২ যোগ করলে মিলছে ৬+২ = ৮।
উপমহাদেশের কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের অংক অনুযায়ী মেধা, ধী, শক্তি ও সামর্থ্যরে বাংলা আর ১৯৪৭ সালের অষ্টম মাস আগস্ট মাসে দেশটিকে বিভক্ত করে দ্বি-জাতিত্বত্তের নেশায় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটো রাষ্ট্রই এখন তাঁদের কথিত তথ্যের নীল বিষে সবাই ক্ষত-বিক্ষত থেকে আদিম ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছেন।
একই ভাবে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্টকে ভাবলে মিলে ১+৯+৪+৭ = ২১কে এবং ১৪ আগষ্টের ১+৪ = ৫ এবং ৪-১ = ৩ নিয়ে ৫+৩ = ৮কে।

ঈঃ খৃষ্টীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে আগষ্ট হচ্ছে আবার ৮ম মাস। তাই, এখানেও আবার সেই আট।
উঃ বঙ্গজ বর্ষপঞ্জিতে ফাল্গুন মাস হচ্ছে ১১ তম মাস। তাই, এখানেও ১১+৮+২ = ২১ এবং ১১-৮+৩+২ = ৮।

[খ]. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আমরা সংবাদে জানতে পেরেছিঃ জাতিসংঘের ৩০তম অধিবেশনে ১৮৮টি দেশের ২৭টির সমর্থনে স্বাধীনতার ২৮ এবং ভাষা আন্দোলনের ৪৮ বছর পর ১৯৯৯ খৃষ্টাব্দের ১৭ই (১৭-১১-১৯৯৯) বুধবার, ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪০৬ (০৩-০৮-১৪০৬) বঙ্গাব্দকে বিশ্বভাষা দিবস হিসেবে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রæয়ারিকে উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে। দেখিই-না ২১ বা ৮ কি করে মিলছে এই ঘোষণার দিন, মাস, বছর, দেশ ও অধিবেশনের সংখ্যা থেকে ঃ-

অঃ} ১৭ই নভেম্বর থেকে ১+৭ = ৮।
আঃ} ১৯৯৯ খৃষ্টাব্দ থেকে ১+৯ = ১০ এর ১১তম মাস নভেম্বর মিলে ১০+১১ = ২১। ৯+৯ = ১৮ থেকে [ ১+৯ = ১০ ] বিয়োগে ১৮-১০ = ৮।
ইঃ} ১৮৮টি দেশ থেকে ১+৮+৮ = ১৭ অতএব ১+৭ = ৮।
ঈঃ} ৩০ম অধিবেশনের ৩০ বিয়োগ ২৭টি দেশ (৩০Ñ২৭) = ৩।
উঃ} ১৯৯৯ এর একক ও দশক যোগ ৩ (৯+৯+৩) = ২১।
ঊঃ} খৃষ্টাব্দের শতকে ১+৯ = ১০+২৭টি দেশ (১০+২৭) = ৩৭ ।
ঋঃ} ২৭টি দেশ থেকে ১১তম মাস বিয়োগ (২৭-১১) = ১৬,
এবং অতঃপর ৩৭Ñ১৬ = ২১।

[গ]. এবার ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪০৬ বঙ্গাব্দ থেকে কি পাই ?
অঃ বঙ্গাব্দের ১৪০৬ এর ১৪ থেকে ০৬ বিয়োগে (১৪Ñ০৬) = ০৮।
আঃ বঙ্গাব্দের মাসের সংখ্যাক্রম = ৮ (অগ্রহায়ণ ৮ম সংখ্যক মাস)।
ইঃ ১৪০৬ এর ১+৪+৬ = ১১ থেকে ৩ তারিখের ৩ বিয়োগ (১১-৩) = ৮।
ঈঃ ৩-৮-১৪০৬ পর পর যোগ করলে মিলে ৩+৮+১+৪+৬ = ২২;
১৪০৬ এর ৬ থেকে ১+৪ = ৫ বিয়োগ করলে মিলে ৬-৫ = ১;
এবার ২২-১ বিয়োগেই মিলে ২১।
উঃ মাস সংখ্যা ৮ থেকে তারিখের সংখ্যা ৩ বিয়োগ ৮-৩ = ৫।
ঊঃ ১৪০৬ এর যোগফল ১+৪+৬=১১ থেকে মাস সংখ্যা ৮ বিয়োগে মিলে ১১-৮ = ৩।
এঃ এবার ৫+৩ মিলে হচ্ছে ৮।
আবার, ১১-৩ = ৮,
১৪-৬ = ৮,
৮-৩ = ৫,
= ২১।

