ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

মুখোশ || নাজনীন নিশা । পর্ব-২

পূর্ব প্রকাশেরপর…

মুখোশ || নাজনীন নিশাপর্ব-২

পরদিন সকালে বাবা নাশতা করতে করতে আমাকে বললেন কাল এত রাতে ফোনটা কে করলো বলতে পারো ?  বাবার কথার কোন জবাব আমার মুখে নেই , আমি শুধু মনে মনে বললাম বাবা ফোনটাতো তুমি তুলেছো তাহলে আমি কিভাবে বলবো কে করেছে ? বাবা আমার মনে মনে কথা বলা ধরতে পারলেন কিনা ঠিক বুঝলামনা। আমার দিকে তাকিয়ে বাবার পরের প্রশ্ন ছিল “তুমি তোমার ক্লাসের কাউকে বলনিতো অত রাতে ফোন করার জন্য ?” আমি আবারো মনে মনে বাবাকে জবাব দিলাম — ফোন করতে বললে আমি অত রাতে কেন বলবো আমাকে ফোন দিতে? আর যদি আমার কাছে কেউ ফোন করে থাকে তাহলে তুমি সেটা নিয়ে এত মাতামাতি করছো কেন ?? বাবা বোধহয়  এবারও আমার মনের কথাগুলো বুঝতে পারলেন। তিনি তার তৃতীয় প্রশ্নে আমাকে বললেন “কেউ তোমাকে ফোন দিলে এত রাতে করতে মানা করবে, এত রাতে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।”

রাত ১২ টা বাবার কাছে অনেক বেশি রাত মনে হয় কারণ বাবা খুব ভোরে উঠে নামাজ পড়েন ! রাস্তায় নেমে হাঁটাহাঁটি করেন। তারপর নাশতা করে অফিসে চলে যান। বাবার প্রতিদিনের ধরাবাঁধা রুটিন ।  এই রুটিনে চলতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ।

আজ রাতেও ঠিক ১২ টায় ফোনটা বিকট আকারে কয়েকবার শব্দ করে উঠলো । বাবা বিছানায় শুয়ে আমাকে ডেকে বললেন ফোন তুলতে । বাড়ির মাঝ বরাবর খোলামেলা যে রুমটা  ডাইনিং রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেখানে দৌড়ে গিয়ে টেবিলের পাশে রাখা ফোনটি আমি হাতে তুলে নিলাম।  ফোন কানে লাগিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভীষণ ভারী এক পুরুষ কণ্ঠস্বর আমাকে বললেন কেমন আছো বাবা?  আমি কিছুটা চিন্তার রেশ টেনে জিজ্ঞেস করলাম “আপনি কে বলছিলেন?  আমি ভালো আছি।”  ওপাশের কণ্ঠস্বরটি এবার বললো আমি কে সেটা আমি তোমাকে আরেকদিন বলবো। আজ রাখি । বলেই ফট করে ফোন রেখে দিলেন। এপাশ থেকে কয়েক দফা হ্যালো হ্যালো বলে  আমিও ফোনটা নিচে নামিয়ে রাখলাম। পরক্ষনেই কানে আসতে লাগলো বাবার কণ্ঠস্বর। বাবা জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছেন কার ফোন ছিল ? কে এতো রাতে ফোন করে তোমাকে।  আমি বাবাকে ফোন কে করেছিল সে বিষয়ে খুলে বললাম সবকিছুই । বাবা শুধু বললেন লাইট বন্ধ করে এবার ঘুমোতে যাও।  আবার ফোন দিলে জেনে নিও ঠিক করে । আমি লাইট বন্ধ করে নিজের রুমে চলে এলাম ।  বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই মনে হলো ফোনের সেই অপরিচিত কণ্ঠস্বরটা কানে বাজছে আমার।

আজ সারাদিন আমার ইউনিভার্সিটি এবং অন্য কাজগুলোর মাঝখানেও গত রাতের ফোন এর কথাটা মাথা থেকে একদম ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। নিজের অজান্তেই বার বার মনে পড়ছে ।

রাত ঠিক ১২ টা বাজতেই আমি ফোন বাজার অপেক্ষায় থাকলাম ।  বাবাও মনে হয় আমার সাথে সাথে ফোন এর অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ১২ টা বেজে  ১ টা বাজতে চললো,  ফোন আর বেজে উঠেনি।   ফোন এর অপেক্ষায় থেকে ঘুমে ক্লান্ত আমি এবং বাবা দুজনই একটা সময় যে যার বিছানায় চলে গেলাম ।

