ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

ইন্টারভিউ ।।।। শীতল চট্টোপাধ্যায়

ইন্টারভিউ ।।।। শীতল চট্টোপাধ্যায়


ডিগ্রি লাভ করা শিক্ষিত ছেলেটার বয়স বাড়ে,
বয়স বাড়ে পাশ করা সার্টিফিকেটের!
ছেলেটা তার যোগ্যতার মাপকাঠির মাপকে
সমস্ত রকমের যোগ্যতা মাপের বিজ্ঞাপনেই যুক্ত ক’রে প্রতিদিনই দিতে যায় ইন্টারভিউ৷
বাড়ি ফিরলেই মা বলে, কালকে ক’টায় যাবি?
সেইমতো উঠে ভাত বসিয়ে দেবো ৷
প্রথম-প্রথম এক বুক আশা নিয়ে
মা জিজ্ঞেস করত, কেমন হয়েছেরে বাবা-
আজকের ইন্টারভিউ ?
ওই উত্তরই বাবাও শুনে নিতো,
আলাদা ক’রে আর প্রশ্ন না করে৷
ইদানিং ইন্টারভিউ দিয়ে ছেলে বাড়ি ফেরার পর,
কেমন হলো? মা আর জিজ্ঞেস করেনা, কারণ –
ইন্টারভিউয়ের সাথে চাকরি পাওয়ার কোনো
সম্পর্ক নেই বলেই!
বাড়ি ফেরত ক্লান্ত ছেলের চোখে-মুখে
নির্ভয়তার আলো – বাতাস ছুঁইয়ে দেয় বাবা-মা,
নিজের যোগ্যতাকে অনমনীয়তার সম্মান দিয়ে
ঘুমিয়ে পড়ে ছেলে৷
পরের দিন সকালে, যত্ন করে মায়ের খাওয়ানো ভাত খেয়ে, পিঠ ব্যাগে সার্টিফিকেটের ফাইলটা ভরে, সাইকেল চালিয়ে রওনা দেয় স্টেশনের দিকে, নতুন ইন্টারভিউ স্টেশনে পৌঁছুতে৷
এ ভাবেই মাস বছর পেরিয়ে যায়,
ইন্টারভিউয়ে দেখা যায়না কোনো ‘ভিউই’ ৷
ইচ্ছা, আগ্রহ, উদ্দেশ্য, প্রতিষ্ঠা স্বপ্নের কোণায়-কোণায় সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে জমে ওঠে মালিন্য আর ফাঁদের স্পষ্টতা ৷
সেদিন সোমবার, সপ্তাহের প্রথম দিন,
সেদিনও ছেলে তৈরী হয়ে গেছে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার জন্য, কিন্তু না,
আজ সে প্রথম তার বাবাকে বলল – না বাবা,
আমি আজ আর ইন্টারভিউ দিতে যাবনা,
চলো, তোমার সঙ্গে শোরুমে যাব, তুমি আজ
একটা টোটো কিনে দাও আমাকে!
সন্তানের কথায় – বাবা,মা,বুঝল
সন্তান ঘেরা লালিত স্বপ্ন এই মুহূর্তে
একটি অদৃশ্য রোলারে পিষ্ট হয়ে নিশ্চিহ্নে হারিয়ে গেল, তারপর এক সাথে  দীর্ঘশ্বাস ফেলল – বাবা -মা এবং সন্তানও৷
বাবার কিনে দেওয়া টোটো চালায় শিক্ষিত সন্তান, তার লেখাপড়া জানার জ্ঞানকে অপমানিত, মূল্যহীন করে হতাশা, দূরাশা, নিরাশার প্রতিদিন, সময়ের আশাহীন আঁধারে গ্রাস করে জীবনের স্বপ্ন আলো৷ নির্মম নিরুপায়ে নিজেকে জুড়ে নিচ্ছে চেনা পথের
কেমন যেন তাচ্ছিল্যে তাকিয়ে থাকার সাথে,
যে পথ ‘টোটো চালক’ নাম দিয়েছে তার ৷
স্বাধীনতা দিবসের দিন টোটোর মাথায় পতাকা বেঁধে, ছেলেটি বলে- তোর দেওয়া স্বাধীনতা টুকুতেই-  আমি আমার স্বাধীনতা খুঁজে নিচ্ছি আজ, আর সব থেকে পরাধীন মনে হচ্ছে আমার পাশ করা সার্টিফিকেটগুলোই৷
ইন্টিরভিউ দিতে না- যাওয়ার দিন থেকে
সার্টিফিকেট ভরা ফাইলটারও খোঁজ রাখিনা আর!
সেদিন টোটো চালিয়ে যেতে- যেতে ফোনটা বেজে উঠতেই- সেভ করা চেনা নামটা ৷ কলেজের বান্ধবী, বান্ধবীর সাথে হাঁটতে- হাঁটতে নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্ন সঙ্গী, বেশ অনেকদিন পর তারই ফোন ৷
ছেলেটির আগেই মেয়েটি বলল- তোর আমাকে আর গ্রহণ না করার মতো পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েই, তোকে আর ফোন করিনা, আমার এই মফঃস্বল এলাকায় কিছুদিন হলো টোটো চালাচ্ছি, লজ্জায় বলতে পারিনি তোকে,
মেয়েটির কথা শেষ হওয়ার আগেই ছেলেটি বলল – আমি তো তোর আগে থেকেই টোটো চালক,
তোকে জানালে হয়তো প্রত্যাখ্যান করবি আমাকে, জানাইনি তাই!
তখন দিনান্তের হলুদ সূর্যতেই- নতুন প্রভাতী সূর্যকে দেখতে পেলো ওরা, ওই সূর্য নিচে দু’জনে একসাথে হতে, ছুটে চলল টোটো চালিয়ে ৷


ঠিকানা – জগদ্দল , পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ

 




সংবাদটি শেয়ার করুন