[ঘ]. আমাদের ৭১-এর ২৬শে মার্চ থেকেও ৭+১ = ৮ এবং ২+৬ = ৮-কেই পাই।

২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর হয়ে গেলো আমাদের ৯ম জাতীয় সংসদের নির্বাচন। এ থেকে পাই দ্বাদশ মাস (১২) ডিসেম্বরের ২৯ তারিখ এবং ৯ম সংসদ নির্বাচন। এবার লক্ষ্য করুন এখানেও ৮ই ফাল্গুন আর ২১শে ফেব্রæয়ারির জয়-জয়কার। ২০০৮ এর ২+৮ = ১০ এর সাথে ২৯ এর ২+৯ = ১১ মিলে পাই ১০+১১ = ২১শে। ১২তম মাস এর ২-১ = ১কে ৯ম সংসদ নির্বাচনের ৯ থেকে বিয়োগ করলে পাই ৯-১ = ৮কে। ১২তম মাস আর ৯ম সংসদ নির্বাচনকে যোগ করলে পাই ১২+৯ = ২১কে। ২০০৮ এর একক হিসেবে পাই ৮কে। আবার ২৯ এর ৯-২ = ৭ এর সাথে ১২ এর ২-১ = ১ যোগ করলে যেমন মিলে ৮কে, তেমনি ২৯-১২ = ১৭ এর সাথে ২০০৮ এর ২ এবং ২৯ এর ২ যোগ করে একুশে মিলছে। আবার ১৭+২+২ = ২১কে পাই। এভাবেই মিলছে ২+৮ = ১০ থেকে ১২ এর ২কে বিয়োগ করলে ১০-২ = ৮কে। ২০০৮ এর ও ২৯ এর ২ এর সাথে ২৯-১২ = ১৭কে যোগ করলে মিলে যথাক্রমে ২+২+১৭ = ২১ এবং ২+৯ = ১১ থেকে ১২-৯ = ৩কে বিয়োগ করলে পাই ৮কে।

২১ সংখ্যাটিকে ১৯৫২তে পেলাম আমরা। ১৯৫৪ সালে তাকেই পেলম ২১ দফায়, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র ১+৯+৫+৬ = ২১কেই পেয়েছি, ১৯৬৫ সালেও ১+৯+৬+৫ = ২১ পেলাম, পেলাম ১+৯+৭+৪ = ২১ কে ১৯৭৪ সালে এবং একুশেরই উত্তরসূরী হিসেবই বাংলা, বাঙ্গালী ও বাংলাদেশের দুর্মর সন্তান বঙ্গবন্ধুর দল সুদীর্ঘ ২১ বছর পর জনতার রায় লাভ করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার জন্যে রয়েছে নিবেদিত শোষণহীন সমাজ ও দেশ গঠনের সহায়ক সরকার গঠন করে। বিংশ শতকের ১+৯+৮+৩ = ২১ এবং ১+৯+৯+২ = ২১ পেলেও একবিংশ শতাব্দীর ২০০১ থেকে ২০৯৯ পর্যন্ত কোন খ্রিস্টীয় বর্ষ-সংখ্যা থেকে যোগফল করে উপরোক্ত রীতিতে “২১” -কে মিলছেনা অঙ্কের শুভঙ্করের মহিমা আর কল্যাণে। যদিও ২+০+৯+৯ = ২০ এর সাথে ২০০১-এর ১+২১ এবং ৯+৯+২+১ = ২১ মিলতে পারে।
– আটই ফাল্গুন কি ভাবে একুশে, সুনির্মলকুমার দেব, মীন, বাংলাবাজার পত্রিকা; ১৪ই ফাল্গন, ১৩৯৯; পৃ-৪।

আমাদের বাংলা বর্ষপঞ্জির বর্তমান গণনারীতিতেই ১৪২৫ বঙ্গাব্দের একুশে ফেব্রæয়ারিতে পাচ্ছি নয়ই ফাল্গুন। দিনপঞ্জিতে তাই ৯ই ফাল্গুন, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ, ২১শে ফেব্রæয়ারি, ২০১৯ খৃষ্টাব্দ মিলছে। বাংলা একাডেমী, শহীদুল্লাহ্ স্মৃতি সংসদ সংশোধনী যেসব বর্ষপঞ্জির অবতারণা করেছেন, তাতেও সমস্যার সুরাহা হচ্ছে না। বাংলা একাডেমী বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত ৫টি মাসকে ৩১ দিনের এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত ৭টি মাসকে ৩০ দিনের করে মোট (৩১ ী ৫ = ১৫৫+ ৩০ ী ৭ = ২১০) = ৩৬৫ দিনের সাধারণ বর্ষ বলে এবং ৪ দিয়ে যে সন নিঃশেষে বিভাজ্য সেই সনে চৈত্র মাস ১ দিন বাড়িয়ে ৩০+১ = ৩১ দিনে মোট ৩৬৬টি দিনের অতিবর্ষ বা লীপ্ইয়ার খৃষ্টীয় গণনারীতিতেই গণনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।
শহীদুল্লাহ স্মৃতি সংসদও কেবল চৈত্রের বদলে অতিবর্ষে ফাল্গুন মাসকে ৩০+১ = ৩১ দিনের করেছেন এবং ৪ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য বাংলা সনটিকেই তারা অতিবর্ষ স্থির করেছেন। কিন্তু এতেও ২১ ফেব্রæয়ারী ৮ ফাল্গুন হচ্ছে না এবং ৮ই ফাল্গুন ২১শে ফেব্রæয়ারি হচ্ছে না।

সম্প্রতি আবার অধ্যাপক অজয় রায়-সাহ ১৪২৬ বঙ্গাব্দের ৩০ দিনের আশ্বিন মাসকে ১ দিন বাড়িয়ে ৩১ দিনের আশ্বিন মাস হিসেবে বুধবারকে ৩১শে আশ্বিন হিসেবেই গণনা চালুর জন্য প্রস্তাব রেখেছেন। কথিত প্রস্তাবটিতে বলা হয়েছে, “বদলে গেছে বাংলা বর্ষপঞ্জি। এতদিন ৩০ দিনে গণনা করা হলেও চলতি ১৪২৬ সাল (১) থেকে আশ্বিন মাস গণনা করা হচ্ছে ৩১ দিনে। এ হিসাবে আজ বুধবার হবে ৩১ আশ্বিন। বৃহ¯পতিবার পয়লা কার্তিক। ২০২০ সাল (২) অধিবর্ষ ( লিপইয়ার ) হওয়ায় এ বছর ফাল্গুন মাস পূর্ণ হবে ৩০দিনে। তবে আগামী বছর থেকে ফাল্গুন মাস গণনা করা হবে ২৯ দিনে। ”