দিন সাতেক পর ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে বাসার মূল দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম বৈঠকখানাতে বসে আছেন আমার সেদিনের সেই চাচা চাচী, সঙ্গে তাদের মেয়েটি, যার নাম শৈলী বলেই সেদিন জেনেছিলাম। আজও এক এক করে চাচা চাচী দুজনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।  তারা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম আদরে। বিদায় নেবার আগে শৈলী মেয়েটি আমার রুমে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলো, তবে বইয়ের তাকের বইগুলো নাড়াচাড়া করতে আমি দেখিনি আজ। রাতে ওরা কেউ আমাদের সঙ্গে রাতের খাবারও খেয়ে যায়নি। শুধু আমি আর বাবা টেবিলে বসে এক সঙ্গে ভাত খেয়ে উঠে পড়লাম।

সকাল থেকে টানা কয়েক ঘন্টা ক্লাস করাতে আজ কিছুটা ক্লান্ত মনে হলো নিজেকে।  রাতে বিছানার  বালিশে মাথাটা রাখতেই যেন ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম।  আর ঠিক তখনি ফোনটা বিকট শব্দে আমার ঘুমের ১৩ টা বাজিয়ে আমাকে নির্ঘুম করে দিয়ে গেল। এক লাফে খাট থেকে নেমে গিয়ে দৌড়ে ফোন হাতে নিলাম।  আমি হ্যালো বলার আগেই ওপাশে ভীষণ মায়াবী এক নারী কণ্ঠস্বর হ্যালো বলে উঠলো। জানতে চাইলাম কে ?? মেয়েটি কোন জড়তা না রেখেই বললো কাগজটি খুলেছেন ? আমি কিছুটা হতচকিত হয়ে জানতে চাইলাম কিসের কাগজ ? ওপাশের নারী কণ্ঠটি এবারে বললো আপনার বইয়ের তাকে রাখা প্রথম সারির প্রথম বইটিতে আমি একটা চিরকুট রেখে এসেছি আপনার রুমে যখন গিয়েছিলাম তখন । আপনি সেটা পেয়েছেন কিনা তা জানতেই ফোন করলাম।

এতক্ষনে আমি বুঝতে পারলাম নারী কণ্ঠস্বরটি শৈলী নামক মেয়েটির, যে এসেছিলো আমাদের বাসায় ।  আমি কোন উত্তর না দিয়ে ফোন নিচে নামিয়ে রেখে দৌড়ে চলে এলাম আমার রুমে। শৈলীর কথামত বইয়ের তাকের প্রথম সারির প্রথম বইটিতে আমি সত্যিই পেয়ে গেলাম একটি চিরকুট। যাতে লেখা ছিল ” আমি কাল আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবো ঠিক ৪ টায়  টিএসসি চত্বরে।  আপনি আমার জন্য অপেক্ষায় থাকবেন।” জীবনে এই প্রথম কোন নারীর হাতে সামান্য একটি লেখা যাকে প্রেমপত্র বলবো নাকি অন্যকিছু কোনটাই মাথায় খেলছেনা।

লেখাটি পড়ে প্রথমে ইচ্ছে হলো শৈলীকে একটু বকে দেই। ওকে বলি পড়াশোনা যেন মনযোগ দিয়ে করে বাকি সবচিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে।  পরক্ষনেই ভাবলাম এভাবে বললে মেয়েটি কষ্ট পেয়ে কেঁদে ফেলতে পারে। মেয়েদের মন নাকি কচি ডাবের মত । বাইরে থেকে শক্ত মনে হলেও ভেতরের অংশ ভীষণ নরম এবং মিষ্টি। এসব নাটক কিংবা সিনেমার ডায়ালগ এ শুনেছি, আবার কখনো উপন্যাসের পাতায়ও পড়েছি । শৈলীর হাতের চিরকুটের বিষয়ে আমি দ্বিমত পোষণ করলেও ওর কথামত আমি বিকেল  চার’টা নাগাদ অপেক্ষা করতে লাগলাম টিএসসিতে।  ঠিক সাড়ে চার’ টায় ও একটা রিক্সা থেকে নেমে আমার হাত ধরে বললো রিক্সায় ওঠো। আশ্চর্য্য হয়ে খেয়াল করলাম ও আমাকে তুমি করে বলছে ! আমি না করতে করতে রিক্সা চলতে শুরু করলো । কোথায় যাচ্ছি আমি জানিনা। শৈলী  নিজেই বললো কোথাও থামতে চায়না ও। শুধু রিক্সায় বসে থাকবে পরের কয়েক ঘন্টা।