ঊনিশ শ’ বায়ান্ন সালের আটই ফালগুনকে কেন একুশে ফেব্রæয়ারি হিসেবে পাওয়া যাচ্ছেনা, তাই নিয়ে একটি প্রতিবেদনে দেখতে পাওয়া যায়ঃ
“যেদিন পাকিস্তানের আধিপত্যবাদী শাসকগোষ্ঠী ঢাকার রাজপথ বাঙালী আন্দোলনকারীদের বুকের রক্তে রঞ্জিত করেছিলো, বাংলা পঞ্জিকার হিসেবে সেদিন ছিলো ৮ই ফাল্গুন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা যতোই জাতীয়তাবাদী হোন না কেন, তাঁরা তাঁদের কর্মসূচী ঠিক করেছিলেন খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকা হিসেবে। ভাষা আন্দোলন অবশ্যই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিলো। বাংলা পঞ্জিকার ব্যাপক প্রচলন এবং সেই সমৃদ্ধ ঐতিহ্য স¤পর্কে সচেতনতাও তখন ছিলো। তা সত্বেও আন্দোলনকারীগণ নিজেদের অজ্ঞাতে বাঙালী জীবনের এ শুভক্ষণটিকে মনে রেখেছেন খ্রিষ্টীয় তারিখের অনুষঙ্গে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে গৃহীত সৌর-পদ্ধতির এ পঞ্জিকায় ভাষা আন্দোলনের স্মারক দিনটি চিহ্নিত হওয়ার ফলে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, জন্মসূত্রেই মহান একুশের একটি ঋদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিচয় তৈরি হয়েছিলো। প্রবল জাতীয়তাবাদী পরিবেশে লালিত-পালিত হয়েও এতটা বছর একুশ কিভাবে তার সেই আন্তর্জাতিক পরিচয় বজায় রাখতে পেরেছে, বরং সেটাই এক বিস্ময়। বস্তুত গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো প্রান্ত থেকেই একুশে ফেব্রæয়ারিকে কেউ ৮ই ফালগুন করার চেষ্টা করেননি – যা হতো জাতীয়তাবাদী বাঙালীর জন্য সহজ ও স্বাভাবিক একটি আচরণ। এর মধ্যে একাধিকবার সরকারিভাবে বাংলা পঞ্জিকা প্রচলনের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে, কিন্তু একুশকে বাংলায়ন করার চেষ্টা কেউ করেননি। এমনকি বাংলা একাডেমী পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির উদ্যোগে যখন খ্রিষ্টীয় তারিখের সঙ্গে বাংলা তারিখের স্থায়ী সংযোগ সৃষ্টি করা হয়, তখনও ৮ই ফাল্গুনকে গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদকরূপে গণ্য করা হয়নি। তাই বায়ান্নের একুশে ফেব্রæয়ারির ৮ই ফাল্গুন দু’হাজার সালে এসে ৯ই ফাল্গুন হয়ে গেলেও তা নিয়ে তেমন কেউ উচ্চবাচ্য করেন না।

জন্মসুত্রে প্রাপ্ত নামের মধ্যেই একুশের যে বৈশ্বিক সম্ভাবনা ছিলো, গত নভেম্বরে তা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। কোনো রকম বিরোধিতা ছাড়াই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে একুশে ফেব্রæয়ারি তাবৎ বিশ্ববাসীর উত্তরাধিকারে পরিণত হলো। সকলেই একবাক্যে বলবেন যে, ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক মাত্রাই এমন প্রশ্নাতীত গ্রহণযোগ্যতার কারণ। কিন্তু কি সেই আন্তর্জাতিক মাত্রা ? অদূর ভবিষ্যতে অবশ্যই তা আলোচিত হবে, হয়তো যথাযথভাবে নির্ণীতও হবে। তবে গৌণ হলেও ভাষা আন্দোলনের খ্রিষ্টীয় অনুষঙ্গের এই তারিখটি নিঃসন্দেহে প্রারম্ভিক উল্লেখের দাবিদার”।
– স্বরোচিষ সরকার, দৈনিক সংবাদ, একুশে ফেব্রæয়ারি, ২০০০।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আলোচ্য প্রতিবেদনটির উদ্ধৃতি অনুসারে, অর্থাৎ বিগত এই ব্যাপারে, অর্থাৎ, বিগত বস্তুত গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো প্রান্ত থেকেই একুশে ফেব্রæয়ারিকে কেউ ৮ই ফালগুন করার চেষ্টা করেননি – যা হতো জাতীয়তাবাদী বাঙালীর জন্য সহজ ও স্বাভাবিক একটি আচরণ। এর মধ্যে একাধিকবার সরকারিভাবে বাংলা পঞ্জিকা প্রচলনের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে, কিন্তু একুশকে বাংলায়ন করার চেষ্টা কেউ করেননি – এই “বাক্যাংশটি সঠিক ও যথার্থ নয়। আমরা প্রায় চার যুগ থেকেই ২১শে ফেব্রæয়ারির প্রাতিষঙ্গিক বঙ্গাব্দের দিন ও তারিখ হিসেবে ৮ই ফাল্গুনের গণনা-রীতি চালু করণের সহায়ক একটি অভিন্ন বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রণয়ণ করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে আসছি। কিন্তু, সচিবালয় কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় খ্রিষ্টীয় এবং বঙ্গীয় অব্দের মাধ্যমে ২১শে ফেব্রæয়ারিকে ৮ই ফাল্গুনের সাথে একই দিনে ব্যবহার ও প্রচলনের সরকারী কোনো তৎপরতার মাধ্যমে এই ব্যাপারে মোটেই কোনো সহযোগিতা ও সাহায্য পাওয়া যায়নি।

একই সাথে আমরা তখন আমাদের অভিন্ন বাংলা বর্ষপঞ্জি গঠন-রীতি অনুযায়ী ১৫ই এপ্রিলের পরিবর্তে ১৪ই এপ্রিল থেকে বঙ্গাব্দে নববর্ষ শুরু এবং চালু করতে সরকারের প্রতি আমদের প্রচুর রচনাতে আহŸান জানিয়েছি। পরবর্তি কালে ১৪ই এপ্রিল তারিখে ১লা বৈশাখ গণনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও অন্যান্য তথ্য-উপাত্তকে বাদ দেওয়ায় এখনো ৮ই ফাল্গুনকে প্রতিষঙ্গী ২১শে ফেব্রæয়ারিতে পাওয়া যাচ্ছেনা এবং এই গণনাপদ্ধতিতে তা’ পাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। অতএব, ‘এ নিয়ে তেমন কেউ উচ্চবাচ্য করেন নাই’ বাক্যটি সত্য এবং সঠিক নয়। বরঞ্চ, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কর্মকর্তাদের ভুল আর অনীহার সাথে তাঁদের দায়িত্ব পালনে উন্নাসিকতা, অক্ষমতা আর প্রতিপাদ্য বিষয়ের গভীরে যাবার ব্যর্থতাকে দায়-সারা গোছের রুটিন-ওয়ার্ক পালনে সময়ক্ষেপণ করাকে তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন না। আমাদের প্রস্তাবিত অভিন্ন বাংলা বর্ষপঞ্জি গণনারীতির মাধ্যমে একুশ ফেব্রæয়ারিকে পাই ৮ ফাল্গুনের চিরস্থায়ী ব্যবহারের পক্ষে। তাই বর্তমান বর্ষপঞ্জির ২/৩ দিনের সম্ভাব্য পার্থক্যকে ‘অর্জনের জন্য বর্জনের’ মত আপ্ত বাক্যটিকে প্রাধান্য দিয়েই খ্রিষ্টাব্দের সাথে সংশোধনীর সাযুজ্য রক্ষা করা গিয়েছে। আসলে দেশের মফস্বলের কোন লেখকের গবেষণা-জাত প্রবন্ধ বা নিবন্ধকে, তথ্যবহুল রাজধানী ঢাকা-কেন্দ্রিক-লেখকের নয় বিধায়, গুরুত্ব না দেবার একটা নোংরা মানসিকতা কিছু প্রতিষ্ঠানের কিছু সংখ্যক কর্মকর্তার মধ্যে যে রয়েছে তা’ কিন্তু প্রায় অনায়াসে প্রমাণ করা সম্ভব। তার অন্তত একটা প্রমাণ হিসেবে “১৪ এপ্রিল থেকে বাংলাবর্ষ শুরু” সিদ্ধান্তকে ধরে নেয়া যেতে পারে; যদিও ৮ ফালগুনকে ২১ ফেব্রæয়ারি, মাসের দিনসংখ্যা, অধিবর্ষ ইত্যাদি স¤পর্কে কিছু যথাযথ বাংলায়ন করার উদ্যোগের তেমন সংস্কার-সংশোধনের কিছু সরকারি পর্যায়ে করা হচ্ছে বলে বুঝাও যাচ্ছেনা। সরকারিভাবে দেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রচনাবলীর বক্তব্য ইত্যাদি নিয়ে তেমন কোন কিছুর সহায়ক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন বা গুরুত্ব নিয়ে কেউই ভাবছেন না। ফলে আমাদের ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ এবং জীবনাচরণেও আদর্শহীনতা বা আদর্শচ্যুতি ইত্যাদি নিয়ে সংশয়-সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে এক সীমাহীন জিজ্ঞাসা নিয়ে।

এই বিষয়টিকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব না দিয়ে প্রচলিত ফাইল-ওয়ার্কের মধ্যেই বেঁধে বরং আটকে রেখে সংশ্লিষ্টরা শুধুমাত্র দায় সেরেছেন বলেই অনেকে ধারণা করে থাকেন এবং সব কিছুর আনুপূর্বিক কর্মকান্ড বিচার ও যাচাই করলে এর চেয়ে উল্লেখ্য বা বেশী কিছুরই হদিশ যে মিলবেনা-মিলছে-ওনা, এই ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ মাত্র নেই।

মূলতঃ, একটি অবিসংবাদিত, অবধারিত এবং বাস্তব সত্য এই যে, ৮ই ফাল্গুনকে নিয়মিত ভাবে ২১শে ফেব্রæয়ারি হিসেবে গণনা করতে হলে আমাদের বর্তমানে প্রচলিত বর্ষপঞ্জি গণনারীতিতে তা মোটেই যে সম্ভব নয় এবং তা’ করাও যাচ্ছে না। বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারি সংস্থার একক এবং সমন্বিত বেশ কিছু সংশোধনী সত্বেও ৮ই ফাল্গুনকে কিন্তু ২১শে ফেব্রæয়ারিতে মিলে নাই। আবার, এই ব্যাপারেই শুধু নয়, আমাদের সরকারী কর্মকর্তবৃন্দ বাংলা নববর্ষের শুরুতে মেতে উঠেন বাংলাসন-সাল-অব্দের উৎস-উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে যেভাবে, ঠিক সেই একই ভাবে প্রায় পাগলপারা থাকেন ২১শ ফেব্রæয়ারিতে ৮ই ফাল্গুনকে পেয়ে যেতে। অথচ, ১লা বৈশাখ ও ২১শে ফেব্রæয়ারি দিনদুটি কেটে গেলে পরদিন থেকে এই ব্যাপারে ফের পরবর্তি ৩৬৫/৩৬৬ দিনের মতো দিব্যি মুখে কুলুপ এঁটে দিন গুজরান করেই আসছেন, ‘মাথায় ছোট বহরে বড়’ দেশ ও ভাষাপ্রেমিক সমাজ ও সংস্কৃতিকর্মী ঊর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ এবং তাঁদের অপার গুণ ও মহিমা নিয়ে সন্দেহ ইত্যাদি না থাকলেও বরং বুঝতে কষ্ট হয় না তাঁদের কুশলতা নিয়ে অনেকেই ভাবেন যে তাঁরা সত্যি-ই বলে বসবেন, তাঁরা কিছুই যে জানেন না।