রিকশায় চলতে চলতে মনে হতে লাগলো বন্ধুদের মুখ থেকে শোনা তাদের প্রেম কাহিনীর অনেকটাই আজকের এই রিকশা ভ্রমণের সঙ্গে যেন মিলে গেলো । ভীষণ এক উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলাম। জীবনে কোনোদিন আমি কোন মেয়ের সঙ্গে এভাবে রিক্সায় উঠিনি। কখনো প্রেমের কথা ভুলেও কল্পনাতে আনার সুযোগ কিংবা সাহস কোনোটাই আমার হয়নি কোনদিন। অথচ সেই আমি প্রায় দুই ঘন্টা ধরে একটি মেয়ের পাশে বসে রিক্সার হুডি ফেলে ঘুরে বেড়াচ্ছি? একটু পরেই খেয়াল করলাম ভীষণ সুন্দর একটা সুঘ্রাণ আমার নাক ভেদ করে ব্রেইনে এসে ধাক্কা দিচ্ছে যা কিনা পাশে বসে থাকা শৈলীর কাছে থেকে পাচ্ছি আমি। চোখ বন্ধ করে আমি সে গন্ধটা নাকে নিতে থাকলাম আর ভাবলাম চোখ খুলে ওর কাছে জানতে চাইবো ওকি কোন সুগন্ধি গায়ে মেখেছে নাকি এটা ওর শরীরের ঘ্রান? কিন্তু চোখ খুলতেই  হঠাৎ মনে হলো যে কোন সময় আমাকে পরিচিতজনদের কেউ একজন দেখে ফেলবে। তখনি মহা বিপদ ! বাসায় বাবার কানে চলে যাবে। বাবা বলবে পড়াশোনা বাদ দিয়ে আমি এসবই করে বেড়াচ্ছি। রিক্সাওয়ালাকে বললাম এই থামাও।  শৈলী  আমার মুখের দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে রিক্সাওয়ালাকে বললো না থামিওনা ভাই।  তুমি চলতে থাকো। তারপর আমার হাতের উপর ওর হাতটি রেখে বললো “এই যে আমরা একসাথে রিক্সায় এলোমেলো ঘুরছি এটা কি তোমার একেবারেই ভালো লাগছেনা ? ” আমার হাতের উপরে একটি মেয়ের হাত, কি বিস্ময়কর ! এ বিষয়টিতে আমি কিছুটা জড়তা অনুভব করলেও আমার শরীরের ভেতরে কেমন যেন একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করলো। আমার জীবনে এটাই প্রথম কোন নারীর সংস্পর্শে আসার প্রথম অনুভূতি। আমার মুখ বলছে মেয়েটির হাত সরানোর কথা কিন্তু মন বলছে এ হাত কোনদিন সরিওনা ।

রিক্সাটা কখন যেন এসে থামলো কোন একটি তিনতলা দালানের কারুকাজ নির্মিত বিশাল আকৃতির একটি দরজা বরাবর।  শৈলী আমাকে রিকশা থেকে নামতে বললো।  কিন্তু এ যাত্রা আমি শৈলীকে বুঝিয়ে বললাম আমার এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে ।  বাবা হয়তো বাসায় বসে আমার জন্য চিন্তা করছেন ।  কিছুটা জোর করে শৈলীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি রিক্সা ঘুরিয়ে বাসায় চলে এলাম ।

ঘরে ঢোকার পর বাবা কেন যেন আজ জিজ্ঞেস করলেননা আমার এত দেরি করে বাসায় ফেরার কারণ।  জিজ্ঞেস করলে আমি হয়তো বাবাকে সব সত্যি কথাগুলোই বলে দিতাম।

সেদিন  রিকশায় ঘোরার পর থেকে আমি এ কয়দিনের ভেতরে আর একবারের জন্যও কোথাও যাইনি শৈলী’র সঙ্গে।  শৈলী আমাকে আরো কিছু চিরকুট দিয়েছে কখনো আমার ক্লাস এর সামনে দাঁড়িয়ে থেকে, কখনো ওর ড্রাইভার কে দিয়ে পাঠিয়েছে ।  প্রতিটি চিরকুটেই শুধু লেখা আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

আমি কিছুটা পড়ুয়া স্বভাবের ছেলে হওয়াতে আমার পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ করবার মতন টাইম মিলতোনা। তাই সেদিনের পর থেকে ও  যতই আমার কাছে ঘেঁষতে চাইতো আমি ততই ওকে দূরে ঠেলে দিতাম।  বারবার ফিরিয়ে দিতে দিতে শৈলীও ইদানিং যেন কিছুটা নিশ্চুপ হয়ে গেছে।

 

চলবে…

মুখোশ || নাজনীন নিশাপর্ব-১



সংবাদটি শেয়ার করুন