যাতে সঠিক, বরাবর ও অভিন্ন বাংলা বর্ষপঞ্জি, যা’ আন্তর্জাতিক দিন গণনারীতিতে আদৃত, স্বীকৃত, গণিত ও গৃহীত হতে পারে, সেদিক বিবেচনা করে আমরা অভিন্ন বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে ৩০ ও ৩১ দিনের এবং অতিবর্ষে ফাল্গুন মাসকে ২৯ দিনের করে সাজিয়ে একটি বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রতি কৌতুহলী পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যাচ্ছি। এই বর্ষপঞ্জির মাসের দিন সংখ্যা হবে অ আ অ আ, আ অ আ অ, আ আ অ আ। এখানে [অ] = ৩০ এবং {আ} = ৩১ দিন বুঝতে হবে এবং একাদশতম মাস ফাল্গুনের দিন-সংখ্যা সাধারণ বর্ষে ২৮ ও অতিবর্ষে ২৯ দিনে গণনা করতে হবে। এই বর্ষপঞ্জির প্রতিটি বাংলা মাসের ১ম দিনটিতে সমসাময়িক ইংরেজী মাসের চৌদ্দ তারিখ হবে। এতে খৃষ্টাব্দ ও বঙ্গাব্দের স্থির ব্যবধান থাকছে ১৩-০৩-৫৯৩। এই বর্ষপঞ্জি অনুসারে যে বাংলা সন ৪ দিয়ে ভাগ দিয়ে ২ অবশিষ্ট থাকে, সেই বাংলা সনই হবে লিপ্ইয়ার বা অতিবর্ষ। বাংলা একাডেমীর বর্ষ গণনারীতিতে ১৪০৪ অধিবর্ষ হলেও খৃষ্টাব্দ ১৯৯৮ লিপ্ইয়ার হচ্ছে না। কিন্তু অভিন্ন বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪০৬ অধিবর্ষ হচ্ছে এবং সমসাময়িক খৃষ্টাব্দ সন ২০০০ অথবা ১৪০২ অধিবর্ষ হচ্ছে এবং প্রতিপক্ষীয় ১৯৯৬ খৃষ্টাব্দ এবং ১৯১৮ শকাব্দ হচ্ছে অধিবর্ষ বা লিপ্ইয়ার।

কেননা, ১৪০২ বঙ্গাব্দকে ০৪ দিয়ে ভাগ করেও ভাগফল ৩৫০ শেষে অবশিষ্ট থাকছে ০২ এবং ১৪০৬ বঙ্গাব্দকে ০৪ দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল ৩৫১ হয়েও অবশিষ্ট থাকছে ০২ এবং এজন্যেই সমকালীন ১৯৯৬ ও ২০০০ খৃষ্টাব্দ হচ্ছে আলোচ্য বঙ্গাব্দদ্বয়ের সম্পূরক লীপ্ইয়ার যা অন্য কোন গণনারীতিতে মিলেনা। আরও উল্লেখ্য যে, খৃষ্টাব্দ থেকে শকাব্দের জন্মসন ৭৮ বিয়োগ করলে মিলে শকাব্দের সন সংখ্যা। যেমন, ২০০৯ – ৭৮ = ১৯৩১। আমাদের অভিন্ন বর্ষপঞ্জির অতিবর্ষ বা লীপ্ ইয়ার ১৪০২ অথবা ১৪০৬ এর সম্পূরক বা প্রতিরূপ খৃষ্টাব্দের লীপ্ইয়ার ১৯৯৬ অথবা ২০০০ খৃষ্টাব্দের সাথে শকাব্দের লীপ্ইয়ার হিসেবে যথাক্রমে ১৯১৮ এবং ১৯২২ শকাব্দ পাই। বঙ্গাব্দ, খৃষ্টাব্দ ও শকাব্দের এমন মিল শুধু অভিন্ন বাংলা বর্ষপঞ্জি গনারীতিতেই সম্ভব।
এই অভিন্ন বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে প্রতিবছরই ২১শে ফেব্রæয়ারি হবে ৮ই ফাল্গুন, ১লা বৈশাখ ১৪ই এপ্রিল, ১লা মে হবে ১৮ই বৈশাখ, ২৫শে বৈশাখ হবে ৮ই মে ইত্যাদি। ৮ই ফাল্গুনই যে অমর একুশে, এ নিয়ে আর বিতর্ক না থাকাই উচিত। কেননা, পঞ্জিকাকারদের মহিমায় না হলেও বাংলাদেশের হৃদয়ে ৯ই ফাল্গুনই ২১শে ফেব্রæয়ারি হয়ে রয়েছে এবং থাকবেও। অমর ২১শে ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের গৌরব পেলো অথচ আমরা গর্ববোধ করতে পারবোনা ৮ই ফাল্গুনকে নিয়ে কেবল মাত্র বর্ষ গণনাপদ্ধতির ত্রæটির জন্যেই। এই ধরনের অবিমৃষ্যকারীতার অবসান সবাই কামনা করেন, কেননা অভিন্ন বাংলা বর্ষপঞ্জির গণনারীতি এই অভাব বিদূরিত করতে অনিন্দ প্রক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তাই ১৪১৪ বঙ্গাব্দ, ২০০৮ খৃষ্টাব্দ, ১৯৩০ শকাব্দ হচ্ছে অতিবর্ষ। আমাদের চেতনার ফাল্গুনের রক্তিম আগুন হচ্ছে অমর একুশে। অমর একুশ আমাদের চেতনায়, বিপ্লবে, বিদ্রোহে, প্রতিবাদে বিষের বাঁশি হয়েই আমাদের জীবন-জীবিকায়, স্বননে-মননে এক প্রাণবন্ত ও দুর্বার শক্তি। এই গণনারীতিতেই ১৪২৬ বঙ্গাব্দ প্রাতিষঙ্গিক হিসাবে পাচ্ছে ২০২০ খ্রিষ্টীয় সন এবং ১৯৪২ শকাব্দকে, যা অন্যান্য কোনো বর্ষ গণনাপদ্ধতিতেই পাওয়া যায় না।

সবশেষে হাসান হাফিজুর রহমানের পংক্তিগুলোই স্মর্তব্যঃ-

আবুল বরকত নেই, নেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা
বিশাল শরীর বালক, মধুর ষ্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো যে তাকে ডেকোনা।
আর একবার ডাকলে তুমি ঘৃণায় কুঁচকে উঠবেÑ
সালাম, রফিকুদ্দীন, জব্বার কি বিষণœ থোকা থোকা নাম
এই এক সারি নাম বর্শার তীক্ষè ফলার মত এখন হৃদয়কে হানে।

বিস্তীর্ণ জনপদের বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ, ভাষা আর জাতিসত্বা রক্তের বিনিময়ে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত “উন্নত মম শির”-এর অহংকারে যে উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত প্রাণময়তায় গোটা বিশ্বকে অবাক করে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিলো, সেই অনুপ্রাণক ও প্রমত্ত হৃদ্যতাময় হার্দিক মননশীলতায় ঋদ্ধ ৮ ফাল্গুন, ২১ ফেব্রæয়ারিকে কি‘ভুলিতে পারি’ আমি, আমরা, আপনারা এবং বিশ্বজন।’

মহান একুশ অমর থাকুক আমাদের কথা, কাজ, সৃজন, চিন্তন এবং মননে। আমাদের চেতনার গভীরে আমাদেরই স্বাজাত্যবোধ, জাতিসত্ত¡া আর সুললিত ভাষার অমিত অমিয় ব্যঞ্জনাময় হৃদয়জ সৃজনশীলতাকে বাঙময় ও চিরঞ্জীব করে প্রাত্যহিক পলে-অনুপলে, নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে কায়িক ও মায়িক চেতনাকে সম্পন্ন করতে মহান এই দিবসটি অনুরণিত হতে শুনিঃ
“ তোমার মুখের দিকে আমি সব সময়ই তাকিয়ে আছি।

তোমার অশ্রæবিন্দু পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুক্তোর চেয়েও সুন্দর।
তোমার পিঠের চাবুকের দাগ সবচেয়ে উজ্জ্বল জড়োয়ার চেয়েও উজ্জ্বল।

তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চÐীদাস,
শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসুদন,
তোমার থরথর ভালবাসার নাম রবীন্দ্রনাথ,
বিজন অশ্রæবিন্দুর নাম জীবনানন্দ,
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম।

সুখে দুঃখে উদ্ধত বিদ্রোহে পরাজয় আর বিজয়ে অভিন্ন
আমরা হাজার বছর ধরে। হাজার বছর পরে “।
-হুমায়ুন আজাদ, বাংলা ভাষাঃ তোমার মুখের দিকে।

একুশে ফেব্রæয়ারির জের ধরে দেশব্যাপী শোকাতুর মানুষের একে একে চলতে লাগল নানান আকার ও প্রকারের মিছিল, শোভাযাত্রা, সভাসহ আন্দোলন। শুক্রবার, ২২শে ফেব্রæয়ারি তারিখে মেডেক্যাল হোষ্টেল প্রাঙ্গনে গায়েবী জানাজা শেষে গোটা শহরটি পরিণত হয় মিছিলের শহরে। সদরঘাটে অবস্থিত বাংলাভাষা বিরোধী দুষ্কর্মের সহযোগী দৈনিক মনিং নিউজ-এর ছাপাখানা পুুড়িয়ে দিলে ছাত্র-জনতার মিছিলে ইপিআর আর পুলিশবাহিনীর গুলীতে নিহত হয় নবাবপুরের সফিউর, আউয়াল, কিশোর ওহি উল্লাহ আর সিরাজউদ্দীন। ২২ তারিখ থেকেই চলছে রাতে ক্যার্ফিউ, দিনে ১৪৪ ধারা। শ্লোগান, মিছিল, হরতাল, পিকেটিং-এ অচল ঢাকাসহ সারাদেশ, মিছিলই ছিল শুধু সরব ও সচল, উত্তাল ও স্বজনহারানোর বেদনায় উদ্বেল। এলো ২৩শে ফেব্রæয়ারি। অব্যাহত রয়েছে ২২শে ফেব্রæয়ারিতে বিহŸল স্বদেশের মুখ-বুক-চিবুকের উন্মাদনা। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সোচ্চার গোটা দেশ। বজ্রের কাছ থেকে শব্দ এনে বলছেঃ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

৫২-র প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের ঘটনাটি ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যাপারটি যেমন আবেগের, তেমনি দেশ, জাতি ও দেশপ্রেমে সনিষ্ঠ একাত্মতায় নিবেদিত হিসেবেই ছাত্র-জনতা কাজ করেছে। স্মৃতিবহ স্মারক চাই, চাই শহীদ বেদী, মিনার, স্তম্ভ!
২৩শে ফেব্রæয়ারী রাতে কোন স্থপতি বা নির্মাণ-নকশাবিদের পরিকল্পনায় নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রের নকশায় অন্য আর সব সহযোগিরা মিলে ধারে-পাশে মেরামতি কাজের জন্য রাখা ইট-সুরকী, সিমেন্ট, বালি যা-কিছু ছিল, তাই দিয়ে রাতারাতি শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ কাজ সমাধা করেন। পরবর্তী দিন ২৪ তারিখে এই স্মৃতি স্তম্ভটি উদ্বোধন করেন চলমান আন্দোলনের নিহত শফিউর রহমানের পিতা। তখনকার নব-জাগ্রত চেতনাকে নব-নির্মিত এই শহীদ মনার এমন প্রবলভাবে ধারণ করেছিল যে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তখন অতি অল্প সময়ে শহীদ মিনারে এতো বেশী লোক সমাগম শুরু হয়ে গেল যে, প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর আদর্শে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী মিনার প্রাঙ্গণ ঘিরে ফেলে মিনারটি চ‚র্ণ-বিচ‚র্ণ করেই ক্ষান্ত হোল না, ধুলামাটি ইট যা কিছু ছিল ট্রাকে তুলে নিয়ে গেল। বিরূপ প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে বুঝতে গিয়ে এদেশের মানুষের জীবনে যেমন বার বার নেমে এসেছে বিপর্যয়, তেমনি সংগ্রাম, আত্মদান ও প্রত্যয়ের প্রতীক মিনারও বার বার হয়েছে বিধ্বস্ত। ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ সেই কালো রাত্রিতে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয় বাঙালির প্রাণের মিনার। কিন্তু, তারা শুনতে পারেনিঃ ‘দেখো বাংলার হৃদয় আজ শহীদ মিনারে ভরা।’ তারা শোনবে কি করে ? তারা যে স্বার্থান্ধ, মিথ্যে গর্বে জড়, ক্লীব, মোহাবিষ্ট। দৃষ্টি তাদের মোহে আচ্ছন্ন, বিবেক তাদের চেতনারহিত।

বর্তমান নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ হয়তো একথা জেনে অবাক হবেন, ৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতার পর ২১শে ফেব্রæয়ারী প্রথম শহীদ দিবস পালিত হয় শহীদ মিনারবিহীন বিধ্বস্ত বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে। এর অব্যবহিত পরেই শহীদ মিনার পুনঃনির্মিত হয়। হৃদয়ে-চেতনায় শহীদ মিনার যে ঠাঁই পেয়েছে। উল্লেখ্য, শহীদ স্মৃতিকে অমর করে রাখতে তখন একটি প্রতীকের গুরুত্ব ভাষা আন্দোলনে জড়িত কর্মীদের কাছে তীব্রভাবে অনুভ‚ত হয়। সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার তৈরীর তোড়জোড়। প্রথম শহীদ মিনার নির্মান সম্বন্ধে বায়ান্নের মহান ভাষা আন্দোলনে ওই মেডিকেল কলেজের কর্মী সাঈদ হায়দারের বক্তব্য প্রণিধেয়ঃ
“এটাকে স্বতঃস্ফুর্ত একটা পরিকল্পনা বলা চলে। দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ২২শে ফেব্রæয়ারির রাত থেকেই শহীদ মিনার তৈরীর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আর ২৩শে ফেব্রæয়ারি থেকে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়। ২৩ তারিখ বিকেল থেকে শুরু করে সারারাত সেখানে কাজ হয় (কার্ফু থাকা সত্তে¡ও)। ইট বালির কোন অভাব ছিল না। মেডিকেল কলেজ সম্প্রসারণের জন্য প্রচুর ইট বালি ছিল। ছাত্ররাই ইট বয়ে এনেছে। বালির সাথে সিমেন্ট মিশিয়েছে। দুজন রাজমিস্ত্রি ছিল। তাঁদের নাম বলতে পারব না। আমাদর মেডিকেল হোস্টেলে প্রায় তিনশো ছাত্র ছিল। তাঁদের সকলেই সেদিন কোনো-না-কোনো কাজ করেছিল। আর শহীদ মিনারের কাজ শেষ হলে দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল এবং নকশাটি সেখানেই টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শরফুদ্দীন (তাকে আমরা ইঞ্জিনিয়ার বলতাম, সে ভাল অঙ্ক জানত) শহীদ মিনার নির্মাণের কাজে যথেষ্ট যতœ নিয়েছিল। এ ছাড়া মাওলা, হাসেম, জাহেদ, আলিম, জিয়া আরও অনেকে শহীদ মিনার নির্মাণে প্রাণপাত পরিশ্রম করে। এছাড়া ছিল আমাদের অনেক বয়-বেয়ারা, এরাই ছিল সেদিনকার বড় কর্মী। নকশায় সাড়ে ন’ফুটের পরিকল্পনা হয়েছিল, কিন্তু শেষ করার পর দেখা গেল মূল পরিকল্পনাকে তা ডিঙিয়ে গেছে। মিনারটি সম্ভবত ১১ ফুট তৈরি হয়েছিল। বদরুল আলমও মিনার প্রাঙ্গণে সাহায্য করেছিল। তার হাতের লেখা ছিল চমৎকার। কাগজে লিখে মিনারের গায়ে সেঁটে দিলে মর্মর পাথরের মত দেখাত। আজকের শহীদ মিনার যেখানে, প্রায় তার কাছাকাছি মিনারটি তৈরি করা হয়েছিল। শহীদ শফিউর রহমানের পিতাকে এনে ২৪শে ফেব্রæয়ারি মিনারটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। আমি সেখানে ছিলাম। পরবর্তী সময়ে ২৬শে ফেব্রæয়ারি সকাল ১০টার দিকে আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেব নাকি উদ্বোধন করেছিলেন, তবে তা হয়ত আরও আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখার জন্য কালাম সাহেবকে নিয়ে পুনরায় উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয়ে থাকবে ”।

এই উদ্বোধনীর দিনই অর্থাৎ ২৬শে ফেব্রæয়ারি পাকিস্তান পুলিশ ও সেনাবাহিনী প্রথম শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলে। তারপরও ঢাকা কলেজেও একটি স্থাপিত শহীদ মিনার এক সময় সরকারের নির্দেশে ভেঙ্গে ফেলা হয়।

আবু হোসেন সরকারের মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময়কালে তৎকালীন পূর্তসচিব আব্দুস সালাম খান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল এলাকায় শহীদ মিনারের শিলান্যাসের স্থাপনের জন্য চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে একটি স্থান বাছাই এবং নির্ধারণ করেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২১শে ফেব্রæয়ারি এই নির্দিষ্ট ও নির্বাচিত স্থানটিতে একজন মন্ত্রী কর্তৃক কাঙ্খিত শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর সিদ্ধান্তকে সমবেত জনতার প্রচন্ড-প্রবল আপত্তির দরুণ বন্ধ করা হয়। তারপর শহীদ মিনারের এই শিলান্যাস স্থাপন অনুষ্ঠানটি সমাপ্ত করেন আমাদের ভাষা আন্দোলনের স্মর্তব্য শহীদ রিকসাচালক আওয়ালের ছয় বছর ব্যসের কন্যাসন্তান বসিরণ।

বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের পর বড় পরিসরে যুক্ত ফ্রন্টের সহযোগিতায় ১৯৫৭ সালে শহীদ মিনার তৈরির কাজ আবার শুরু হয়। নতুন এই শহীদ মিনারের স্থপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন হামিদুর রহমান। তার ভাবনা অনুসারে শহীূদ মিনারের মূল বেদীর উপর অর্ধবৃত্তাকারে পাঁচটি স্তম্ভের সাজানো অবস্থানের মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছেন যে, সর্বংসহা জননী জন্মভ‚মি মাতৃরূপে তাঁর সন্তানদেরে সাথে নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। এই শহীদ মিনারটি ১৯৬৩ সালের ২১শে ফেব্রæয়ারি তারিখে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে নিহত আবুল বরকতের মা হাসনা বেগম উদ্বোধন করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় ১৯৭১ সালের আমাদের প্রাণপ্রিয় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হায়েনা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এইটিও ভেঙ্গে ফেলে। ‘নিজেরে কর জয়’ এই আর্তিতে সবুজ বাংলার জমিনের উপর রক্তিম লাল সূর্যকে দেদীপ্যমান রেখেই ১৯৭৩ সালে স্বাধীন সার্বভৌম সরকার এই অনুপ্রেরক শহীদ মিনারের পূণ নির্মাণ করেন।

বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিয়ে ১৯৫৬ সালের ৭ই ফেব্রæয়ারি তারিখে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে উর্দুও সাথে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েও ২০ বছর পর তা কার্যকর করার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। ১৯৬৩ সালে সামরিক আইনজারীর বরাত দিয়ে আরও ২০ বছরের জন্য এই মেয়াদ-কাল বাড়িয়ে দেয়া হয়। বলাই বাহুল্য, দ্বিতীয় পর্যায়ের মেয়াদ শেষ হবার অনেক আগেই একুশের মহান চেতনায় জাত একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেও পর ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর জন্ম নেয় ভাষিক-জাতিক গর্বে স্পর্ধিত রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের সংবিধানে একুশের আপোষহীন প্রত্যয়, চেতনা, অধিকার ও মনোবল সৃষ্ট সম্পন্ন জাতির ভাষা, বাংলা ভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মর্যাদা দান করা হয়।

On February 16, 1956 the Provincial United Front Government under Chief Minister, Abu Hussain Sarkar declared February 21 as the Marty’s Day and decided to observe it henceforth as a closed public holiday in commemoration of the sacrifices of the language martyrs. But in 1959 Military dictator Ayub Khan scrapped the decision. During the mass upsurae in 1969 the provincial government in erstwhile East Pakistan again declared the day as closed holiday in a bid to quell the student, who had then become restive. The 1956 Constitution of Pakistan gave Bangla the recognition of a state language along side Urdu.

– Manssor Mamoon, A Saga of Sacrifice For Mother Language; The Daily Star; February 21, 2000; p-2*.

‘রাজদÐ যে কোন ভাষাকে কোন কালে লুপ্ত করিতে পারে নাই, ইতিহাস তাহার সাক্ষী। বাঙলার ও বাঙলার বাহিরের বাঙালী যে ভাষার বন্ধনে আবদ্ধ, কোন গভর্নমেন্ট এমন শক্তিমান নহে যে সেই বিধির বাঁধন কাটিতে পারে”।
– ডঃ শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার, আমরা বাঙ্গালী।

# সুনির্মলকুমার দেব মীন, লেখক, গবেষক এবং প্রাক্তন অধ্যাপক

আরও পড়ুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ                                 

কানাডার সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com 

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 2 =